গত ৩ জানুয়ারি ছিল সাবিত্রীবাই ফুলের জন্মদিন। তাঁর নামে কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই-সহ সারা ভারতে এনআরসি, সিএএ, এনপিআর বিরোধী প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন মহিলা, কুইয়ার ও ট্রান্স-সংগঠনগুলি। জড়ো হয়েছিলেন অজস্র মানুষ। সাবিত্রীর নামে প্রতিবাদ চলতে থাকবে। কেননা, সমাজ ও শিক্ষা সংস্কার, জাতপাত ও নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করার জন্য মনুবাদী সবর্ণ সমাজের সঙ্গে তাঁর যে মরণপণ লড়াই, সেই আদর্শের সঙ্গেই প্রতিবাদীরা নিজেদের মিলিয়ে নিতে চাইছেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর আগে কখনও কোনও ‘অচ্ছুত’ সমাজসংস্কারক সর্বভারতীয় আন্দোলনের আইকন হয়ে উঠতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।
কেননা, এই সমাজের ভিতরে ভিতরে রয়ে গিয়েছে জাতপাতের থাকবন্দি কাঠামো, যা শাস্ত্র অনুযায়ী বৈধ। অধিকাংশের বিশ্বাসে, রোজকার জীবনে ছোঁয়াছুঁয়ি মেনে চলার প্রথায়, তা অটুট। সে রকম একটা দেশে, ১৮৪৮ সালে পুণের ভিদেওয়াড়ায় ১৭ বছরের কিশোরী সাবিত্রীবাই শতচ্ছিন্ন শাড়ি পরে চলেছিলেন খোলা রাস্তা দিয়ে। তিনি আর তাঁর স্বামী জ্যোতিরাও ফুলে, নিচু জাত আর অস্পৃশ্য সমাজের বালিকাদের জন্য বানিয়েছেন স্কুল, ভারতের ইতিহাসে মেয়েদের জন্য সেই প্রথম। সাবিত্রী মেয়ে হয়ে ‘বেহায়া’ রাস্তায় নেমেছেন। কোথায় তিনি অচ্ছুত বলে নিজের মহল্লায় বসে ছোট জাতের মেয়েদের নীচ কাজগুলি করবেন, তা না, নিচু জাতকে সবার সমান করার স্পর্ধায় খুলে বসেছেন ইস্কুল! যে-পথে তাঁর জাতের লোকের হাঁটার এক্তিয়ার অবধি নেই, সেই পথে হেঁটে যাচ্ছেন, তা-ও আবার স্কুলে পড়াতে। ফলে সবর্ণ মুরুব্বিরা অচ্ছুত মেয়ের ঔদ্ধত্য ভাঙতে, গায়ে ছুড়ে মারছে ঢিল-পাটকেল, নোংরা কাদা, পুরীষ। সাবিত্রী রোজ স্কুলে পৌঁছে ওই নোংরা-মাখা কাপড়টা বদলে পরে নেন ঝোলায় রাখা কাচা শাড়ি, ফিরতি পথে আবার পরে নেন নোংরা ছেঁড়াটা। রোজ। আর সবর্ণ পুরুষের পাল তাঁর পিছু ধাওয়া করে, চিৎকার করে ডাইনি বেশ্যা বলে গালিগালাজ করতে থাকে।
কিন্তু সাবিত্রী বলেছিলেন, আমার বোনেদের অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে বার করে আনার কঠিন ব্রত নিয়েছি আমি। তোমাদের ছুড়ে মারা ঢিল আর নোংরা আমার গায়ে এসে ফুল হয়ে যায়। ঈশ্বর তোমাদের ভাল করুন।
ন’বছরের সাবিত্রীর বিয়ে হয় বারো বছরের জ্যোতিরাওয়ের সঙ্গে। জ্যোতিরাও নিজে পড়াশোনা শেখার সঙ্গে সঙ্গে পড়াতে থাকেন সাবিত্রীকে। আর ব্রাহ্মণ্য ভারতবর্ষের ইতিহাসে, শূদ্র ও অতিশূদ্রের জন্মসূত্রে পাওয়া শৃঙ্খলে, মাথা হেঁট করে জিভ দিয়ে ধুলো চেটে যাওয়া জীবনে, এই প্রথম স্বাধিকারের কথা উচ্চারিত হতে থাকে তাঁদের কাজের মধ্যে দিয়ে। দলিত বালিকাদের স্কুল তৈরি করার অপরাধে সাবিত্রী-জ্যোতিরাওকে ছাড়তে হয় ভিটে। তখন তাঁদের আশ্রয় দেন এক মুসলমান দম্পতি। সেই ১৮৪৮-এই সাবিত্রী পড়ে ফেলেন টমাস পেন-এর রাইটস অব ম্যান গ্রন্থটি, যা তাঁকে আর তাঁর স্বামীকে সামাজিক ন্যায় ও সাম্য অর্জনের লড়াইতে উদ্বুদ্ধ করে। ওঁরা দাবি করেছিলেন, প্রতিটি গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে ব্রিটিশ সরকারকে। আর ১৮৫২ সালের মধ্যেই জাতপাতের বিচারে অচ্ছুত মাহার ও মাং জাতের শিশুদের জন্য নিজেরা তৈরি করেছিলেন তিনটি স্কুল। তা চলত ইউরোপীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। দলিতদের ওপর ব্রাহ্মণ্য নিপীড়নের সঙ্গে, জ্যোতিরাও তুলনা করেছিলেন কালো মানুষদের ওপর শ্বেতাঙ্গ অত্যাচারের। তাঁর ব্যবহার করা ‘দলিত’ শব্দটিই ১৯৭০-এ ‘দলিত প্যান্থার’ গোষ্ঠীর ইস্তাহার মারফত একটি সর্বজ্ঞাপক আত্মচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়।
গুলামগিরি (১৮৭৩) বইতে জ্যোতিরাও বললেন, জাতপাতের ভিত্তিতে করা উঁচু-নিচু ভেদ, দমনপীড়ন আর অস্পৃশ্যতা— আসলে বহিরাগত আর্য জাতির দেশীয় ভূমিজাতির ওপর দখলদারি। দেখালেন, সামাজিক ভাবে মানুষকে দমন করা যায় অর্থনৈতিক অবদমনের মাধ্যমে। অর্থাৎ, জাতপাত আসলে অর্থনৈতিক অবদমন। এবং সংস্কৃত শাস্ত্র আর পুরাণগুলি আর কিছুই নয়, আর্যরা যে-সব হীন ও কুটিল প্রক্রিয়ায়, ছলে-বলে, অন্যায্য কৌশলে অনার্যদের পরাভূত করেছে, সেই অনৈতিক পথগুলিকেই ন্যায্য হিসেবে রচে তোলার বয়ান। পুরোটাই জ্যোতিরাও লেখেন সাবিত্রীর সঙ্গে সংলাপের মতো করে, কারণ তাঁরা সহযোদ্ধা ছিলেন। হীন জীবন থেকে শূদ্র-অতিশূদ্রদের বার করে আনতে তাঁরা জোর দিয়েছিলেন ইংরেজি শিক্ষার ওপর। বলেছিলেন, ইংরেজি ভাষায় পড়াশোনা করে সাম্যের ধারণা বুঝতে হবে দলিতকে। অন্য দিকে, সংস্কৃত শাস্ত্রে লেখা চতুর্বর্ণকে ব্রাহ্মণ্য ক্ষমতা বলে বুঝে, তার বিরুদ্ধতা করতে হবে।
সাবিত্রীর যুদ্ধ ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদিতা, পিতৃতন্ত্র ও সংস্কৃত শাস্ত্রের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি মহারাষ্ট্রে পেশোয়াদের প্রভুত্ব অপসারণ করার সঙ্গে সঙ্গে, শূদ্র ও অতিশূদ্রদের জন্য খুলে গিয়েছিল সামাজিক প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের সুযোগ। ইতিহাসে প্রথম বার সে সুযোগ পেয়ে তাঁরা প্রাণভরা কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন খ্রিস্টান মিশনারিদের আর ব্রিটিশ শাসনকে। কারণ, এঁদের স্কুলেই অস্পৃশ্য শিশুরা প্রথম শিক্ষার জগতে পা রাখতে পারে। আর তাই ওঁরা বুঝেছিলেন, যা করার এই ব্রিটিশ শাসনেই করে নিতে হবে। সবর্ণ সমাজ দলিতের আত্ম-উন্নতি সহজে মেনে নেবে না। একমেটে ভারতবর্ষ নির্মাণের নেশায় ভুলে থাকবে থাকবন্দি নানা অসাম্য। গাঁধীবাদী ব্রিটিশবিরোধী প্রকল্পে, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ মডেল হয়ে দাঁড়ায় আমাদের দেশে এক উজ্জ্বল পন্থা। যদিও গাঁধীর মডেলে দলিত মুক্তি সম্ভব একমাত্র সবর্ণ পৃষ্ঠপোষকতায়, দলিতের সক্রিয় ভূমিকায় নয়। এ দিকে জ্যোতিরাও, সাবিত্রী ও অম্বেডকরের দলিত মুক্তির আদর্শ ছিল: নিম্ন জাতির সক্রিয় ভূমিকা।
সাবিত্রী একটা গান বেঁধেছিলেন ১৮৬০-এর আশেপাশে। “শূদ্র শব্দকা সহি অরথ হৈ নেটিভ/ আক্রমক শাসকো নে শূদ্রকা ছাপ্পা লাগায়া/ পরাজিত শূদ্র হুয়ে গুলামইরানি ব্রাহ্মণোকি… অসল মে শূদ্র হি স্বামী ইন্ডিয়াকে।’’
গ্রামের কুয়ো থেকে দলিতদের জল নেওয়ার অধিকার ছিল না। সাবিত্রী নিজের উঠোনে কুয়ো তৈরি করেছিলেন, যাতে দলিতেরা সবাই জল পান। সাবিত্রীর প্রতিবাদ ক্রমে হয়ে উঠেছিল আরও তীব্র। যৌন অত্যাচারে গর্ভবতী মহিলাদের জন্য (ব্রাহ্মণ-সহ) তিনি আর জ্যোতিরাও তৈরি করেছিলেন আশ্রম, ‘বালহত্যা প্রতিবন্ধকগৃহ’, পুণেতে তাঁদের নিজের বাড়ি, ৩৯৫ গঞ্জপেড়-এ। সাবিত্রী নিজে এই মায়েদের প্রসবে সাহায্য করতেন, শুশ্রূষা করতেন। পিতৃনামহীন এমনই এক শিশুপুত্রকে দত্তক নেন তাঁরা। আর জ্যোতিরাওয়ের উইলে লেখা হয়, এই আশ্রমের সব মহিলাই সাবিত্রীর কন্যা, যাতে তাঁদের সামাজিক মান অক্ষুণ্ণ থাকে।
জ্যোতিরাও ১৮৭৩-এ প্রতিষ্ঠা করেন ‘সত্যশোধক সমাজ’, দলিত সম্প্রদায়কে যুক্তি ও ন্যায়ের শিক্ষা দিতে। গণবিবাহ আয়োজন করা হত ব্রাহ্মণ পুরোহিত, অগ্নিসাক্ষী ও দেনাপাওনা ছাড়া। জ্যোতিরাওয়ের মৃত্যুর পর সাবিত্রী ধরেন প্রতিষ্ঠানের হাল। সেখানে তখন দলিত মহিলা সদস্য সংখ্যা ৯০-এর ওপরে।
এ দেশে আজও দলিতদের কুয়ো আলাদা, আজও জাতের সীমা উল্লঙ্ঘিত হলে দলিত পুরুষকে গাড়িতে বেঁধে ছেঁচড়ে নেওয়া হয়, মৃত মা’কে দাহ করতে তাঁর অচ্ছুত মৃতদেহ ছেলেকে সাইকেলে করে মাইলের পর মাইল নিয়ে যেতে হয়, উঁচু জাতের জলের কল ছুঁয়ে ফেলায় দলিত শিশুর চোখ খুঁচিয়ে অন্ধ করে শাস্তি দেওয়া হয়, দলিত নারী ব্রাহ্মণ বা রাজপুতের গাছের ফল কুড়োলে তাঁকে নগ্ন করে গ্রামে ঘোরানো হয়, দলিত নারী বাল্যবিবাহ-বিরোধী কাজে নামলে গণধর্ষণ করা হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় দলিত গ্রামকে গ্রাম। সেই দেশেরই ইতিহাসের পাতা থেকে সংস্কারক হিসেবে বাদ থেকে যান জ্যোতিরাও আর সাবিত্রী। তাঁরা দলিতদের সংস্কারক হয়ে থাকেন, খণ্ড হয়ে, ‘কোটা’য়। তাঁরা নিজেরাও দলিত বলে, সামগ্রিক নেশনের ইতিহাসে সংস্কারকের মান পাওয়া তাঁদের হয় না। এমনকি শিক্ষক দিবসেও সাবিত্রীবাই ফুলেকে কারও মনে পড়ে না।
সে কারণেই সাবিত্রীবাইকে এই আন্দোলনের দিকচিহ্ন হিসেবে ধার্য করার গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি অন্যায় ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক অসামান্য ক্রান্তিকারী। তাঁর নামে মুসলমান, দলিত, নারী, যৌন প্রান্তিক মানুষ— সবার সঙ্কট ও অধিকার একসঙ্গে ঘোষণা করা যাচ্ছে, যেন সকলেই সকলের হাত ধরে দাঁড়াতে পারবেন এই আন্দোলনে, ক্ষুদ্র স্বার্থ ছেড়ে অন্য মানুষের অধিকারের কথা বলতে পারবেন। তা ছাড়াও, এখন এমন এক আদর্শ দরকার, যা এত দিনের নেশন স্টেট-এর ইতিহাসকে ফিরে পড়তে পারে। সংবিধানের সমুন্নত উদ্দেশ্যগুলি আজ ব্যর্থ হল কেন, দলিত, মুসলমান ‘গেটো’য়, জনজাতির আদি ভূমিতে, কাশ্মীরে, উত্তর-পূর্বে, রাষ্ট্রের উৎকট পীড়ন কী ভাবে পাক খাচ্ছিল, সঙ্কট বাড়ছিল বাকি দেশের কালনিদ্রার সুযোগে— সেই আলোচনায় যাওয়া যেতে পারে, বাদ পড়ে থাকা সাবিত্রীর নামে।
তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ,
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy