প্রয়াত ডঃ মনমোহন সিংহ।
‘ইতিহাস আমার প্রতি সদয়তর হবে।’
প্রধানমন্ত্রিত্বের শেষবেলায় ২০১৪ সালে মনমোহন সিংহ এই আশা প্রকাশ করেছিলেন। এবং পরে বলেছিলেন, ‘‘আমি চুুপচাপ থাকতাম বটে, কিন্তু সাংবাদিক সম্মেলন করতে কখনও ভয় পাইনি।’’ মৃত্যুর দিনটিতে মনমোহন সিংহের ভদ্রতা, নম্রতা এবং একই সঙ্গে সাহসী দৃঢ়তার কথাই স্মরণ করলেন দলমত নির্বিশেষে সকলেই।
রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে ৩৩ বছর কাটানোর পরে গত এপ্রিলে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছিলেন মনমোহন। গান্ধী পরিবারের বাইরে একমাত্র কংগ্রেস নেতা, যিনি টানা দু’দফায় দশ বছর প্রধানমন্ত্রীর আসনে থেকেছেন।
কেন্দ্রীয় সরকারের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। অর্থ মন্ত্রকের সচিবের পদে ছিলেন। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর। যোজনা কমিশনের উপাধ্যক্ষ। নরসিংহ রাওয়ের অর্থমন্ত্রী হিসেবে অর্থনীতির উদারীকরণ করেছিলেন। তার পরে প্রধানমন্ত্রী।
শরীর অশক্ত হয়ে পড়েছিল অনেক দিন ধরেই। শেষবেলায় হুইলচেয়ারে চেপেই রাজ্যসভায় আসতেন। তা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভোটাভুটি হলে হাজির থাকতেন। বৃহস্পতিবার গোটা কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব যখন কর্নাটকের বেলগাভিতে বর্ধিত ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ব্যস্ত, সে সময় আচমকাই বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন ৯২ বছরের মনমোহন সিংহ। তড়িঘড়ি তাঁকে দিল্লির এমস-এ নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। রাত ৯টা ৫১ মিনিটে প্রয়াত হন তিনি।
এমস–এর তরফে জানানো হয়েছে, বয়সজনিত অসুস্থতার জন্য মনমোহন সিংহের চিকিৎসা চলছিল। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি আচমকাই সংজ্ঞা হারান। বাড়িতেই তাঁকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা শুরু হয়। রাত ৮টা ৬ মিনিটে এমস-এর জরুরি বিভাগে নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু সব চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁর প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। আগামিকাল কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত অনুষ্ঠান মনমোহনের সম্মানে বাতিল করা হয়েছে। ঘোষণা করা হয়েছে সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক। পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মনমোহনের শেষকৃত্য হবে কাল। তার আগে সকাল ১১টায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠক বসবে।
আজ খবরটা পেয়েই রাহুল গান্ধী, মল্লিকার্জুন খড়্গে-সহ কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব বেলগাভিতে আগামিকালের জনসভা বাতিল করে দিল্লি ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। দিল্লিতে সনিয়া গান্ধী এবং প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা এমস-এ পৌঁছে যান। বিজেপি সভাপতি, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জে পি নড্ডাও এমস-এ পৌঁছন।
২০০৪ সালে সনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর পদ নিতে রাজি হননি। তার পরেই প্রধানমন্ত্রী পদে মনমোহন সিংহের অভিষেক। গোটা দুনিয়া মনমোহনকে তাই ‘অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ বলেছে। ‘দুর্বল’ প্রধানমন্ত্রী বলেছে। ‘মৌনীবাবা’ বলে বিরোধীরা কটাক্ষ করেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই মনমোহন সিংহই ভারত-আমেরিকা পরমাণু চুক্তি নিয়ে এমন কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন যে, সরকার পতনের ঝুঁকিরও তোয়াক্কা করেননি। বামেরা সমর্থন প্রত্যাহারের হুমকি দেওয়ায় বলেছিলেন, ‘‘সমর্থন প্রত্যাহার করলে করুক।’’ আজ মনমোহনের প্রয়াণের পরে রাহুল গান্ধী বলেছেন, ‘‘মনমোহন সিংহ তাঁর জ্ঞান ও সততা দিয়ে ভারতের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর নম্রতা এবং অর্থনীতির গভীর বোধ দেশকে অনুপ্রাণিত করেছে।’’ রাহুলের বক্তব্য, তিনি তাঁর ‘মেন্টর’ ও ‘গাইড’-কে হারালেন।
মনমোহনকে ‘মৌনমোহন’ বলে এক সময়ে কটাক্ষ করেছিলেন যিনি, সেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিংহ মানুষের জীবনে বিরাট ছাপ রেখে গিয়েছেন। উনি যখন প্রধানমন্ত্রী, আমি তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। নিয়মিত কথা হত। প্রশাসনের বিভিন্ন বিষযে বিস্তারিত আলোচনা হত। ওঁর বিশাল জ্ঞান ও নম্রতা ফুটে উঠত।’’ মনমোহন সিংহের এই নম্রতার কথাই আজ গোটা দিল্লির রাজনীতিক থেকে আমলারা স্মরণ করেছেন।
যোজনা কমিশনের প্রাক্তন যুগ্ম উপদেষ্টা অমিতাভ রায় যেমন বললেন, ‘‘২০০৪ সালের এপ্রিলের এক সকালে পৌনে ৯টায় পৌঁছে দেখেছিলাম, যোজনা কমিশনের রিসেপশন কাউন্টারে এক প্রবীণ ভদ্রলোক খাতায় নাম লিখে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি চাইছেন। নিজের দফতরে হাজিরা দেওয়ার মুহূর্তে এমন দৃশ্য দেখে কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, স্যার আপনার এই সব কী দরকার? আপনি যোজনা কমিশনের সচিব ছিলেন। উপাধ্যক্ষ হয়েছিলেন। আপনাকে সকলে চেনে। সিআইএসএফ-এও। কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, বেটা, কানুন সব কে লিয়ে বরাবর হোনা চাহিয়ে। তার কয়েক সপ্তাহ পর তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী তথা যোজনা কমিশনের অধ্যক্ষ হলেন।’’
মনমোহন সিংহের গভীর অর্থনীতি বোধের জন্য বিশ্বের তাবড় নেতা তাঁর দ্বারস্থ হতেন। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর স্মৃতিকথায় মনমোহন সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘একজন চিন্তাবিদ, ব্যতিক্রমী ভদ্র মানুষ’। মোদী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সঞ্জীব সান্যালের বক্তব্য, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও, অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ যে আর্থিক সংস্কার এনেছিলেন, আমার প্রজন্মের ভারতীয়রা তারই ফসল। ভারতের জন্য বিংশ শতাব্দীর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বছর হল ১৯৪৭ ও ১৯৯১। ১৯৪৭ রাজনৈতিক স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল। ১৯৯১ আর্থিক স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল। মনমোহন সিংহ তাঁর আর্থিক উদারীকরণের জন্য চিরকাল স্মরণীয় থাকবেন।’’
মনমোহন সিংহের জীবন শুরু হয়েছিল পশ্চিম পঞ্জাবের একটি অনগ্রসর গ্রামে। যা এখন পাকিস্তানের অন্তর্গত। যে গ্রামে কোনও স্কুল ছিল না। বিদ্যুৎ ছিল না। তাঁকে কেরোসিনের লম্ফের আলোয় পড়াশোনা করতে হত। মনমোহন নিজেই বলেছিলেন, গরিব ছাত্রদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা ছিল বলেই তিনি পড়াশোনা শেষ করতে পেরেছিলেন। মনমোহনের আমলেই দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার টু-জি স্পেকট্রাম, কমনওয়েলথ, কয়লা খনি বণ্টন কেলেঙ্কারি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগের মুখে পড়েছিল। তখনও বিরোধীরা মনমোহন সিংহের দিকে সরাসরি আঙুল তুলতে পারেননি সে ভাবে। প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরার মতে, রাজনীতিতে খুব কম মানুষই এমন সম্মান পান, যা মনমোহন সিংহ পেয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy