ছবি: সংগৃহীত।
রোজ ভোরে এ ভাবেই ঘুম ভেঙে যায়। আজানের সুর ভেসে আসে, দূরের মসজিদ থেকে। ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। এক-দু’ পা করে আলো ফুটতে শুরু করে। বাড়ির বধূরা কেউ কেউ ফুলের সাজি হাতে বেরিয়েছেন তখন। জবা-শিউলি-জুঁই-দোলনচাঁপা নানা ফুলে সাজি ভরে ওঠে। তোর্সার পার ধরে ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটি বাঁকে কালী মন্দিরের কাছে পৌঁছই।
সকাল হয়েছে তখন। প্রাতঃভ্রমণকারীরা কেউ কেউ মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রণাম করছেন। তোর্সা থেকে তখন মাঝিদের ঘরে ফেরা। পুবের আকাশ লাল হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এ-এক অদ্ভুত সময়। সেই লাল সূর্যটি যেন নদী ভেদ করে উঠে আসছে। তার মধ্যেই ভেসে আসতে শুরু করেছে ধূপের গন্ধ। ঘণ্টা আর উলু’র আওয়াজ। মন্ত্র পড়ছেন কেউ— আমার ছোট্ট গ্রাম এমনই। কস্মিনকালেও কেউ ভেদাভেদ দেখেনি। আড় চোখে কেউ কারও দিকে তাকায়নি। কাউকে দেখে ফিসফাস শুরু হয়নি কোথাও। গ্রাম ছাড়িয়েই শহর। সেখানেও সবাই যেন মিলেমিশে একাকার। যেন ‘একই বৃন্তে দু’টি কুসুম’ই। অন্ততপক্ষে এমনটাই অনুভব করেন এক বার এই গ্রাম এই শহর ছুঁয়ে ঘুরে যাওয়া লাখো লাখো মানুষ।
আজ, চারদিক থেকে একটি অসহিষ্ণুতার বাতাস ভেসে আসে। বিভেদ যেন ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে। যা আমার এমন সুন্দর কোচবিহারকেও ঘিরে ফেলতে চায়, থাবা বসাতে চায়। কখনও কখনও এই অঞ্চলেও শোনা যায় তেমনই স্বর। কোথায় যেন একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামের এক বাজারের ঘুপচি অন্ধকারে কয়েকজন ফিসফিস করে কথা বলে, কীসের কথা এগুলো? কেন এমন হল? কেন এমন হচ্ছে? এই কোচবিহার তো অন্য কথা বলত। এই কোচবিহারে তো আবহমান কাল ধরে আমরা ভাই-ভাই। তা হলে?
পুজোর গন্ধ এসে গিয়েছে প্রায়। সবাই হাতে হাত মিলিয়ে নেমে পড়েছে মাঠে। প্রতিমা আনতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে অলোক, বরুণ, রমজানরা। ষষ্ঠীর দিন থেকেই বুকে ব্যাজ পরে ভিড় সামলাতে ব্যস্ত। নতুন জামাকাপড়ের গন্ধ রঞ্জিতের বাড়ি ছাড়িয়ে চলে গিয়েছিল আমিদুলের বাড়ির কাছে। অষ্টমীর সকালে সবাই কেমন পাজামা-পাঞ্জাবী পরে মণ্ডপের সামনে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে, ওই তো দূরে লক্ষ্মী-সঙ্ঘমিত্রার সঙ্গে পারভিন। কী সুন্দর জামা পরেছে স্কুলের সরস্বতী পুজোতে। রাত জেগে মণ্ডপ সাজিয়ে তুলছে পবিত্র, আনসাররা।
আতরের গন্ধ নাকে এসে লাগে। মোমবাতি হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন মায়েরা। ইদের দিন মেলা বসে। গান বাজে। হিন্দি-বাংলা। মাইকের আওয়াজে হাতে হাত চেপে দাঁড়িয়ে সেই ছোট্ট শিশুর দল। তারপর সেই দিন সিমাই খাওয়ার আমন্ত্রণ। লোভনীয় বিরিয়ানি। এ যেন ফর্দ কষতে বসা। কার কার বাড়ি যেতে হবে। গাঁট গুণে সংখ্যাটা দশ পেরিয়ে যায়। সন্ধ্যায় হুল্লোড়। সিনেমা হলে ভিড়। রাসমেলায় তো আবার আর এক মজা। মদনমোহন মন্দিরে ঢুকে রাসচক্র ঘোরানো। এক বার প্রণাম করে নেওয়া। সেই চক্র যা তৈরি করেছে আলতাফ মিয়াঁ। সে রাজাদের সময়ের কথা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যেন সেই একই ইতিহাস। পাশাপাশি আমাদের বাড়ি, আমাদের গ্রাম। ছোট থেকে বড় হয়েছি একই মাঠে দৌড়ে, একই স্কুলে পড়ে করে, একই সঙ্গে ভাগ করে খেয়েছি খাবার।
কীসের বিভেদ তবে? কীসের লড়াই? আমরা তো ভাল আছি। এ ভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। কোনও অসুবিধে হয়নি কখনও। আজ কেন এমন বাতাবরণে আতঙ্ক ছড়িয়েছে গ্রামে। এত হিংসা কেন? এর পেছনে কি তবে রাজনীতি?সে রাজনীতির উদ্দেশ্য কী? তার শিকার আমরা হব কেন? অসৎ উদ্দেশ্যে রোপণ করা বিভেদের বীজ উপড়ে ফেলতেই হবে। একসঙ্গে হাতে-হাত রেখে লড়াইয়ে নামতে হবে। তবেই আমরা আমাদের ইতিহাস ধরে রাখতে পারব। মানুষ হয়ে উঠতে পারব আবার।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy