পর পর দু’বছর প্রকাশিত হল গৃহস্থালির খরচ সংক্রান্ত সমীক্ষা (হাউসহোল্ড কনজ়াম্পশন এক্সপেন্ডিচার সার্ভে)। নরেন্দ্র মোদীর জমানায় এ এক উল্লেখযোগ্য খবরই বটে। অনুমান করা চলে, তৃতীয় দফা সরকার গড়ার পর কর্তাদের প্রাণে ভয় খানিক হলেও কমেছে। ভারতীয় পরিসংখ্যানের যে ক্ষতি এই জমানায় হয়েছে, তা অপূরণীয়। তার পরিমাণ যদি আর না বাড়ে, তবু মন্দের ভাল। সমীক্ষার ফলাফলে পশ্চিমবঙ্গের জন্য দুঃসংবাদ রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, মাথাপিছু মাসিক গড় ব্যয়ের অঙ্ক পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় গড়ের তুলনায় বেশ খানিকটা কম। পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম ও শহরে মাথাপিছু মাসিক ব্যয় যথাক্রমে ৩,৬২০ টাকা ও ৫,৭৭৫ টাকা; জাতীয় গড় যথাক্রমে ৪,১২২ টাকা ও ৬,৯৯৬ টাকা। ব্যবধানগুলি অকিঞ্চিৎকর নয়। মাথাপিছু গড় ব্যয় মানুষের— বিশেষত দরিদ্র মানুষের— আর্থিক অবস্থা বিচার করার অন্যতম নির্ভরযোগ্য মাপকাঠি। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ জাতীয় আয়ের তুলনায় দরিদ্রতর। লক্ষ্মীর ভান্ডার বা অন্যান্য ভাতার টাকা যে-হেতু নগদ হস্তান্তর হয়, ফলে সেই টাকার ব্যয়ের হিসাবও ধরা রয়েছে এই অঙ্কে। অন্যান্য যে নগদবহির্ভূত সাহায্য, যেমন রেশনের চাল বা হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা, সেগুলি এই হিসাবে নেই— কিন্তু সেই টাকা হিসাবে আনলেও পশ্চিমবঙ্গের তুলনামূলক অবস্থান খুব পাল্টাবে না। স্পষ্টতই, পশ্চিমবঙ্গ এখন ভারতের দরিদ্র রাজ্যগুলির তালিকায় ঠাঁই পায়। তার জন্য অবশ্য সরকারি পরিসংখ্যান দেখারও প্রয়োজন হয় না— হাওড়া-শিয়ালদহ-সাঁতরাগাছি থেকে ছাড়া যে কোনও ট্রেনের অসংরক্ষিত কামরার দিকে তাকালেই ছবিটি স্পষ্ট হয়। এই দায় রাজ্য প্রশাসনকে নিতেই হবে। রাজ্যে বৃহৎ শিল্প গড়ে না উঠলে, অর্থনীতি গতিশীল না হলে যাবতীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সামাজিক ন্যায়-কেন্দ্রিক পুনর্বণ্টন প্রকল্প যে শেষ অবধি দারিদ্রের পুনর্বণ্টন বই আর কিছুই করে না, তার মোক্ষম নিদর্শন প্রতিষ্ঠা করছে আজকের পশ্চিমবঙ্গ।
অবশ্য, সামগ্রিক ভাবে দেশের ছবিটিও খুব উজ্জ্বল নয়। গ্রাম ও শহরাঞ্চলে মাথাপিছু ব্যয়ের ব্যবধান কমেছে বলে কেন্দ্রীয় সরকার প্রচার করছে, ভারতে আর্থিক অসাম্য কমছে। নির্জলা অনৃতভাষণ। সমগ্র রিপোর্টটি দেখার প্রয়োজন নেই, তার ‘প্রেস নোট’ অংশটিতেই দেখা যাবে, গ্রাম এবং শহর, উভয় ক্ষেত্রেই গড় ব্যয়ের উপরে রয়েছে ২৫-৩০ শতাংশ মানুষ। অর্থাৎ, জনসংখ্যার তিন সিকি অংশ এই সামান্য গড় ব্যয়ের অঙ্কেও পৌঁছতে পারেন না। এবং, মনে রাখা প্রয়োজন যে, আয় যত বাড়ে, তাতে ভোগব্যয়ের অনুপাত ততই কমে— অর্থাৎ, আয়ের মাপকাঠিতে এই বৈষম্য আরও প্রকট। এবং, সঞ্চয়ের সেই বৈষম্য ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ধারণের ক্ষেত্রেও নির্ণায়ক ভূমিকা নেবে— আজ যাঁদের আয় কম, ভবিষ্যতে তাঁদের সুযোগ সঙ্কীর্ণতর হবে।
পর পর দু’বছরের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, খাদ্যপণ্যের পিছনে ব্যয়ের অনুপাত খানিকটা বেড়েছে। বাজারে খাদ্যপণ্যের যে ধারাবাহিক মূল্যস্ফীতি ঘটছে, তাতে এই বৃদ্ধি প্রত্যাশিত। কিন্তু, সেই ধাক্কা সকলের কাছে সমান নয়। যে পরিবারে মাথাপিছু মাসিক ভোগব্যয় ২০,৩১০ টাকা (শহরাঞ্চলের ধনীতম পাঁচ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মাসিক গড় ভোগব্যয়), আর যে পরিবারে মাসিক গড় ভোগব্যয় ২,৩৭৬ টাকা (শহরাঞ্চলেরই দরিদ্রতম পাঁচ শতাংশ), নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য তাঁরা কেনেন একই বাজার থেকে। তাঁদের কেনাকাটার ধরন এক নয়, পণ্যের গুণগত মান পৃথক, সবই ঠিক, কিন্তু বাজারে আগুন লাগলে তার আঁচ সব পণ্যের গায়েই লাগে। ক্রয়ক্ষমতা যত কম, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা তত বেশি জোরে লাগে। অতএব, অসাম্য হ্রাসের যে বয়ানটি কেন্দ্রীয় সরকার খাড়া করতে চাইছে, যুক্তির কষ্টিপাথরে তা দাঁড়ায় না। পরিসংখ্যান গোপন করার ব্যাধির তুলনায় তার অপব্যাখ্যার প্রবণতাটি খুব কম ক্ষতিকর নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy