Advertisement
০৮ জানুয়ারি ২০২৫
Air Pollution

দূষণক্লান্ত রাজধানী

ধানের বীজ বপন এবং বীজতলা থেকে ধানের চারা রোপণের প্রচলিত সময় প্রায় এক মাস পিছিয়ে দেওয়া হল। ফলত, ধান কাটার সময়ও প্রায় এক মাস পিছিয়ে গেল। এখান থেকেই সমস্যার সূচনা।

অমিতাভ রায়
শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:৪৮
Share: Save:

একুশ শতকের প্রথম দশকের শেষ দিকে পঞ্জাব সরকার রীতিমতো আইন প্রণয়ন করে জমিতে ধানের বীজ বপনের একটি দিন নির্দিষ্ট করে দেয়। সেই আইন অনুসারে ১০ মে-র আগে ধানের বীজ বপন নিষিদ্ধ করা হয়। ভূগর্ভস্থ জল সংরক্ষণের জন্য আইনটির প্রয়োজন হয়েছিল। আইনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ সিংহ বাদলের নেতৃত্বাধীন সরকার জানিয়েছিল ১০ জুন নাগাদ ভূপৃষ্ঠের সমস্ত জল বাষ্পীভূত হয়ে আবহমণ্ডলে মিশে যাওয়ার পর বীজতলা থেকে ধানের চারা তুলে নিয়ে খেতে রোপণ করলে জলের ব্যবহার কমবে। তত দিনে বর্ষাও শুরু হয়ে যাবে। ফলে ভূগর্ভের জল কম ব্যবহার হবে।

হরিয়ানা সরকারও একই সময় এই রকমের একটা আইন প্রণয়ন করে। অর্থাৎ, ধানের বীজ বপন এবং বীজতলা থেকে ধানের চারা রোপণের প্রচলিত সময় প্রায় এক মাস পিছিয়ে দেওয়া হল। ফলত, ধান কাটার সময়ও প্রায় এক মাস পিছিয়ে গেল। এখান থেকেই সমস্যার সূচনা। গ্রীষ্মের ফসল ধান কাটার পর শীতের শস্য গমের বীজ বপনের সময় এসে যায়। আগে কাটা ধানের গোড়া যা চলতি কথায় ‘নাড়া’ বলে পরিচিত, জমিতে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে পচে গিয়ে জমি উর্বর করতে সাহায্য করত। শেষ বর্ষার হালকা বর্ষণে নাড়া পচার কাজটি বিনা শ্রম এবং পারিশ্রমিকে সম্পন্ন হত। পরিবেশ দূষণের কোনও সুযোগ ছিল না। কিন্তু সমগ্র প্রক্রিয়া এক মাস পিছিয়ে যাওয়ায় গম চাষের জন্য জমি তৈরি করার সময় কমে গেল। তখনই চালু হল নাড়া পোড়ানোর ব্যবস্থা। হেমন্তের শিশির ভেজা আবহাওয়ায় সূর্যের দক্ষিণায়ন শুরু হয়ে যাওয়ায় রোদের ঝাঁঝ কমে আসে, দিন ছোট হয়ে রাতের সময় বেড়ে যায়, সেই মরসুমে পাইকারি হারে এমন নাড়া পোড়ার বন্দোবস্ত হলে সে ধোঁয়া যাবে কোথায়? বাতাসের গতি তখন স্তিমিত। যেটুকু আসে, উত্তর-পশ্চিম দিক থেকেই আসে। ফলাফল— ধোঁয়াশায় অবরুদ্ধ দিল্লির আকাশ-বাতাসে প্রতি দিন যুক্ত হয় রাজধানীর দিকে ধেয়ে আসা নাড়া পোড়া ধোঁয়া।

দিল্লির দূষণ এখন আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনাম। দেওয়ালির রেশ না কাটতেই দিল্লি দূষণে আক্রান্ত। শীতের কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়তে না পড়তেই দূষণের দাপট আরও বাড়তে থাকে। দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকার নিয়মমাফিক পদক্ষেপ করে। কখনও জারি হয় আতশবাজির উপর নিষেধাজ্ঞা। কখনও যান নিয়ন্ত্রণ। বিনামূল্যে বিতরিত হয় দূষণ প্রতিরোধক মাস্ক। দূষণের তীব্রতা আরও বেড়ে গেলে স্কুলে ছুটি ঘোষণা করা হয়। আদালতে হাজির হয়ে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলি সরকারের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপের আবেদন করে। রীতিমতো ওকালতনামা দিয়ে সরকার কবুল করে দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে চব্বিশ ঘণ্টা কাজ চলছে। একই সঙ্গে পেশ করা হয় কাজের তালিকা। দিনের শেষে কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় না।

আবাসন শিল্পে যতই ভাটার টান আসুক, গৃহনির্মাণ দিল্লির সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং লাভজনক শিল্প। বৈধ এবং অবৈধ পন্থায় নতুন বাড়িঘর তৈরি, পুরনো বাড়ি ভেঙে আবার নতুন করে নির্মাণ এবং বাড়িঘরের আধুনিকীকরণ সারা বছর চলতে থাকে। ফলে সর্বত্রই সারা ক্ষণ ধুলো উড়ছে। বাইরে থেকে আসা ধোঁয়াশায় মিশে গিয়ে এই সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা আবহাওয়াকে আরও দূষিত করছে। ঘনবসতিপূর্ণ শহরে আকাশছোঁয়া বাড়ির সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। অভিজাত এলাকা হোক বা গরিব মহল্লা— চূড়ান্ত বিচারে পুরোটাই কংক্রিটের জঙ্গল। ধোঁয়া বেরিয়ে যাওয়ার পথ নেই। শব্দবাজি নিষিদ্ধ। কিন্তু যে বাজিতে আগুন ধরিয়ে দিলে আকাশে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ে, সেগুলি পোড়ানোর পর বাতাসে ভেসে বেড়ানো গ্যাস নিশ্চয়ই স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নয়। সব মিলিয়ে দেওয়ালি উদ্‌যাপনের লগ্নে দিল্লি এবং লাগোয়া গুরুগ্রাম, নয়ডা, ফরিদাবাদ, গাজ়িয়াবাদে বিরাজ করতে শুরু করে এমন এক আবহাওয়া, যা নিয়ে আসে শ্বাসরোধের পরিস্থিতি। তার উপর গণপরিবহণগুলি বাধ্যতামূলক ভাবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে। কিছু কিছু ব্যক্তিগত গাড়িও জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস বেছে নেয়। কিন্তু তার বাইরে! মেট্রোর ভাড়া অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাওয়ায় ব্যক্তিগত দু’চাকা এবং চার চাকার ব্যবহার অনেক বেড়েছে। দিল্লি সরকারের উদ্যোগে সাময়িক ভাবে রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রিত করে দূষণের মাত্রা কিছুটা কমানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু টোটকা দিয়ে কি স্থায়ী ক্ষত নিরাময় করা যায়? হরিয়ানা স্পেস অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার ২০১৮-র ৪ নভেম্বর জানিয়েছে যে, উপগ্রহের ছবি অনুসারে পঞ্জাবের বত্রিশ হাজারেরও বেশি এলাকায় নাড়া পোড়ানোর কাজ চালু রয়েছে।

পঞ্জাব-হরিয়ানায় ভূগর্ভের জল সংরক্ষিত রাখার জন্য চাষের সময়সূচি বদলে কতটুকু লাভ হয়েছে? এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট পত্রিকায় প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পঞ্জাবে আইন প্রয়োগের আগে বছরে ০.৯ মিটার ভূগর্ভের জল নেমে যেত। আর চাষের সময়সূচি বদলের পর বছরে ০.৭ মিটার ভূগর্ভের জল নেমে যাচ্ছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন বছরে ০.২ মিটার ভূগর্ভের জলের সাশ্রয়ের ফলে পরিবেশের কতটা উপকার হচ্ছে। কিন্তু বায়ুদূষণের জন্য দিল্লি এবং পারিপার্শ্বিক এলাকার আড়াই কোটিরও বেশি মানুষের জীবন যে ভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে, তার হিসাব কে কষবে? রাজ্য সরকারগুলি অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দায়মুক্ত হয়। ভারত সরকার বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দেয় সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলিকে এর প্রতিকার করতে হবে।

দিনের শেষে শ্বাসকষ্টে জর্জরিত নাগরিকদের ডাক্তার-হাসপাতালের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া অন্য পথ খোলা থাকে না। অথচ, এর স্থায়ী প্রতিকার কী করে করা যায় সে বিষয়ে সকলেই নীরব।

অন্য বিষয়গুলি:

Air pollution Delhi Pollution Environmental degradation Farming Crop Damage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy