প্রতীকী ছবি।
৪০ বছর আগে শেয়ার বাজারে দেশের ৩০টি বৃহত্তম বাণিজ্য সংস্থার নথিভুক্ত কোম্পানিগুলির মোট মূল্য ছিল ৬,২০০ কোটি টাকা। সেই সময় মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ছিল আজকের চাইতে ২৮ গুণ বেশি (১.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা) মূল্যের। বেশির ভাগ কোম্পানিই ছিল চট, চা, সিমেন্ট, চিনি, ইস্পাত, বস্ত্রবয়ন ধাঁচের ‘প্রাথমিক উৎপাদনের (প্রাইমারি ম্যানুফ্যাকচারিং) সঙ্গে যুক্ত। তার পর থেকেই বিষয়টার মধ্যে একটা নাটকীয় পরিবর্তন দেখা যায়। জাতীয় শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত কোম্পানিগুলির সম্মিলিত মূল্য আজকে মেরেকেটে জিডিপি-র থেকে ১৫ শতাংশ বেশি। গত বছর তা ছিল ১৯৭ লক্ষ কোটি টাকা।
আশ্চর্যজনক ভাবে, সেই সময়ে ‘বৃহৎ একচেটিয়া’ বাণিজ্য সংস্থাগুলির (এখনকার প্রেক্ষিতে দেখলে যাদের খুবই ছোট মনে হবে) ক্ষমতা ছিল উত্তপ্ত রাজনৈতিক আলোচনার রসদ। সে তুলনায় এখন এ সব কোম্পানির মাধ্যমে সম্পদ বাড়ানোর ব্যাপারটা রীতিমতো উদ্যাপনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত, শেয়ার বাজার আর মিউচুয়াল ফান্ডগুলির কারণে। এই সব কারণেই ‘বিজনেস মিডিয়া’ অনেক বেশি সোচ্চার এবং এই কারণেই বণিকপ্রভুদের দ্বারা রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টা এখন আর আলোচনার থাকে না। পুঁজির এই আইনি বৈধতা প্রাপ্তি (এবং সম্ভবত রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পুঁজিরও) খুব ধীরে ধীরে এবং ধাপে ধাপে ঘটেছে। সবচেয়ে আগে রাষ্ট্রীয় পুঁজি থেকে সরে আসা শুরু হয়েছিল। আটের দশকে সম্ভবত শেষ বারের জন্য ব্যাঙ্ক, মুম্বইয়ের (তৎকালীন বম্বে) বয়নশিল্প, কলকাতার ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের মতো সংস্থাগুলির জাতীয়করণ ঘটে। কিন্তু তার ফল দাঁড়ায় শোচনীয়। আট এভং ন’য়ের দশকগুলি ছিল বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে নিরন্তর বিতর্কের কাল। সেই বিতর্কে জাতীয় রাজনীতিও জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, অম্বানী এবং পাশাপাশি আদানি গোষ্ঠীর প্রবল উত্থান ঘটেছে। তারা এবং তাদের মতো অন্য গোষ্ঠীগুলি সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করে তোলে। যাবতীয় সমালোচনা বিফলে যায়।
ইতিমধ্যে লাইসেন্স বাতিলকরণ, নতুন বাণিজ্যক্ষেত্রগুলিতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের প্রবেশাধিকার দান, বিদেশ থেকে লগ্নীকরণ জাতীয় কিছু সংস্কার দেখা যেতে থাকে। যা নিয়ে বেসরকারি ক্ষেত্রগুলিতে বেশ আলোড়ন দেখা দেয়। মফতলাল, খৈতান, থাপার, মোদী, সারাভাইদের মতো গোষ্ঠীগুলি এই রদবদলে নিজেদের খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়। তাদের শূন্যস্থান দখল করে বাণিজ্য জগতের নতুন তারকারা। তাদের জায়গায় দেখা দিতে শুরু করে নতুন প্রযুক্তি পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা বা ওষুধ ও মোটরগাড়ি নির্মাণকারী সংস্থারা। শেয়ার বাজারের এখনকার গতিপ্রকৃতিতেও এই পরিবর্তনের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। ৫০টি নিফটি সূচকের অন্তর্ভুক্ত ৫০টি কোম্পানির শেয়ারের মধ্যে ১১টিই হল লগ্নি পরিষেবার, ছ’টি গাড়ি নির্মাণ সংস্থার, পাঁচটি তথ্যপ্রযুক্তির এবং চারটি ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার। যেখানে মাত্র সাতটি শক্তি উৎপাদনকারী সরকারি সংস্থার। গাড়ি নির্মাণ শিল্পের বাইরে অন্যান্য নির্মাণ শিল্পগুলির মুখ চোখে না পড়ার মতোই। খুব কম সংখ্যক বহুমুখী বণিক গোষ্ঠীই টিকে থেকেছে। নিফটিতে দেখা যায় টাটা (চারটি কোম্পানি), বিড়লা (দু’টি), অম্বানী (একটি) এবং আদানি (একটি)-র মতো মুখ। ১৯৮১-র তুলনায় ছবিটা একেবারেই আলাদা।
কিন্তু যেখানে নিফটি ৫০-এ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, সেই সঙ্গেই দেখা যাচ্ছে কোন বিষয়টা অনুপস্থিত। অনুপস্থিত বর্গের মধ্যে এক দিকে রয়েছে কম পুঁজির উৎপাদন এবং অন্য দিকে জার্মানির ‘ড্যাক্স ৩০’ (বিএএসএফ, ডেমলার, সিমেন্স) অথবা ফরাসি ‘সিএসি ৪০’ (এলভিএমএইচ বা হার্মেস-এর মতো বিলাস সামগ্রী সরবরাহকারী সংস্থা ব্যতিরেকে এয়ারবাস, শ্নেইডার এবং থালেস)-এর মতো সূচকে আধিপত্য বিস্তারকারী সংস্থা। নিফটি-তে কিন্তু আমেরিকায় নাসডাক সূচকে এগিয়ে থাকা, নতুন ভাবে বিশ্বকে আবিষ্কার করা আধুনিক প্রযুক্তির খিলাড়িরাও অনুপস্থিত। উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে ব্রিটেন আর সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেনি। তার এফটিএসই ১০০ সূচকে লগ্নি সংস্থা, কনজিউমার ব্র্যান্ড এবং খুচরো ব্যবসার দিকে ঝোঁকার প্রবণতা লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। তুলনায় শক্তি ও ওষুধ উৎপাদনের স্থায়িত্ব ছিল প্রাথমিক স্তরের। আমেরিকার পরেই ‘পশ্চিমি’ বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জাপান তার নিক্কেই ২২৫ সূচকে বৃহত্তর জায়গা নিয়ে অবস্থান করছিল। ব্যাপারটাকে পাঁচমিশেলিও বলা যায়। সে দিক থেকে দেখলে চিন তার ইন্টারনেট-ভিত্তিক এবং দ্রুতগামী রেলশিল্পের উপর ভর করে মানোন্নয়নের সিঁড়িতে সবে চড়তে শুরু করেছে। লগ্নি, নির্মাণ শিল্প, ওষুধ ও গাড়ি তৈরির শিল্পে ‘সাংহাই কম্পোজিট’-এর অংশীদারিত্বও চোখে পড়ার মতো। ফক্সকন-এর মতো চুক্তিভিত্তিক নির্মাণ সংস্থার ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়।
যখন শেয়ার বাজারের সূচকগুলি পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে তুলে ধরছে, তার মধ্যে কিন্তু সম্পূর্ণ ছবিটা নেই। অংশত হুয়েন্ডাই বা কোকাকোলার মতো বিদেশি মালিকানাধীন সংস্থা বা তালিকাবহির্ভূত সংস্থাগুলিকে এতে ধরা হয়নি। ইতিমধ্যে ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’-এর ১০০০টি বৃহৎ সংস্থার তালিকায় (তালিকাটি বিক্রয়ের পরিংখ্যানের উপরে নির্ভর করে তৈরি। শেয়ার বাজারের দরের উপরে নয়) রয়েছে পুঁজিভিত্তিক পণ্য, পোশাক এবং বয়নশিল্প, গাড়ির আনুষঙ্গিক উৎপাদন, ইস্পাত, ওষুধপত্র ও সফটঅয়্যার প্রযুক্তি। পোশাক-বয়ন শিল্পের সর্ববৃহৎ সংস্থা (অরবিন্দ মিলস) কিন্তু রয়েছে এই তালিকার ১৪৮ নম্বরে। এর বার্ষিক বিক্রির পরিসংখ্যান ৭,৩৬০ কোটি টাকা। আলাদা ক্যাটিগরি হিসেবে হার্ডওয়্যার শিল্পের অস্তিত্বই নেই। নতুন আবিষ্কার-ভিত্তিক সংস্থাগুলির বেশির ভাগই কিন্তু প্রযুক্তিভিত্তিক পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা, সেটা মনে রাখা প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy