গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।
আগামী সপ্তাহে নরসিংহ রাও সরকারের কার্যভার গ্রহণের তিন দশক পূর্ণ হচ্ছে। তাঁর সরকারই ভারতীয় অর্থনীতিতে ভিত্তিগত সংস্কার এনেছিল। যা দেশের অর্থনীতির লক্ষণীয় দিক পরিবর্তন ঘটিয়ে অর্থনীতিকে নতুন গতি আর ছন্দ দিয়েছিল। বিগত তিন দশকে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অংশ ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১.১ শতাংশ থেকে বেড়ে ভারতের অংশ ৩.৩ শতাংশে পৌঁছেছে। সাম্প্রতিক নিরিখে আমেরিকান ডলার অর্থনীতির বৃদ্ধি ১১ গুণ। কেবল মাত্র চিন এবং ভিয়েতনাম কিছুটা ভাল অবস্থায় রয়েছে। মানবিক উন্নয়নের প্রধান সূচকগুলির (মূলত আয়ুসীমা এবং শিক্ষা) দিক থেকে ভারত সে সব দেশের থেকে সামান্য ভাল অবস্থানে রয়েছে, যে দেশগুলিকে ‘মধ্যমানের উন্নয়ন’-এর পংক্তিতে রাখা হয়। এক সময়ের দ্বাদশ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ছিল ভারত। আশা করা হচ্ছে এ বছরে ভারত বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
পিছনে তাকিয়ে গত তিন দশকে অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে ভারতের অবস্থান অনেকটা উৎসাহব্যঞ্জক বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, কোন কাজটা বেশি প্রয়োজনীয় ছিল বা কোন বিষয়গুলির বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল। এ দেশে গত তিন দশকে জনসংখ্যার বিপুল অংশকে দারিদ্ররেখার ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। তবুও আফ্রিকার বাইরে এশিয়া মহাদেশে গণদারিদ্রের তালিকায় বেশ উপরের দিকেই রয়েছে ভারত। মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের ১৯৯০ সালের হিসেব মোতাবেক ১৫০টি দেশের মধ্যে ৯০ শতাংশ ভারতের চেয়ে ভাল অবস্থায় রয়েছে। এই মুহূর্তে ১৯৫টি দেশের মধ্যে ৭৫ শতাংশ দেশ ভারতের থেকে ভাল অবস্থায় আছে। বিশ্বের গড় মাথাপিছু আয়ের এক-পঞ্চমাংশেরও কম এ দেশের মাথাপিছু গড় আয়। অর্থনৈতিক বৈষম্য নিশ্চিত ভাবে বেড়েছে। কিন্তু ২০১১ সালের পর থেকে এ বিষয়ে কোনও নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
গত ৩০ বছরের অর্থনীতির যাত্রার কাহিনিটি চড়াই-উৎরাইহীন নয়। তৃতীয় দশক (২০১১-’২১)-এর তুলনায় প্রথম দু’টি দশকে অর্থনীতির ছবিটা বেশ আশাব্যঞ্জক ছিল। তখন ভারতের নিরিখে পিছিয়ে থাকা অনেক দেশই কিন্তু এখন এগিয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ এমনকি, ফিলিপিন্সও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে শামিল। চিন বা ভিয়েতনামের কথা বাদই দিলাম। ২০১১-’২১ পর্বের লাতিন আমেরিকার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)-র ক্রমাবনতির সঙ্গে বা সাহারা মরুর দক্ষিণে অবস্থিত আফ্রিকান দেশগুলির সঙ্কটের সঙ্গে এবং এমনকি, ‘আসিয়ান-৫’ হিসেবে পরিচিত (ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, সিঙ্গাপুর এবং তাইল্যান্ড) দেশগুলির ক্রমাবনমনের সঙ্গে তুলনা করলে ভারতের আর্থিক অগ্রগতির ছবিটা ভাল বলেই বোধ হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ২০০১ সালে ভারতের জিডিপি ছিল চিনের জিডিপি-র ৩৭ শতাংশ। দু’দশক পর সংখ্যাটা নেমে আসে ১৮ শতাংশে। বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অবদানকে আন্তর্জাতিক স্তরে তোল্লাই দেওয়া হলেও তা চিনের শক্তির পাশে দাঁড়ালে নিতান্ত বামনাকার বলেই মনে হবে।
২০১১-পরবর্তী বছরগুলোয় অর্থনীতির তুলনামুলক শিথিল অবস্থা থেকে গতিময়তা লাভ করা এমনিতেই যথেষ্ট কঠিন ছিল। কিন্তু অতিমারি এসে যাবতীয় সম্ভাবনাকে বিনষ্ট তো করলই, পাশাপাশি অর্থনৈতিক অগ্রগতির সামনে মাথাচাড়া দেওয়া বাধাগুলিও বিপুলাকার করে তুলল। কর্মনিযুক্তি ইতিমধ্যেই ব্যর্থতার একটি ক্ষেত্রে পর্যবসিত। গত দু’বছরের তুলনায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ দারিদ্রে ডুবেছেন। সেই সঙ্গে ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক উদ্যোগ পাকাপাকি ভাবে ঝাঁপ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। অর্থনীতির মধ্যে বৈষম্য আরও বেশিমাত্রায় দেখা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন উৎপাদনশীলতার উজ্জীবন এবং অধিকতর পরিচ্ছন্ন পরিকাঠামো। নরেন্দ্র মোদী সরকার বাহ্যিক পরিকাঠামোর দিকে নজর বেশি দিয়েছে। তুলনায় জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি শিকেয় তুলেছে। অথচ একই সঙ্গে দুইয়েরই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু মানবসম্পদের মানোন্নয়নের ব্যাপারে যে অভিঘাতপূর্ণ পদক্ষেপের প্রয়োজন ছিল তার কোনও বিকল্প তৈরি করা যায়নি। এই মানবসম্পদের বিষয়টি অর্ধ শতাব্দী আগে পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ভিত্তি ছিল। যখন ‘পাঁচ ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলার অর্থনীতির’ লক্ষ্যের কথা উঠে এল, তখন দ্বিগুণ দ্রুত সময়ের মধ্যে সাক্ষরতাকে ৭৪ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশে পরিণত করার কথা ওঠেনি বা দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবা পরিকাঠামোর গুণগত উন্নতির কথা বলা হয়নি। বরং অতিমারির সবচেয়ে ভয়াবহ রূপটির দিকে দেশকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
একটা যথাযথ ভাবে ক্রিয়াশীল অর্থব্যবস্থা এবং সব রকম ঋণগ্রস্ত মানুষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে গড়ে তোলা পরিকাঠামো এখনও নেই। ঋণদাতাদের কাছে ঋণ ফেরত আসার একমাত্র উপায় হিসেবে আছে দেউলিয়া ঘোষণার মতো উপায়, যাকে ব্যঙ্গার্থে এক মাত্র ‘আশার আলো’ বলা যায়। আসলে সেটা এক সর্বনাশা উপায়। ছোট ও মাঝারি ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে হলে ঋণব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস এই মুহূর্তে অবশ্যপ্রয়োজনীয়। বাণিজ্যকে ডুবিয়ে অর্থনীতি বাঁচতে পারে না। কিন্তু এই মুহূর্তে অর্থনীতি এবং জনকল্যাণ— উভয় দিক থেকেই সবচেয়ে জরুরি মানুষের হাতে কাজের জোগান অব্যাহত রাখা। শ্রমনিবিড় পরিকল্পনা গ্রহণ। গত ৩০ বছরে এ সব করা হয়নি। তার আগের ৩০ বছরেও যে হয়েছে, তা-ও নয়। আগামী ৩০ বছরের ভবিষ্যৎ কিন্তু ঝুলে রয়েছে এই বিষয়টির উপরেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy