Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
সন্ত্রাস দিয়েই ভোটে জয়?
Election

গণতন্ত্রের ভিত মজবুত হলে নির্বাচনী হিংসার ঘটনা কমে

ধর্ম, জাতপাত বা বর্ণভিত্তিক দাঙ্গার ফলে ভোটের ধরন বদলাতে পারে কি না, সে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে ভারতে এবং আমেরিকাতেও।

অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২১ ০১:৩০
Share: Save:

নির্বাচনের ঘণ্টা ঠিকঠাক বাজার আগেই অনুষঙ্গ হিসেবে হাজির প্রাক্-নির্বাচনী সন্ত্রাস। যে রকম হাড্ডাহাড্ডি আবহে এ বারের নির্বাচনটা হতে চলেছে, তাতে আরও খানিক হিংসা ও খুন-জখমের আশঙ্কা হয়তো থেকেই যায়। নির্বাচনী হিংসার বহুবিধ ঘটনার কোনটার পিছনে কে বা কারা, তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক তরজা ও মিডিয়ার প্রচারে জনগণের তালগোল পাকিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। এগুলোর কোনটা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফল বা ক্ষমতা দখলের প্রকাশভঙ্গি, বা কোনটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার রূপ বা কোনও দলের নিচু তলার অন্তর্দ্বন্দ্বের ফসল, কোনটা আবার একেবারেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন আর্থিক স্বার্থের লড়াই, তা সার্বিক ভাবে বোঝা অসম্ভব। উত্তরগুলিও হয়তো বদলে বদলে যায়। আসলে ভোটের আগে, ভোটের সময় এবং ভোটের পরের ‘বদলা’কে ধরে নির্বাচনী সন্ত্রাসের সার্বিক চালচিত্র তো সুবিস্তৃত। আবার, কেবলমাত্র রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বা নিরীহ ভোটারই নয়, কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যে দ্বিশতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা মহা-মনীষীর মূর্তিকেও নির্বাচনী সন্ত্রাসের শিকার হতে হয়!

নিক চিজ়্‌মান আর ব্রায়ান ক্লাস-এর ২০১৮-র বই হাউ টু রিগ অ্যান ইলেকশন জমিয়ে ব্যাখ্যা করেছে এ গ্রহের কোনায় কোনায় নির্বাচনের দখল নেওয়ার প্রচলিত পদ্ধতিসমূহ, এবং বিশ্ব জুড়ে তার অনুশীলনের ইতিবৃত্ত। ‘হিংসা’ এ ক্ষেত্রে এক রাজনৈতিক কৌশলমাত্র। ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’-এর এক সুপ্রযুক্ত মাধ্যম। ‘ন্যাশনাল ইলেকশনস অ্যাক্রস ডেমোক্র্যাসি অ্যান্ড অটোক্র্যাসি’-র তথ্যভান্ডার অনুসারে, ২০১২-১৬ সময়সীমায় যেখানে ইউরোপে নির্বাচনী সন্ত্রাস প্রায় বিরল, লাতিন আমেরিকায় তা দেখা গিয়েছে ১৮% নির্বাচনে, এশিয়াতে ৩৯% নির্বাচনে, পশ্চিম এশিয়ায় এবং সাহারা মরুভূমির দক্ষিণবর্তী আফ্রিকাতে ৩৮%, আর সোভিয়েট ভেঙে তৈরি হওয়া দেশগুলিতে ৪৭%। স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনী সন্ত্রাসের রূপরেখা অবশ্য গণতন্ত্রের তুলনায় খানিকটা ভিন্ন। কোনও দেশে গণতন্ত্রের ভিত যত মজবুত হবে এবং সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ যত দৃঢ় হবে, নির্বাচনী সন্ত্রাস ততই কমবে, এটাও স্বাভাবিক।

বিশ্বে বহুদলীয় গণতন্ত্রগুলিতে নির্বাচনী হিংসা অনেকটাই যেন স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। অনেক সময়েই ছোটখাটো হিংসার ঘটনাগুলি খবরের শিরোনামে আসে না। দেশবিদেশে প্রচারও পায় না। কিন্তু সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাছে এই নির্বাচনগুলি অনেক সময়েই যথেষ্ট চাপ এবং উদ্বেগের। এমনকি পশ্চিমি দুনিয়াও এই নির্বাচনী সন্ত্রাসের বাইরে নয়। আমেরিকার এ বারের নির্বাচনটাই নানা সন্ত্রাস আর দাঙ্গার সাক্ষী। ডেট্রয়েট, পোর্টল্যান্ড, নিউ ইয়র্ক, কোথায় নয়!

‘হিংসা’ অনেক ক্ষেত্রেই নির্বাচনে কারসাজির একটা কার্যকর উপায়। নাইজিরিয়া বা মেক্সিকোর মতো দেশের অভিজ্ঞতা বলে, নির্বাচনী হিংসার শিকার হওয়া মানুষরা, এমনকি হিংসা-বিধ্বস্ত অঞ্চলের অন্য ভোটাররাও ভোট দিতে আগ্রহী হন কম। তাৎক্ষণিক ভাবে তাই কমে যেতে পারে মোট ভোটদানের হার। বিপক্ষের ভোট রুখতে সন্ত্রাসকে তাই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় অনেক ক্ষেত্রেই। একটা উল্লেখযোগ্য গবেষণা দেখেছি উগান্ডার পরিপ্রেক্ষিতে, আমেরিকান পলিটিক্যাল সায়েন্স রিভিউ-এ ২০০৯ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে। দু’দশক আগে নির্বাচনী সন্ত্রাসের শিকার হওয়া মানুষদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের উৎসাহ ও পরিমাণ বেড়েছে বর্তমানে, অর্থাৎ কুড়ি বছর পরে। নির্বাচনী সন্ত্রাসের দীর্ঘকালীন প্রভাব তাই অনেকটাই অস্পষ্ট, বিস্তৃত গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে নিশ্চয়ই।

ধর্ম, জাতপাত বা বর্ণভিত্তিক দাঙ্গার ফলে ভোটের ধরন বদলাতে পারে কি না, সে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে ভারতে এবং আমেরিকাতেও। দাঙ্গার ফলে কারও ভোট বাড়তে পারে, কমতে পারে অন্য কারও। যেমন, ১৯৬৮-তে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের হত্যার পরে কৃষ্ণাঙ্গদের আন্দোলন, দাঙ্গা ও কার্ফুতে অশান্ত হয়ে ওঠে আমেরিকা। সেই আবহের মধ্যেই হয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ওমর ওয়াসো-র গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ১৯৬৮-র নির্বাচনে অস্থিরতায় প্রভাবিত কাউন্টিগুলিতে রিপাবলিকান প্রার্থী রিচার্ড নিক্সনের ভোট কিন্তু বেড়েছিল ৬-৮%।

তাই শুধুমাত্র ভোট শতাংশই নয়, ভোটের প্রেক্ষাপটে হিংসার আবহ ভোটদাতাদের নির্বাচনী পছন্দ-অপছন্দকে কী ভাবে তাৎক্ষণিক ভাবে প্রভাবিত করে, সেটাও এক গুরুত্বপূর্ণ সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয়বস্তু। সাধারণ ভোটার থেকে রাজনৈতিক দল, সবারই এটা বোঝা জরুরি। ভারতের প্রেক্ষিতে এ বিষয়ে কোনও বিস্তারিত গবেষণা হয়ে থাকলেও তা আমার নজর এড়িয়েছে। নির্বাচনী সন্ত্রাসের ফলে সন্ত্রাসকারীরা সুবিধা পায়, অনেকের এমন প্রচলিত ধারণা থাকলেও কেনিয়াতে ২০১৩-র ডিসেম্বরে ১২১০ জন ভোটারের উপরে দেশজোড়া এক প্রতিনিধিত্বমূলক সমীক্ষা-ভিত্তিক গবেষণার ফলাফল কিন্তু একেবারে উল্টো। এই সমীক্ষায় উত্তরদাতাদের এক কল্পিত পরিস্থিতি দেওয়া হয়— ধরা যাক, তাঁদের নির্বাচনকেন্দ্রে সাংসদ পদ শূন্য হয়েছে, এবং সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন দু’জন প্রার্থী, যাঁদের যোগ্যতা, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা এবং প্রতিশ্রুতির বহর তুল্যমূল্য। ভোটাররা কাকে ভোট দেবেন? দেখা গেল, এ ক্ষেত্রে ৮৭% উত্তরদাতা প্রার্থীদের জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে ভোট দিতে চেয়েছেন। মোট উত্তরদাতার ৭০% ভোট দিয়েছেন আগের নির্বাচনের মতোই, রাজনৈতিক বিশ্বাস অনুযায়ী। এর পরই এই ১২১০ জনকে কোনও এক প্রার্থী সম্পর্কে নির্বাচনী হিংসা ছড়ানোর গল্প বলা হয়, এবং তাঁদের আবার ভোট দিতে বলা হয়। নির্বাচনী হিংসায় জড়িত থাকার গুজব আছে যে প্রার্থীর নামে, দ্বিতীয় ব্যালটে তাঁর ভোট কমে যায় ৯%। জাতপাত বা রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে যাঁরা ভোট দিয়েছিলেন আগের ব্যালটে, তাঁরাও সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত প্রার্থীর ভোট কমিয়েছেন অনেকখানি। ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় আফ্রিকার ২৫টি দেশের তথ্য একযোগে বিশ্লেষণেও উঠে এসেছে যে, হিংসার হুমকির ফলে ক্ষমতাসীনের পক্ষে ভোট কমেছে।

এ সব সত্ত্বেও দেশে-বিদেশে নির্বাচনী সন্ত্রাসে অভিযুক্ত দল বা প্রার্থী জিতে চলেছেন, এমন উদাহরণ প্রচুর। ভোটাররা যদি সত্যিই হিংসায় লিপ্ত রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে ভোট দেন, তবে এই প্রার্থীরা জেতেন কী ভাবে, সেটাও প্রশ্ন। আসলে ভোটের হিংসা হয়তো ভোট-শতাংশ খানিকটা কমিয়ে দিতে পারে, তবু প্রত্যেক দল বা প্রার্থীরই একটা নিজস্ব দৃঢ় সমর্থন-ভিত্তি থাকে, যাতে ফাটল ধরে না সহজে। সেই সঙ্গে নির্বাচকদের মধ্যে যাঁরা অতীতে নির্বাচনী হিংসার শিকার হয়েছেন, বা যাঁরা যথেষ্ট দারিদ্রের মধ্যে জীবনযাপন করেন, তাঁদের ভোটের ধরন নির্বাচনী হিংসার ফলে খুব একটা বদলায় না। বিশেষ করে যে প্রার্থী বা দলের দারিদ্রে প্রলেপ দেওয়ার অতীত রেকর্ড ভাল, তাঁদের ক্ষেত্রে তো নয়ই।

ভারতের ভোটাররাও হিংসাশ্রয়ীদের ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে অংশত কৃপণ কি না, অর্থাৎ কেনিয়ার বা আফ্রিকার ভোটারদের মানসিকতা ভারতেও প্রযোজ্য কি না, সে আরও জটিল সমাজতাত্ত্বিক প্রশ্ন। উত্তরটা যদি ‘হ্যাঁ’ও হয়, সে ক্ষেত্রেও অবশ্য ভোটের পরিসরে ‘সন্ত্রাসটা কে বা কারা করল’-র চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, কে বা কারা হিংসা ছড়াচ্ছে বলে বিশ্বাস করছেন সংশ্লিষ্ট জনগণের বেশির ভাগ। আর ভোটারদের মনে এই বিমূর্ত বিশ্বাস সঞ্চারিত করাটাও আজকের ভোটযুদ্ধের অংশ। ফেক নিউজ় আর পোস্ট ট্রুথের এই যুগে জনমত নির্মাণে এবং নিয়ন্ত্রণে সোশ্যাল মিডিয়া যে মোহজাল বিস্তার করে জাদুকাঠির মতো কাজ করে চলেছে নিরন্তর, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ভোটের কারচুপি নিয়ে চিজ়্‌মান ও ক্লাস-এর তথ্যপূর্ণ বইটিতে নির্বাচনী হিংসার পরের অধ্যায়টাই যে ‘হ্যাক দ্য ইলেকশন: ফেক নিউজ় অ্যান্ড দ্য ডিজিটাল ফ্রন্টিয়ার’, তাতে আর আশ্চর্য কী!

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

অন্য বিষয়গুলি:

Election Violence Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy