মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
দলের এক সেজো নেতার নাম ধরেই সতর্ক করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী, ভাঙড়ে ইনফোসিস-কে কেউ যাতে বিরক্ত না করে। কথাটির তাৎপর্য বহুবিধ। এক, এই বকুনির মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী স্বীকার করে নিলেন যে, এ রাজ্যে তাঁর দল শিল্পসংস্থাগুলিকে ‘বিরক্ত’ করেই থাকে। এতখানিই যে, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তাতে বিচলিত হন। তিনি নিশ্চয়ই জানেন, ইনফোসিস গোছের বড় সংস্থার চেয়েও অনেক বেশি হয়রানির শিকার হয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি মাপের সংস্থাগুলি। সেই হয়রানি যথাপূর্বং চলবে কি না, মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য সে বিষয়ে কিছু বলেননি। দুই, বিভিন্ন অঞ্চলে ‘তাজা ছেলে’দের এই সব দুষ্টুমিতে শিল্পমহল এতই বিরক্ত যে, পশ্চিমবঙ্গ তাদের কাছে পরিত্যাজ্য রাজ্য। সেই রাজ্যে ইনফোসিস-এর মতো প্রথম সারির তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার ক্যাম্পাস তৈরির কাজেও বিরক্ত করা হলে রাজ্যের বদনাম তীব্রতর হবে— মুখ্যমন্ত্রী এই কথাটি বুঝেছেন। তাঁর এই বোধোদয়কে স্বাগত জানানোই বিধেয়, কিন্তু বড় বেশি দেরি হয়ে গেল না কি? এ কথা ভুললে চলবে না যে, শিল্পমেধ যজ্ঞের মাধ্যমেই রাজ্যের মসনদে তিনি অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ফলে, ক্ষমতায় আসার পর শিল্প বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী হওয়া তাঁর দায়িত্ব ছিল— বাম আমলের শিল্পবিরোধী আবহাওয়ার কথা মাথায় রাখলে সে দায়িত্ব ছিল গুরুতর। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এত দিন ধারাবাহিক ভাবে সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। শিল্পমহলকে ‘বিরক্ত’ করার যে সংস্কৃতি পশ্চিমবঙ্গে সর্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী হয়েছে, তাঁর প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছাড়া তা সম্ভব ছিল না। নিজের ভুল যদি তিনি বুঝে থাকেন, তা হলে ভাল কথা— কিন্তু, বর্তমানে দলের দ্বিমেরু ক্ষমতাকাঠামোয় তাঁর এই বকুনির প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং বিধেয় কী, সেই সংশয়ও থাকছে।
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের তৃতীয় স্বীকারোক্তিটি হল, দলের উৎপাত থামানোর ক্ষমতা পুলিশের নেই— ভাঙড়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেজো নেতা যদি নিজে সংযত না হন, তবে তাঁকে থামানো পুলিশের পক্ষে অসম্ভব। এই স্বীকারোক্তিটি ভয়ঙ্কর। রাজ্যে কিছু দুষ্কৃতী থাকবে, তারা রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ব্যবহার করে অনৈতিক খাজনা আদায় করতে চাইবে, এমন পরিস্থিতি অবাঞ্ছিত হলেও অস্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক হল, পুলিশ ও প্রশাসন তাদের সেই কাজ করার অবাধ ছাড়পত্র দেয়। অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে শাসক দলের সঙ্গে থাকার প্রধানতম কারণ হল খাজনা আদায়ের অধিকার অর্জন করা। রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে যার যতটুকু ক্ষমতা সে ততখানি খাজনা আদায় করে; এবং দুর্জনে বলে যে, তার বখরা ঊর্ধ্বগামী। এই আর্থ-রাজনৈতিক কাঠামোয় পুলিশ সক্রিয় দোসরের ভূমিকা পালন করতে এমনই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে যে, শাসক দলের আশীর্বাদধন্য দুষ্কৃতীকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা তাদের কল্পনাতেও আর আসে না। অতএব, শুধু সেজো নেতাকে বকুনি দিলেই মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব ফুরোয় না; পুলিশকে নিজের কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়াও বিধেয়।
পশ্চিমবঙ্গ নামক শিল্পশ্মশানে যে কোনও শিল্পই অতি স্বাগত, কিন্তু তার মধ্যেও তথ্যপ্রযুক্তির গুরুত্ব সবিশেষ। প্রথমত, ভারতে তো বটেই, গোটা দুনিয়াতেই তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে বঙ্গসন্তানরা অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করছেন। ফলে, পশ্চিমবঙ্গে মানবসম্পদের অভাব নেই— কলকাতায় তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প বিকশিত হলে অনেক প্রবাসীই ঘরে ফিরতে চাইবেন। দ্বিতীয়ত, ভারতের বহু শিল্পই যেখানে এখনও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার যোগ্য নয়, সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি অতি ব্যতিক্রমী— এই ক্ষেত্রটিতে ভারত বিশ্বমঞ্চে অতি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে, এই শিল্পের ভবিষ্যৎ ইতিবাচক। তৃতীয়ত, এই শিল্পে জমির প্রয়োজন কম। পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের পথে বৃহত্তম বাধাটির নাম জমি। ফলে, তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে মনোনিবেশ করলে সেই বাধাটি কাটানো সম্ভব হবে। কিন্তু, এর কোনওটিই হবে কি না, তা নির্ভর করছে মুখ্যমন্ত্রী ও শাসক দলের সদিচ্ছার উপরে। বিরক্ত করার অভ্যাসটি এখনই ছাড়তে পারলে ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy