দলনায়ক: মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে যোগী আদিত্যনাথকে সংবর্ধনা জানাচ্ছেন ভারতীয় জনতা পার্টির সতীর্থরা। গোরক্ষপুর, ২৬ মার্চ। পিটিআই
আগরায় ফেরার পথে যে এমন ঝ়ঞ্ঝাটে পড়তে হবে, ভাবেননি আকবর। ১৫৬৭ সাল। পঞ্জাব থেকে রাজধানী ফিরছেন মুঘল সম্রাট। শিবির ফেলেছেন আম্বালার কাছে থানেশ্বরে। এখানেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হয়েছিল, জলাশয়টি পবিত্র তীর্থ। উপরন্তু এই রাতে চন্দ্রগ্রহণ। সন্ন্যাসীদের পাশাপাশি তাই ধনাঢ্য তীর্থযাত্রীরও বিরাম নেই।
ঝামেলা অন্যত্র। কিশু পুরী নামে এক সন্ন্যাসী প্রায় শ’তিনেক শিষ্যের একটি দল নিয়ে এসেছেন। তিনি সম্রাটের কাছে এসে জানালেন, দিঘির ধারে একটি বিশেষ জায়গায় বরাবর তাঁরা আশ্রয় নেন। এ বার যোগীরা সেই জায়গা দখল করে নিয়েছেন। অনুরোধ সত্ত্বেও উঠছেন না। নাথযোগীরা সংখ্যায় অনেক বেশি, প্রায় পাঁচশো। কিশু পুরী জানালেন, সংখ্যায় কম হলেও তাঁরা ইষ্টদেবতার নাম নিয়ে লড়ে যাবেন। হয় মৃত্যু, নয় নিজেদের জমি পুনরুদ্ধার।
যোগীরা এসে জানালেন অন্য কথা। জায়গাটা আসলে তাঁদেরই, কিন্তু পুরী সন্ন্যাসীরা গত কয়েক বছর ধরে উড়ে এসে জুড়ে বসেন। এ বার প্রাণ থাকতে তাঁরা মাটি ছাড়বেন না।
সম্রাট দুই তরফকে অনেকক্ষণ বোঝালেন, কিন্তু সব চেষ্টা নিষ্ফল। অতঃপর লড়াইয়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিলেন আকবর। আবুল ফজলের ‘আকবরনামা’ জানাচ্ছে, ‘মাঠের দুই প্রান্তে দুই দল লাইন করে দাঁড়াল। দু’দিক থেকেই তরবারি উঁচিয়ে এক জন রে রে করে ছুটে এল। তার পর তির, ধনুক, লাঠি, পাথর কিছুই বাকি থাকল না।’ ক্রমে একটা সময় পরিষ্কার হয়ে গেল, সংখ্যালঘু, দুর্বল কিশু পুরীরা হারছেন। আকবর তাঁর পদাতিক সেনাদের দুর্বলদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে ইঙ্গিত করলেন। যোগীরা এ বার পরাস্ত, তাঁদের নেতা আনন্দ কুরের ছিন্ন মুণ্ডটি রণক্ষেত্রের ধুলোয় পড়ে থাকল।
শুধু আবুল ফজল নয়, বদাউনি, নিজামুদ্দিন আহমেদ, অনেকেই ঘটনাটা লিখে গিয়েছেন। পরাজিত আনন্দ কুর নামে যোগীর পরিচয়ও অনেকে আঁচ করার চেষ্টা করেছেন। তখনকার ফার্সি হরফে কুর আর গির অনেকটা এক রকম। আনন্দ কুর তা হলে গুর বা গোরখক্ষেত্র থেকে আসা নাথযোগী নন তো? আদিত্যনাথ যতই হুঙ্কার ছাড়ুন, হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্য অন্য। মুসলমান সম্রাটকে সাক্ষী রেখে, সন্ন্যাসীরা নিজেদের মধ্যে মারপিট করবেন।
বিধর্মী আবুল ফজলদের লিখিত বয়ান পছন্দ না হলে অন্য গল্পও আছে। বারাণসীর বিখ্যাত বৈদান্তিক মধুসূদন সরস্বতী আকবরকে গিয়ে নালিশ জানালেন, রাস্তায় ফকিররা অযথা তাঁদের আক্রমণ করে। মুসলমান রাজত্ব, ফলে মুখ বুজে সব মেনে নিতে হয়। আকবর ভেবেচিন্তে বললেন, ‘এক কাজ করুন। অব্রাহ্মণের সংখ্যা তো অনেক। আপনারা তাঁদের সন্ন্যাসে দীক্ষা দিয়ে সশস্ত্র করে তুলুন।’ স্কটিশ মিশনারি ও প্রাচ্যতত্ত্ববিদ জে এন ফারকুয়ার এই গল্পটি ১৯২৫ সালে নানা আখড়া থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। এটি নাগা সন্ন্যাসীদের ওরাল ট্রাডিশন। লিখিত বা মৌখিক কোনও ঐতিহ্যেই তাই আকবরকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
প্রশ্ন হল, অব্রাহ্মণ সন্ন্যাসের অধিকার না পেলে যোগীজির এত রমরমা কোথায় থাকত? আদিত্যনাথ, তাঁর গুরু অবৈদ্যনাথ ও তস্য গুরু দিগ্বিজয়— গোরক্ষনাথ পীঠের এই তিন প্রজন্মের মহান্তই রাজপুত ক্ষত্রিয়, পূর্বাশ্রমে ঠাকুর। এই জাতপাতহীনতাই গোরক্ষনাথ-অনুসারী নাথ সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য। আদিত্যনাথ তাঁর পৃষ্ঠপোষক নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে রামমন্দিরের দাবি তুলতে পারেন, কিন্তু গোরক্ষনাথ স্বয়ং কবে রাম-সীতাকে পাত্তা দিলেন? তিনি তো শিবের অবতার, হঠযোগেই তাঁর সাধনা। ‘গোরক্ষ এ বার যোগীদের আকাঙ্ক্ষিত পরম অনুভূতির কথা বলবেন,’ গোছের কথাই পাওয়া যায় ‘গোরক্ষশতক’ বইয়ে।
এই ঐতিহ্যটি জানতে হবে। আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর দেখলাম, অনেকে গোরক্ষনাথ মন্দিরে গিয়ে চমৎকৃত— সেখানে ইঞ্জিনিয়ার থেকে উদ্যানকর্মী অনেকে মুসলমান। চমৎকৃতির কী আছে? গোরক্ষপুরের আশপাশে আজও ভিট্টি, মহেশপুর, রুদ্রপুর ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় গোরক্ষনাথের ভক্ত মুসলমান যোগীরা থাকেন। তাঁরা চাষবাস করেন, বাড়িতে কোরাণের পাশাপাশি রামায়ণ পাঠ করেন, সারেঙ্গি বাজিয়ে গোপীচাঁদের গান গাইতে থাকেন। বাংলার ময়মনসিংহের রাজা গোপীচাঁদ ও তাঁর মা ময়নামতী গোরক্ষনাথের শিষ্য ছিলেন। ব্রাহ্মণ্য জাতপাতের বিরুদ্ধে হিন্দু অন্ত্যজ সম্প্রদায় ও মুসলমান জোলা, যুগীদের হাত ধরেই ভারতে গোরক্ষনাথের ধর্ম ছড়িয়েছিল। উনিশ শতকের এক গেজেটিয়ারও জানাচ্ছে, ‘যোগীরা মাছ, পাঁঠার মাংস, শুয়োর, গরু সবই খান।’ গোরক্ষনাথের মোহান্ত আজ যদি কসাইখানা নিয়ে হইচই করেন, বুঝতে হবে তিনি শুধু বিজেপিতেই আছেন। স্বধর্মে নেই।
স্বধর্মটি কী? আদিত্যনাথের ছবিটি খুঁটিয়ে দেখলে দেখবেন, কানে কুণ্ডল। এটিই গোরক্ষনাথের যোগীদের বৈশিষ্ট্য, যে কারণে হিন্দিতে তাঁদের ‘কানফট যোগী’ বলে। কর্ণপটহ ফাটিয়ে সেখানে কুণ্ডল পরানো স্বয়ং শিবের অবদান। শিব এক বার পোকার বেশে পদ্মের মৃণালে নেমেছিলেন, তখন স্বামীর গায়ের ময়লা দিয়ে পার্বতী তৈরি করে রেখেছিলেন কুণ্ডল। ওই কুণ্ডল কানে পরেই শিব অমর যোগী। পরে যোগী মৎস্যেন্দ্রনাথকে তিনি কুণ্ডলটি দান করেন। এই মৎস্যেন্দ্রনাথেরই শিষ্য গোরক্ষনাথ। কর্ণপটহ ফাটানোর প্রক্রিয়াটি বিশদ। উবু হয়ে বসতে হয়, তার পর গুরু পৌনে এক ইঞ্চির একটি বাখারি এনে ‘ওম্ শিব গোরক্ষ’ মন্ত্র পাঠ করতে করতে দুই কানের তরুণাস্থি ফাটিয়ে ছিদ্র করে দেন। তার পর ৪০ দিন ধরে নিমের জলে জায়গাটি ভিজিয়ে রাখতে হয়। গুরুরা অহেতুক নিষ্ঠুর নন, কান ফাটানোর আগে বারংবার জিজ্ঞেস করে নেন, শিষ্য ঐহিক জীবন ত্যাগ করে সত্যিই যোগী হতে চান কি না। শিষ্য অরাজি থাকলে সে যাত্রা আর কান ফাটানো হয় না।
নাথযোগীরা বলেন, গোরক্ষনাথ তাঁর শিষ্য রাজা ভর্তৃহরির কান নিজে ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। দুই শিষ্যকে বলেছিলেন, তোমরাও আজ থেকে যোগী। পরস্পরের কান ফাটিয়ে দাও। সেই জায়গাটি হিংলাজ মন্দিরে যাওয়ার পথে, আপাতত পাকিস্তানে। হিংলাজ তীর্থে যাওয়াটা তাই যে কোনও নাথযোগীর স্বপ্ন। যোগীরা আজও এক রকমের ছোট ছোট সাদা পাথরকে মূল্য দেন, তার চলতি নাম ‘হিংলাজ কি ঠুমরা।’
আদিত্যনাথ কত দিনে পাকিস্তানের সেই পরম তীর্থে গিয়ে প্রণত হবেন, সেটাই দেখার!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy