Advertisement
১৩ জানুয়ারি ২০২৫
Cyber Crime Types

প্রতারণার রকমফের: ভয়, লোভ, বোকামি! এই তিন দুর্বলতাকে ঘিরেই সাইবার জালিয়াতির সমস্ত চক্রব্যূহ

কখনও ভয়, কখনও লোভ, কখনও কখনও নির্বুদ্ধিতা। প্রায় সব ধরনের সাইবার প্রতারণারই মূলে রয়েছে সাধারণ মানুষের এই তিন দুর্বলতা। ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে কী ভাবে তা কাজে লাগায় প্রতারকেরা? আজ চতুর্থ কিস্তি।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ। গ্রাফিক সহায়তা: এআই।

সৌম্যকান্তি সাহা
শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫ ০৭:৫৭
Share: Save:

নিত্যনতুন উপায়ে মানুষকে ফাঁদে ফেলছে সাইবার প্রতারকেরা। ভিন্ন ভিন্ন পন্থা। কৌশলও ভিন্ন। তবে সব ক্ষেত্রেই মূল ‘অস্ত্র’ একই— জনতার দুর্বলতা।

গত এক বছরে প্রচুর লোককে ঘায়েল করেছে ‘ডিজিটাল গ্রেফতার’। রাজ্যে রাজ্যে ঘুম উড়েছে সাইবার পুলিশের। তবে সাইবার জালিয়াতদের হাতে রয়েছে আরও অনেক অস্ত্র। যা নিয়ে সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞ, প্রাক্তন পুলিশকর্তা এবং রাজ্য পুলিশের সাইবার শাখার সঙ্গে কথা বলেছে আনন্দবাজার অনলাইন। উঠে এসেছে এমন বেশ কিছু অপরাধের কথা, যা নিয়ে ডিজিটাল গ্রেফতারের মতো আলোচনা হয়নি।

এক সময় ‘জামতাড়া গ্যাং’ নিয়ে বহু আলোচনা হত। এতটাই যে, নেটফ্লিক্সে ‘জামতাড়া’ বলে একটি ওয়েব সিরিজ়ও জনপ্রিয় হয়েছিল। মানুষকে ঠকিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতে সিদ্ধহস্ত ছিল সেই গ্যাং। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে প্রতারণার কৌশল। জামতাড়া গ্যাং বা সমসাময়িক প্রতারক দলগুলি এখনকার সাইবার অপরাধীদের মতো এতটা ‘সংগঠিত’ ছিল না। শিকার বাছাইয়ে জোর দেওয়া হত না। যাকে তারা নাগালে পেত, তাকেই ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করত। এখন সাইবার প্রতারণার চক্র শিকারকে টোপ গেলানোর আগে রেকি করে। জামতাড়ার তুলনায় এরা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, মানুষের তিন ধরনের দুর্বলতার সুযোগ নেয় আধুনিক সাইবার প্রতারকেরা— ভয়, লোভ এবং কখনও কখনও নির্বুদ্ধিতা। যাঁরা সাইবার প্রতারণার শিকার হচ্ছেন, তাঁরা এই তিন দুর্বলতার কোনও না কোনও একটির জন্যই ফাঁদে পড়ছেন।

অস্ত্র যখন নির্বুদ্ধিতা

ফাঁদ ১: রাজ্যের এক সরকারি আমলার সমাজমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট নকল করে একটি ভুয়ো অ্যাকাউন্ট তৈরি করেছিল প্রতারকেরা। সেখান থেকে তারা ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’ পাঠায় সাধারণ মানুষকে। পাঠানো হয় মেসেজও। বলা হয়, ওই আমলার পরিচিত এক আধাসেনা জওয়ান অন্যত্র বদলি হয়ে যাচ্ছেন। আসবাবপত্র বিক্রি করতে চান যৎসামান্য দামে। চাওয়া হয় মোবাইল নম্বর। সেই ‘ভুয়ো’ আধাসেনা জওয়ান হোয়াটস্অ্যাপে যোগাযোগ করে জলের দরে আসবাব কিনতে ইচ্ছুকদের। কিনতে রাজি হয়ে গেলে ফেলা হয় টোপ। জিনিসপত্র বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে গাড়িভাড়া বাবদে টাকাও পাঠাতে বলা হয়। বিষয়টি নজরে আসতেই ওই আমলা সমাজমাধ্যমেই সকলকে সতর্ক করেন।

ফাঁদ ২: বিভিন্ন বেকারি সংস্থার ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির নামে প্রতারণার ফাঁদ ঘুরছে অনলাইনে। বছর খানেক আগে এমনই একটি চক্রের সন্ধান পায় কলকাতা পুলিশ। কেক, পেস্ট্রি এবং মুখরোচক খাবার বিক্রির এক নামী সংস্থার নামে খোলা হয়েছিল ভুয়ো ওয়েবসাইট। সেখান থেকে চলত ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি দেওয়ার নামে প্রতারণা। নয়াদিল্লির লাগোয়া নয়ডাতেও এমন একটি চক্রের সন্ধান মেলে কয়েক বছর আগে। একটি সুপার মার্কেট সংস্থার ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি দেওয়ার নামে প্রতারণা করা হচ্ছিল।

ফাঁদ ৩: পুরীর হোটেল বুক করতে গিয়ে প্রচুর মানুষ প্রতারণার শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন হোটেলের নামে ভুয়ো ওয়েবসাইট খুলেছে সাইবার প্রতারকেরা। ওই ওয়েবসাইট থেকে বুকিং করলেই টাকা চলে যায় প্রতারকদের কাছে। শুধু পুরী নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জনপ্রিয় পর্যটনস্থলকেও কাজে লাগানো হচ্ছে। এই চক্র এখনও সক্রিয়। সম্প্রতি প্রয়াগরাজে পূর্ণকুম্ভ শুরুর আগেও বেশ কিছু ভুয়ো ওয়েবসাইট খোলা হয়।

ফাঁদ ৪: বেকারত্বের সুযোগ নিচ্ছে প্রতারকেরা। অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের চাকরির টোপ দেওয়া হচ্ছে। যোগাযোগ করলে বলা হচ্ছে, রেজিস্ট্রেশনের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পাঠাতে হবে। বিশ্বাস করে সেই টাকা পাঠিয়ে দিলেই তা চলে যাচ্ছে প্রতারকদের পকেটে।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

অস্ত্র যখন ভয়

ফাঁদ ১: বয়স্কদের পাশাপাশি অনেক তরুণ-তরুণীও ডিজিটাল প্রতারণার ফাঁদে পড়ছেন। পুলিশ বা ইডি-সিবিআইয়ের নাম শুনলে সাধারণত লোকে ভয় পান। সেই ভয়কেই কাজে লাগাচ্ছে প্রতারকেরা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে শিকারের অতীতও জেনে নিচ্ছে তারা। ফলে ভয় দেখানো আরও সহজ হয়ে যাচ্ছে। সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্যায়ের মতে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিকারকে সম্মোহিত করে ফেলছে প্রতারকেরা। ভয় দেখিয়ে পরিস্থিতি এমন করে দিচ্ছে যে, কারও ঠিক-ভুল বিবেচনার ক্ষমতাও থাকছে না। মাঝে মধ্যে ‘ট্রু কলার’-এর মতো অ্যাপেরও সাহায্য নিচ্ছে প্রতারকেরা। কোনও নম্বরকে পর পর অনেকে একই নামে ‘সেভ’ করলে ‘ট্রু কলার’-এও সেই নামটি ভেসে ওঠে। প্রতারকেরা অনেক সময় পুলিশ আধিকারিকের পরিচয়ে নম্বর ‘সেভ’ করাচ্ছে সাগরেদদের দিয়ে। ফলে ওই নম্বর থেকে শিকারের কাছে ফোন গেলে অ্যাপে দেখাচ্ছে ভুয়ো নামই।

ফাঁদ ২: শিকারকে বেছে তাঁর কোনও ‘আপত্তিকর’ ছবি সমাজমাধ্যমে ফাঁসের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। চাওয়া হচ্ছে টাকা। ছবি যে সব ক্ষেত্রে আসল, তা-ও নয়। প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সাইবার প্রতারকেরা অনেক সময় ‘ডিপফেক’ ছবি ব্যবহার করছে। আসল ছবি নয় জেনেও অনেকে মানসম্মানের ভয়ে টাকা দিয়ে দিচ্ছেন প্রতারকদের।

ফাঁদ ৩: অভিভাবকদের ফোন করে প্রতারকেরা বলছে, তাঁর সন্তান ধর্ষণ বা অন্য কোনও গুরুতর মামলায় ফেঁসে গিয়েছেন। মামলা মিটমাট করতে গেলে দাবিমতো টাকা দিতে হবে। আবার কখনও সন্তানদের ফোন করে বলা হচ্ছে, তাঁদের বাবা-মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বা কোনও দুর্ঘটনায় পড়েছেন। চিকিৎসার জন্য যত দ্রুত সম্ভব টাকা পাঠাতে হবে। কখনও আবার মেয়েকে অপহরণের ভুয়ো দাবিও করা হচ্ছে বাবা-মায়ের কাছে।

ফাঁদ ৪: পুলিশ বা সরকারি আধিকারিক সেজে প্রতারকেরা বাড়ি পৌঁছে যেতে পারে ভুয়ো মামলায় গ্রেফতারির ভয় দেখাতে। এই মর্মে নয়ডায় একটি সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে। বিভিন্ন আবাসন কর্তৃপক্ষ ফ্ল্যাটগুলির বাসিন্দাদের হাতে সেই সতর্কবার্তা তুলে দিয়েছেন।

ফাঁদ ৫: ব্যাঙ্কের কেওয়াইসি আপডেট করানো না-হলে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে কয়েক দিন আগেই ডিআরডিও-র এক ইঞ্জিনিয়ারের ১৩ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। কখনও ব্যাঙ্কের আধিকারিক সেজে ফোন আসছে, কখনও আবার পাঠানো হচ্ছে মেসেজ। পেশাদারি কায়দায় ‘অটো জেনারেটেড কল’ও আসছে। কথার প্যাঁচে ফেলে একটি অ্যাপ ডাউনলোড করানো হচ্ছে মোবাইলে। কিছু বোঝার আগেই উধাও হয়ে যাচ্ছে টাকা।

অস্ত্র যখন লোভ

ফাঁদ ১: শেয়ার বাজারে বা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করলে ব্যাঙ্কের তুলনায় বেশি লাভের সম্ভাবনা থাকে। তবে এতে ঝুঁকিও রয়েছে। সেই দ্বিধাকেই কাজে লাগায় প্রতারকেরা। কী ভাবে বিনিয়োগ করলে বেশি লাভ হবে, তা শেখানোর নামে টোপ দেওয়া হয়। সমাজমাধ্যমে ছড়ানো হয় বিজ্ঞাপন। হোয়াটসঅ্যাপেও যোগাযোগ করা হয়। দেওয়া হয় অ্যাপ বা ওয়েবসাইটের লিঙ্ক। সেখানে টাকা বিনিয়োগ করলেই তা চলে যায় প্রতারকদের কাছে। ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লগ্নি শেখানোর নামেও একই ধরনের প্রতারণা চলে।

ফাঁদ ২: কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদারের ছবি ব্যবহার করে সম্প্রতি প্রতারণার ফাঁদ পাতা হয়েছিল সমাজমাধ্যমে। সুদ ছাড়াই ৪০ হাজার টাকা ঋণের টোপ দেওয়া হয়। বিষয়টি নজরে আসতেই পুলিশের সঙ্গে যোগযোগ করেন সুকান্ত। ঋণের নামে এমন বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার ফাঁদ ছড়িয়ে রেখেছে সাইবার জালিয়াতেরা। কখনও সমাজমাধ্যমে, কখনও হোয়াটস্‌অ্যাপে পাঠানো হয় এই ধরনের লিঙ্ক। টেক্সট মেসেজও আসে। লিঙ্কে ক্লিক করলেই সর্বনাশ!

ফাঁদ ৩: রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি দেওয়ার নামেও ফাঁদ পাতা হয়। ভর্তুকির লোভ দেখিয়ে গ্রাহকদের ফোন করে ওটিপি হাতিয়ে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা রয়েছে এ রাজ্যেও। এ ক্ষেত্রে অনেক সময়ে ‘অটো জেনারেটেড ভয়েস কমান্ড’ ব্যবহার হয়। যা গ্রাহকের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের কাজ সহজ করে দেয়।

ফাঁদ ৪: মোবাইলের টাওয়ার বসানোর নামে প্রতারণা। মোবাইল নেটওয়ার্ক সংস্থার নামে ফোন করে বলা হয়, তাঁর বাড়ির ছাদে একটি মোবাইলের টাওয়ার বসাতে চাইছে কোনও একটি টেলিকম সংস্থা। ‘সিকিউরিটি ডিপোজ়িট’ বাবদে কয়েক লক্ষ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ছাদে জায়গা দেওয়ার জন্য পৃথক ভাড়া দেওয়ার কথাও বলা হয়। লোভে পড়ে রাজি হয়ে গেলেই ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ এবং অন্য নথিপত্রের অজুহাতে টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারকেরা।

ফাঁদ ৫: প্রথম সারির অনলাইন বিপনন সংস্থাগুলি ‘অর্ডার ট্র্যাক’ করার সুযোগ দেয়। কিন্তু অনেকেই শুধু কত তারিখের মধ্যে ডেলিভারি আসবে, তা দেখেই ছেড়ে দেন। এটিরও সুযোগ নেয় প্রতারকেরা। ক্রেতার ফোনে টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে বলা হয়, ঠিকানা অসম্পূর্ণ। সেটি আপডেট করতে বলে একটি লিঙ্কও পাঠানো হয়। এই ধরনের লিঙ্ক ক্লিক করলে টাকা খোয়ানোর সম্ভাবনা প্রবল।

ফাঁদ ৬: ভুয়ো কিউআর কোডের মাধ্যমেও চলছে প্রতারণা। কয়েক সপ্তাহ আগে পুণের এক পুলিশকর্মী পড়েন ভুয়ো কিউআর কোডের খপ্পরে। খাবার কিনতে গিয়ে কিউআর কো়ড স্ক্যান করতেই প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা খোয়া যায় ওই পুলিশকর্মীর। কিউআর কো়ড স্ক্যান করতেই তাঁর মোবাইলে একটি অচেনা লিঙ্ক চলে আসে। নিজের অজান্তেই লিঙ্কে ক্লিক করে ফেলেন পুলিশকর্মী। এর পর তাঁর মোবাইলের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি চলে যায় প্রতারকদের হাতে। (চলবে)

অন্য বিষয়গুলি:

Cyber Crime Cyber fraud Digital Arrest Digital Frauds Online Frauds Public awareness
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy