বিমল গুরুঙ্গ-এর হাতে লোপ্পা বলটি তুলিয়া দিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভুল করিলেন কি না, ইহা একটি প্রশ্ন। কিন্তু লোপ্পা না হইলেও বলটি আদৌ খেলা উচিত ছিল কি না, ইহা একটি ভিন্ন প্রশ্ন। মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়ে বাংলা ভাষা চালুর কথা বলিতেই গুরুঙ্গ তাঁহার ধ্বংসকাণ্ড শুরু করিবার উপলক্ষটি পাইয়া গেলেন। বাংলাবিরোধী জিগির তুলিয়া নেপালি জাতিসত্তার আন্দোলন দ্রুত বেগবান হইয়া উঠিল। কিন্তু তাই বলিয়া মুখ্যমন্ত্রীর বাংলা-নীতিকে কি ভুল বলাই সঙ্গত? ভাষা লইয়া রাজনীতির ঘূর্ণিপাক একবিংশ শতকের ভারত ও পশ্চিমবঙ্গে একটি অনতিক্রম্য বিষয়। কিন্তু তাই বলিয়া এই রাজ্যে ভাষা বিষয়ে কি স্পষ্ট নীতি প্রণয়নের দরকার নাই? প্রশ্নটির উত্তরে রাজনীতি শেষ পর্যন্ত ঢুকিবেই, কিন্তু রাজনীতির বাহিরেও আরও কিছু গুরুতর প্রতিপাদ্য আছে, ইহাও মাথায় ঢোকা দরকার। মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি বাংলা ভাষাকে এ রাজ্যে আবশ্যিক করিবার নীতি ঘোষণা করিয়া সেই প্রতিপাদ্যটিকে আলোচনার সামনের স্তরে আনিয়া দিয়াছেন। দার্জিলিং-এর ক্ষেত্রে সরকারি নীতিটি কী এবং কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত লইবার সময়ও আসিয়াছে।
নূতন সরকারি নীতির মূল কথা যদি হয়, রাজ্যের প্রধান ভাষাটি রাজ্যের অধিবাসীদের শিখিতে হইবে, তাহা সব দিক দিয়াই সুবুদ্ধিসম্পন্ন প্রস্তাব। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এই নীতি আছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এই নীতিই প্রচলিত। তাহাতে অনেক অভিবাসীর, এমনকী অনেক অধিবাসীরও, অসুবিধা হইতে পারে। জার্মানি-বাসী মার্কিন দম্পতির সন্তানকে স্কুলে জার্মান শিখিতে হয় বলিয়া বাবা-মা ভিতরে ভিতরে ক্ষুব্ধ বোধ করিতে পারেন। কিন্তু তাহা ভিতরে ভিতরেই, কারণ, বাহিরে দেশের নীতি অমান্য করিবার অবকাশ নাই, অমান্য করিবার কারণও কেহ দেখেন না। যস্মিন্ দেশে যদাচার যখন, ভাষা তো আচারের মধ্যেই পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে যে সব অবাঙালি থাকেন, তাঁহারা প্রথম/দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি পড়িয়াও তৃতীয় ভাষা হিসাবে বাংলা শিক্ষা করিতেই পারেন, তাহাতে তাঁহাদের শৈশব-কৈশোর নিষ্পেষিত হইবে না। বরং ভাবিবার বিষয় দার্জিলিং-এর মতো সেই সব অঞ্চল লইয়া, যেখানে বাংলা ভিন্ন আর একটি জোরদার স্থানীয় ভাষা প্রচলিত। দার্জিলিং-এর ক্ষেত্রে যেমন নেপালি।
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশমতে, এই সব স্থানে ইংরেজি, হিন্দি ও স্থানীয় ভাষা শিক্ষা চলুক, তাহার সঙ্গে থাকুক বাংলা ভাষাও, ঐচ্ছিক ভিত্তিতে। অর্থাৎ তৃণমূল সরকারের নীতি কিন্তু এই ক্ষেত্রে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক নমনীয়। দার্জিলিং যখন এ রাজ্যের একটি জেলা, বাংলা সেখানে কেন ঐচ্ছিক হইবে, কেন অন্তত চতুর্থ ভাষা হিসাবে আবশ্যিক হইবে না, তাহা বোধগম্য নয়। দার্জিলিং-এর শিশুর পক্ষে চারটি ভাষা শিক্ষা কঠিন হইতে পারে, কিন্তু রাজ্যের প্রধান ভাষাটি না শিখিয়া রাজ্যে বসবাস করিবার বাস্তব অপেক্ষা তাহা কঠিনতর হইতে পারে না। বাংলা শিখিলে তাঁহাদের রাজ্যের মধ্যে বিচরণ করিতেও সুবিধা, হয়তো চাকরিবাকরি পাইতেও সুবিধা। সুতরাং শিক্ষাকে একটি বাধার প্রাচীর না ভাবিয়া উঠিবার একটি সোপান ভাবিলেই তো হয়। রাজ্যে আবশ্যিক বাংলা শিক্ষার পক্ষে এই ওকালতিকে সংকীর্ণ ভাষা-জাতীয়তাবাদের চর্চা ভাবিলে ভুল হইবে। ইহা হিন্দি ও ইংরেজি আগ্রাসন হইতে রাজ্যের সমৃদ্ধ প্রাদেশিক ঐতিহ্যটিকে স্থিত রাখিবার যুক্তি। গুরুঙ্গরা তাঁহাদের রাজনৈতিক মতান্ধতায় সে যুক্তি হইতে মুখ ঘুরাইবেন, বিজেপি তাহাদের গোবলয়-জাত স্পর্ধান্ধতায় সে যুক্তি অগ্রাহ্য করিবে। কিন্তু যাবতীয় অন্ধতা এবং যাবতীয় রাজনীতির বাহিরে গিয়া দীর্ঘপ্রবাহী ইতিহাসের প্রেক্ষিতে বিষয়টির বিশ্লেষণ। বহুভাষাভাষী মানুষ আগেও ছিল, এখনও আছে। ভবিষ্যতেও যাহাতে থাকে, সেই বন্দোবস্তই হউক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy