Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Municipal Election 2020

এ বার ভোটের প্রচারেও গরুর দুধ!

আমার দুধওয়ালাকে বললাম, আমাকে এক হপ্তা ‘আমিষ দুধ’ দিতে পারবেন? দেখি তাঁর কপালে কুঞ্চন, চোখ দুটো মুর্শিদাবাদের ইয়াবড় দু’টি ছানাবড়া! এক রসিকজন ফোড়ন কাটেন, বিড়ি থেকে দুধ সবই আছে আমদের জেলায়।

কৌশিক গুড়িয়া
শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২০ ০১:১৫
Share: Save:

আমার বাড়িতে যিনি দুধ বিক্রি করেন তিনি চাষি এবং গোয়ালা। তিনি প্রান্তিক। কিন্তু কোনও ভাবেই যান্ত্রিক নন। তিনি হয়তো কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের ভক্ত। পলসন্ডা থেকে হাঁড়িতে প্রায় কুড়ি লিটার দুধ নিয়ে তিনি বাসে ওঠেন। বহরমপুরে নেমে একটি সাইকেল ভাড়া নেন এবং বাড়ি বাড়ি দুধ বিক্রি করেন। এ জেলায় বিড়ি শিল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন দুগ্ধ-সমবায়ও যে ভাত-কাপড়ের সুরাহা করে তা এঁদের দিকে না তাকালে বোঝার উপায় থাকে না। হরিহরপাড়া, রানিনগর, কান্দি কিংবা সুদূর সালারেও এমন বহু পরিবার পাওয়া যাবে, যারা সমবায়ের চাহিদা মিটিয়েও পারিবারিক ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারেন।

হঠাৎ এক রসিকজন ফোড়ন কাটেন, বিড়ি থেকে দুধ সবই আছে আমদের জেলায়। কেউ বিড়ি বেচে দুধ কেনেন, তো কেউ হয়তো দুধ বেচে বিড়ি! সেই রসিকজনের কথা মাথায় রেখেই আমার দুধওয়ালাকে বললাম, আমাকে এক হপ্তা ‘আমিষ দুধ’ দিতে পারবেন? দেখি তাঁর কপালে কুঞ্চন, দেখি তাঁর চোখে মুর্শিদাবাদের ইয়াবড় দু’টি ছানাবড়া! তিনি বললেন ‘আমিষ দুধ’ আবার কী? গরুর দুধ তো নিরামিষ! আমি তখন আর কথা বাড়ালাম না। কিন্তু মার্কিন ও ভারতীয় দুই রাষ্ট্রপ্রধানের অনুসারীদের রচিত দুগ্ধ-কাহিনির ভিতরে ঢুকলে বেশ মজার তর্ক শোনা যাচ্ছে।

মোটামুটি ভাবে আন্দাজ করা যায়, মার্কিন দুধ ও দুগ্ধজাত উপাদান নিয়ে ভারতে বাণিজ্য বাড়াতে চান ট্রাম্প। সেই আমদানি প্রকল্পে ১০০ শতাংশ কর চাপিয়েছে আমাদের দেশ। মার্কিন সরকার চায় সেই কর কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হোক। এ নিয়ে সাম্প্রতিক দ্বিপক্ষ বাতাবরণও বেশ উষ্ণ। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অনুগামীরা মার্কিন দুগ্ধপণ্যে কর কমানো দূরে থাক, তাদের আমদানিই বন্ধ করে দিতে চান। তাঁদের যুক্তি আছে, তবে তা অংশ বিশেষে ঘোলাটে।

প্রথমত, তাঁরা বলতে চাইছেন আমেরিকার দুধ এদেশে এলে মার খাবেন আমাদের পশুপালকরা। অর্থাৎ প্রভাব পড়বে এ জেলার গোপালকদের উপরেও। এ যুক্তি সৎ। দ্বিতীয়ত, তাঁরা বলছেন আমেরিকানদের গোপালন যেহেতু কৃত্রিম এবং অন্য প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ-রক্তমাংস খাইয়ে গরুকে হৃষ্টপুষ্ট করে তোলা হয়, তাই সেই গরুর দুধ আর কোনও মতেই নিরামিষ থাকে না। সেই দুধ আমিষ। ধর্ম-আবেগ এক্ষেত্রে বেশ কিছুটা বেগ পেলেও এই যুক্তি হয়তো ততটা উদার মনস্ক নয়। দুগ্ধ বিজ্ঞান এ বিষয়ে কী বলে, সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে সোশ্যাল মিডিয়ার নাক উঁচুদের দিকে এ বার একবার তাকানোর দরকার আছে। এ যাবৎ ফেসবুক থেকে হোয়াটসঅ্যাপে বেশ কিছু বহুজাতিক চকোলেট ও দুগ্ধপণ্য প্রস্তুতকারক কোম্পানির বিরুদ্ধে পাতার পর পাতা প্রচারপত্র দেখতে পাওয়া গিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে চকোলেটে ও দুধে ব্যবহৃত ফ্যাট আসলে গরু ও শুকরের চর্বি। এই প্রচারের সত্যাসত্য প্রমাণ করবে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, কিন্তু তার আগেই অতি সহজে এতে প্রসঙ্গটিতে ধর্মীয় ভাবাবেগে মুড়ে দেওয়া হল।

যদি এই প্রচারটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তা হলে এই একটি প্রচারেই সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি-তৃণমূল লড়াই শুরু হয়ে যাবে। গরু বেচারা বুঝতেই পারল না, সে এবং তার খাদ্য এবং তার দুধ কী ভাবে রাজনীতির তর্কে উঠে পড়ল।

ফলত চলতি সময়ে ধর্মই হয়ে উঠল রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্র! শিক্ষা থেকে চিকিৎসা, সমাজ থেকে অর্থনীতি কোথাও তার অনুপ্রবেশ আটকানো গেল না।

এ বার দেখা যাক দুধের ঘনত্বে কে বেশি গাঢ়, সামাজিক আবেগ নাকি বিজ্ঞান। সাধারণ বিজ্ঞানের মতে পৃথিবীতে কেবল তিন প্রকার খাদ্য হল প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট। বিজ্ঞানের আতস কাচে প্রোটিন মানে আমিষ। কার্বোহাইড্রেট হল আলু-ভাত-রুটির উপাদান, অর্থাৎ শর্করা। আর ফ্যাট হল চর্বি। যদিও মান্ধাতার আমল থেকে চর্বি বলতে আমরা যাই বুঝি না কেন, সে কিন্তু কেবল মাংস ও মাছের পদকেই চিহ্নিত করে এসেছে। উদ্ভিজ চর্বিও যে ফ্যাট, তা যেন জেনেও বুঝি না আমরা! ফলত এ হেন সামাজিকতা থেকেই পেঁয়াজ হয়ে ওঠে আমিষ, আমিষ হয়ে ওঠে রসুন কিংবা মুসুরের ডাল। তথাপি সাম্প্রতিক স্মার্টনেস আমাদের শেখায়, ‘বিদেশে কিন্তু এগ পুরো ভেজ’!

আবার যদি আধো-বিজ্ঞান আধো-আধ্যাত্মিকতায় আকৃষ্ট হন, দেখবেন তাঁরা বলছেন, আমিষ-নিরামিষের বাধ বিচার হয় শরীরে তার প্রভাব থেকে। যে খাবার অম্ল উৎপাদনকারী সে হল আমিষ, আর ক্ষার তৈরি করে নিরামিষ। বাচ্চাদের বইতে লেখা ‘আদর্শ খাদ্য দুধ’ এখানে এসে বিবাদ বাড়াল, সে আবার কোন দলে যায়? রাসায়নিক বিশ্লেষণ বলে গরুর দুধে প্রোটিন ৩.২%, ফ্যাট ৩.৯% ও শর্করা ৪.৬% (তুলনায় মানব দুধে প্রোটিন কম, ফ্যাট ও শর্করা বেশি)। এ বার কী আমরা নির্ণয় করতে পারি দুধ আসলে আমিষ নাকি নিরামিষ? তবে আমেরিকার প্রাণীর-নাড়িভুঁড়ি ভক্ষণকারী গরুর দুধে এই অনুপাত ভিন্ন হতে বাধ্য।

সোশ্যাল সাইটগুলোতে এোই নিয়ে গাঢ় তর্কই চলছে। তবে আবেগসর্বস্ব হোন, মিথ্যা-প্রচারক কিংবা রাজনৈতিক, দুগ্ধপ্রেমী যে দলেই থাকুন না কেন, তাঁদের কে বলি, নিরামিষ দুধ সত্যিই পাওয়া যায়! তা তৈরি করা হয় উদ্ভিজ উপাদান থেকে। যেমন সয়া-মিল্ক, আমন্ড-মিল্ক কিংবা ওট-মিল্ক। অর্থাৎ সয়াবিনের দানা, আমন্ড বাদাম ও ওট থেকেও বেটে-পিষে দুধ বের করা যায়। চাহিদাও তুমুল তাদের। এদের মধ্যে প্রোটিন বেশি সয়া-মিল্কে, ফ্যাট বেশি ওট-মিল্কে।

তবুও বাঙালির কাছে দুধ মানেই গরু, আর গরু রচনার কথা কেই বা ভুলে যেতে পারে! তাই শেষ পর্যন্ত দুধের কল্প-গল্প পড়তে বসলে সব যেন তালগোল পাকিয়ে যায়।

গরুও যে শেষ পর্যন্ত ভোটের একটি নির্ণায়ক বিষয় হতে পারে, তা সত্যি বলতে আগে কখনও ভাবিনি। আমার বাড়িতে যিনি দুধ দেন, তিনিও হয়তো চিন্তায় পড়বেন এ সব শুনে।

শৈশবের গল্প বইতে রাক্ষস-খোক্ষস যেমন ‘হাঁউ মাউ খাঁউ’ বলে আমাদের অবাস্তব পরিসরে ঠেলে দিত, ভেগান-তন্ত্রের আমিষ-নিরামিষ দুগ্ধ-কাহিনিও যেন তেমনটাই ডাক দেয়, হাঁউ মাউ কাউ...

মতামত লেখকের নিজস্ব

অন্য বিষয়গুলি:

Municipal Election 2020 Cow
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy