Advertisement
E-Paper

পশমিনার উৎস সন্ধানে

অত্যুচ্চ চাংথাং উপত্যকা, যেখানে হাওয়ার ধার ছুরির মতো, তা-ই হল চাংরা ছাগলের বাসভূমি। বিশ্বের সেরা পশমিনা আসে তাদের থেকে।

সম্পদ: হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে নিবিড় ভাবে জড়িত সোনালি পশমের উৎপাদন।

সম্পদ: হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে নিবিড় ভাবে জড়িত সোনালি পশমের উৎপাদন। ছবি: অনিরুদ্ধ দাস।

অনিরুদ্ধ দাস

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২৫ ০৫:০১
Share
Save

শীত শেষ। সময় হয়ে এল শাল তুলে রাখার। বিশেষ করে, সবচেয়ে মূল্যবান, পশমিনা। হালকা থেকে তীব্র, সব রকম শীতে যা জড়িয়ে থাকে আপনজনের মতো। ফারসি ‘পশম’-এর মানে সোনালি উল, তা থেকে ‘পশমিনা’— যা বুঝিয়ে দেয়, এ যেন অলৌকিক সম্পদ। অনেকেই জানেন না, পশমিনার উৎস কাশ্মীর নয়, লাদাখ। অত্যুচ্চ চাংথাং উপত্যকা, যেখানে হাওয়ার ধার ছুরির মতো, তা-ই হল চাংরা ছাগলের বাসভূমি। বিশ্বের সেরা পশমিনা আসে তাদের থেকে। হিমালয়ের তীব্র ঠান্ডায় অভ্যস্ত এই ছাগলদের পেটের কাছে শীতকালে তৈরি হয় নরম লোমের আস্তরণ। এমন উষ্ণ আর নরম যে, অতুলনীয়। বাজারে যা পশমিনা বলে বিক্রি হয়, তাতে অবশ্য প্রায়ই থাকে বাণিজ্যের হাতসাফাই। যা অকৃত্রিম পশমিনা উৎপাদনের পিছনের কাহিনিটিকে লঘু করে তোলে।

সেই কাহিনির শুরু বসন্তে, যখন চাংরা ছাগলেরা তাদের লোমের আস্তরণ খসিয়ে ফেলা শুরু করে। এই সময়ে বিশেষ নকশার, বাঁকা চিরুনি দিয়ে তাদের গা আঁচড়ে দেন ছাগল-পালকরা। এতে পশুগুলির কোনও ক্ষতিই হয় না, বরং তারা আরাম পায়। এ ভাবে সংগ্রহ না করলে ছাগলগুলির লোম আপনি খসে পড়ত, আর তা হিমালয়ের হুহু হাওয়ায় উড়ে যেত। এমন মানবিক ভাবে লোম সংগ্রহ করে চাংপা জনজাতির মানুষেরা তাঁদের জীবিকার উৎস পশুগুলিকে কেবল ব্যবহার করেন না, সম্মানও করেন। কাঁচা উলকে অনেক পরিশ্রমে পরিষ্কার করে, হাতে-চালানো সাবেক যন্ত্রে সুতো তৈরি করেন স্থানীয় মহিলারা। পশমিনার প্রতিটি তন্তু হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে মানুষের সুস্থায়ী, সমাদরের সম্পর্কের সাক্ষ্য দেয়।

এই সূক্ষ্ম, নরম সুতো থেকে হাতে-বোনা তাঁতে তৈরি হয় শাল— সে কাজটা করতে কয়েক সপ্তাহ, এমনকি কয়েক মাসও লেগে যেতে পারে। এই শাল বোনার কাজটা অনেক সময়ে কাশ্মীরে হয় বলে পশমিনা উৎপাদনে লাদাখের ভূমিকা বরাবরই একটু পিছনে রয়ে গিয়েছে। এমনকি পশমিনা উলকেও ‘ক্যাশমেয়র’ বলা হয়, যা ‘কাশ্মীর’-এর অপভ্রংশ। কাশ্মীরের শিল্পীদের হাতের কাজের তুলনা হয় না বটে, কিন্তু পশমিনা উলের জোগানদার লাদাখের যাযাবর জনজাতি, লাদাখের বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে পশমিনার সম্পর্ক নিবিড়।

পশমিনার আভিজাত্য আর আরামের পিছনে রয়েছে এক কঠিন বাস্তব, যেখানে এক দিকে বাঁচার মরিয়া লড়াই, অন্য দিকে শোষণ, প্রতারণা। দালালরা নির্দয় ভাবে চিরকাল শোষণ করে এসেছে চাংপা পশুপালকদের। এক চাংপা প্রবীণ বলছিলেন, লাদাখে এসে তারা এক রকম দাম বলে যায়, অথচ মাল নিয়ে লে শহরে গেলে সেই ব্যবসায়ীই ধরে দেয় তার চাইতে অনেক কম দাম। ওজর দেখায়, বাজারে উলের দাম পড়ে গিয়েছে। আসলে তারা জানে, উল বিক্রি না করে ফের পাহাড়ি পথে মাল নিয়ে ফিরে যাওয়া গ্রামবাসীদের পক্ষে অসম্ভব। তাই প্রতিশ্রুত দামের এক সামান্য অংশ নিয়ে চাংপারা উল বেচতে বাধ্য হন। এই প্রতারণা এড়াতে পশমিনা উৎপাদকদের একটা সমবায় তৈরি করা হয়েছে, লাদাখি পশমিনার ‘জিআই’ ট্যাগও জোগাড় করা হয়েছে। তাতে ক্রেতাদেরও লাভ, তাঁরা পশমের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন। স্বচ্ছতা, ন্যায্য দাম বজায় থাকে।

তবু সমস্যা থেকেই গিয়েছে। বাইরের দালালদের উৎপাত কমলেও রয়েছে জনজাতির নিজস্ব সমস্যা। পশুপালন, পশমিনা উৎপাদন, অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ। চাংপাদের নাগাল পাওয়াই প্রায় অসম্ভব এক ব্যাপার— কোনও মানচিত্রে তাঁদের অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁরা কোথায় আছেন, বোঝার জন্য কোনও স্থায়ী নির্মাণ (ল্যান্ডমার্ক) খুঁজে পাওয়া যাবে না। চাংপা মানুষরা সারা বছরই চলমান, তাঁদের গতি নির্ধারিত হয় পশুদের জীবনছন্দ আর প্রকৃতির প্রতিকূলতার মাত্রা দিয়ে। অথচ, এক-একটা ছাগল থেকে বছরে মাত্র আশি গ্রাম থেকে একশো সত্তর গ্রাম উল মেলে। এই বিরলতার জন্যই পশমিনার দাম এত চড়া। কিন্তু পশমিনা তো শুধু একটা পণ্য নয়, তা এক সংস্কৃতি, এক ধরনের জীবনযাত্রা, পরিবর্তনের চাপে যা আর নিজেকে বহন করতে পারছে না। লাদাখের বিশাল, তুষারাবৃত, নীরব মালভূমি যেমন সুন্দর, তেমনই নিষ্করুণ। হুহু হাওয়ার আর্তনাদ, পায়ের নীচে গুঁড়িয়ে যাওয়া বরফ, দূরাগত ঘণ্টার ধ্বনি, আর সর্বোপরি লাদাখিদের গান। তার প্রতিটি স্বরে যেন ধরা রয়েছে এই ভূমিখণ্ডের ইতিহাস, সংগ্রাম, আর এর নীরব সৌন্দর্য।

লাদাখের প্রাণিপালন দফতরের কর্মীদের সহায়তায় অনেক দিনের চেষ্টার পর দেখা মিলল চাংপাদের। ক্যামেরা কাঁধে ক’জন অপরিচিত লোককে হঠাৎ উদয় হতে দেখে একটুও সতর্কতা, আশঙ্কার ছাপ পড়ল না। বরং অতিথিদের অভ্যর্থনায় শুরু হয়ে গেল মেয়েদের গান, আর তার সঙ্গে ছেলেদের নাচ। অতিথিদেরও সকলে হাত ধরে টেনে নিলেন নাচের দলে— নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করার আগেই!

কিন্তু এই জীবন হারিয়ে যাচ্ছে। নবীন প্রজন্ম যাযাবর পশুপালকের কঠিন জীবন থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন। নগরজীবনের স্বাচ্ছন্দ্য হাতছানি দিচ্ছে তাঁদের। তরুণ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সঙ্গেই বিদায় নিচ্ছে পশমিনা উৎপাদনের জ্ঞান, রীতিনীতি, আর মালভূমির সঙ্গে মানুষের গভীর সংযোগ। পশমিনার উৎস নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করতে গিয়ে অচিরে স্পষ্ট হল, আসলে এক সংস্কৃতির মৃত্যুর কাহিনি। এ ভাবেই মরে যায় সংস্কৃতি— শোরগোল তুলে নয়, নীরবে বিস্মৃতির দিকে এগিয়ে গিয়ে।

এক চাংপা প্রবীণ হাত বাড়িয়ে তাঁর ছাগল, চারণভূমি, চার পাশের মানুষের দিকে দেখিয়ে বললেন, “যদি আমরা এগুলো হারাই, তা হলে সব হারিয়ে যাবে।” ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি নয়, এ হল একটা গোটা জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের সঙ্কট। এ কেবল চাংপাদের প্রশ্ন নয়, লাদাখ ছাড়িয়ে বহু দূর এর বিস্তার। যখন আমাদের পরম্পরা হারিয়ে যায়, তখন আমরা ঠিক কী হারাই? অতীতের শান্ত সঙ্গীতকে যখন ডুবিয়ে দেয় আধুনিকতার উচ্চকিত ছন্দ, তখন কিসের পরিবর্তন হয়? সংস্কৃতি, পরিচিতি, নিজের ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযোগ— এগুলোর জন্য লড়াই করা কি অর্থপূর্ণ কাজ?

প্রকৃত পশমিনা, এখন যা জিআই ট্যাগ দিয়ে চিহ্নিত, তা কেবল উলের উৎস আর মানের নিশ্চয়তা দেয়, বা উৎকৃষ্ট শিল্পকীর্তির আশ্বাস বহন করে, তা-ই নয়, তা চাংপাদের সংস্কৃতি, তাঁদের বিপন্ন বাস্তুতন্ত্রের সাক্ষ্যও দেয়। ওই যাযাবর পশুপালকের জীবনযাত্রা, তাঁদের দীর্ঘ দিনের রীতিনীতি না থাকলে পশমিনাও থাকবে না। পশমিনাকে বাঁচাতে হলে ওই লোকগুলোকেও বাঁচাতে হবে, তাঁদের চারণভূমি, বাস্তুভূমিকে বাঁচাতে হবে। প্রাচীন প্রথাগুলো জিইয়ে রাখতে হবে।

নেপাল, পাকিস্তান, চিন, মঙ্গোলিয়া-সহ বিশ্বের নানা জায়গায় উল বা পশম উৎপন্ন হলেও, ‘পশমিনা’ কথাটি ভারতীয় উপমহাদেশের জন্যই প্রযোজ্য। এই তন্তু, কাপড় আর কারুকার্য, সবই অতীত থেকে এক অবিচ্ছিন্ন ধারায় বয়ে চলেছে। সেই ধারায় তার নিজের অবস্থান বজায় রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে লাদাখ। প্রশ্ন হল, বিশ্ব কি লোভনীয় পশমিনা শালের আকর্ষণের পিছনে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করবে এক সংস্কৃতির টিকে থাকা, তার ধারক-বাহক মানুষগুলির বাঁচার সংগ্রামকে? ভূমির সঙ্গে মানুষ, এক পাহাড়ি জনজাতির সঙ্গে বহির্বিশ্ব, প্রবীণের সঙ্গে নবীনের সম্পর্কের যে সূক্ষ্ম জাল বিশ্বকে পশমিনা জোগাচ্ছে, তা যেন নজর না এড়িয়ে যায়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Ladakh Animal Husbandry

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}