বন্দিজীবন: জানালায় আটকে চোখ। কবে আবার মুক্তি পাবে শৈশবের খেয়াল খুশির জীবন, সে অপেক্ষায়। নিজস্ব চিত্র
ডাকঘরে’র অমলকে মনে আছে? সেই যে সেই ছেলেটা, যাকে কবিরাজ ঘর থেকে বের হতে বারণ করেছিলেন। সারাদিন জানালার ধারে বসে সে রাস্তার দিকে চেয়ে থাকত সে। মাঝে মাঝে যখন রাস্তায় অন্য মানুষ আসত, সে তখন কল্পনায় মিশে যেত তাদের দলে। কখনও দইওয়ালার সঙ্গে কল্পনায় ভাসতে ভাসতে সে পৌঁছে যেত পাহাড়ের কোলে ছোট্ট গ্রামটাতে। কখনো আবার সুধার সঙ্গে তার ফুল তোলার সঙ্গী হত। তার বাড়ি থেকে বেরনোর উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল, কিন্তু কল্পনার জগতে সে ছিল সুদূরের পিয়াসী। অমলের অসুখ করেছিল, তাই সে বাধ্য হত গৃহবন্দি থাকতে। আর আজ 'পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখ', সকলেই তাই গৃহবন্দি। অমলের ভূমিকায় অভিনয়ের প্রস্তুতি নিতে নিতে ক্লাস সেভেনের স্পন্দন বন্দ্যোপাধ্যায় যে নিজেই কখন অমল হয়ে উঠবে, তা হয়ত নিজেও ভাবতে পারেনি। হঠাৎ করেই তার চির চেনা পৃথিবী অচেনা হয়ে গেছে। রাস্তায় লোকজন এতই কম যে জানালার ধারে বসে দইওয়ালার দেখা পাওয়ার সম্ভাবনাও এখন অতি ক্ষীণ। মাঝে মাঝে আনাজওয়ালা হেঁকে যায়, ‘আনাজ নেবে গো আনাজ’। দইওয়ালার মত সারাদিন গল্প করার মতো সময় তাদের নেই।
কল্পনার অমল আছড়ে পড়েছে বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে। হঠাৎই রুদ্ধ হয়ে গেছে শৈশব। ডাকঘরের অমলকে নানারকম খেলা দেখিয়ে মন ভোলাতো ছেলের দল। এখনকার অমলদের কাছে সেই জায়গা নিয়েছে মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট। মোবাইল ফোন তো মন ভুলিয়ে রাখছে, কিন্তু মনের খোরাক জোগাতে পারছে কি? যে বাচ্চা ছেলেটি একমাস আগে পর্যন্তও স্কুলে গিয়েছে, আবৃত্তি শিখেছে, আঁকা শিখেছে, দিনের পর দিন থিয়েটারের প্রস্তুতি নিয়েছে, মঞ্চে অভিনয় করেছে - এক লহমায় সবকিছুই অনেকটা দূরে সরে গিয়েছে তার থেকে। পুরনো নাটকের স্ক্রিপ্টগুলো বারবার পড়তে পড়তে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। মঞ্চ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেও যাওয়ার উপায় নেই। ঠিক যেমন সুধা ডেকেছিল অমলকে। মোবাইল ফোনে কখনও আবৃত্তি শিক্ষকের, কখনও আঁকার শিক্ষকের নানান নির্দেশিকা এসেই চলেছে, কিন্তু তা কোনওভাবেই আকর্ষণ করছে না শিশুদের, সব কিছুই যেন কাছে থেকেও অনেকটা দূরে।
জানালার কংক্রিটের স্ল্যাবে চুপ করে বসে ফাঁকা রাস্তা দেখতে আর কতক্ষণ ভাল লাগে? মোবাইলের স্ক্রিনে শিক্ষকের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না বছর চারেকের আরাত্রিকা মৈত্রেরও। বাইরের জগতের পরিস্থিতি তার কাছে অজানা, ভবিষ্যৎ ভয়াবহতা সম্পর্কেও সে নির্বিকার। অসুখ যতই কঠিন হোক না কেন, জানালার গরাদ ধরে বসে থাকতে তার মন চায় না। রেলিঙের উল্টোদিকের খোলা মাঠ তাকে যেন চিৎকার করে ডাকে। সে আওয়াজ অবশ্য বাড়ির অন্য কেউ শুনতে পায় না। প্রত্যেকদিন বিকালে যে মাঠে সে খেলতে যেত, মায়ের হাত ধরে গোটা মাঠ ছুটে বেড়াত, এখন সেই মাঠ খাঁ খাঁ করছে। তার সমবয়সী বন্ধুরাও কেউ আর আসে না মাঠে, কান্না পায় আরাত্রিকার। কয়েকমাস আগেই যে নাচের স্কুলে সে ভর্তি হয়েছিল, নতুন নতুন নাচ শিখছিল, নতুন বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, হঠাৎ করেই সেসব বন্ধ হয়ে গেল কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছে সে। বড়রা তাকে অনেক বুঝিয়েছেন, এখন বাড়ি থেকে বের হলে সমূহ বিপদ। কিন্তু শিশু মন তা মানলে তো? কবিরাজ আর পিসেমশাই অমলকেও তো কম বোঝাননি, ফল সেই একই। আরাত্রিকা একা নয়। ওর সমবয়সী হাজার হাজার শিশুই মুখোমুখি হচ্ছে একই সমস্যার, সমাধান দিতে গিয়ে নাজেহাল অভিভাবকেরাও।
শিলিগুড়ির শিঞ্জা ভট্টাচার্য যেমন নিজের পুরো কল্পনার পৃথিবীটাকেই তুলে এনেছে বাড়ির চার দেওয়ালে। ঘরের প্রত্যেকটা দেওয়ালে তার আঁকা ছবির ছড়াছড়ি। কোথাও মেঘটা দেখতে সিংহের মতো, কোথাও আবার হলুদ রঙের সূর্য মুচকি মুচকি হাসছে। আর দেওয়ালের ঠিক মাঝখানে মা বাবার হাত ধরে ছোট্ট শিঞ্জা হেঁটে যাচ্ছে ঘেরাটোপের বাইরে দূরে কোথাও। মনোবিদরাও বলছেন একই কথা। আজকের এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে রুদ্ধ হচ্ছে শৈশবের বিকাশ। কিন্তু বাইরে যাওয়ার উপায় যখন নেই, তখন কল্পনার লাগামকেই আলগা করতে হবে। হোক না পাহাড়ের ছোট্ট গ্রামটা দইওয়ালার বাড়ি, কল্পনায় সেখানে পৌঁছে যেতে তো কোনও বাধা নেই। বিশ্বভারতীর বিনয় ভবনের এডুকেশনাল সাইকোলজির শিক্ষিকা শর্মিলা যাদবের অভিমত, ‘‘একমাত্র অভিভাবকেরাই পারেন এখন শিশুদের কল্পনাকে আকাশ ছোঁয়াতে, সেটাই একমাত্র মুক্তির পথ।’’
সমস্যা যে শুধু শিশুদের, তাও তো নয়। যাদের সবটা বুঝেও মন মানছে না, সেই বয়ঃসন্ধির কিশোর-কিশোরীরাও পড়েছে মহা সমস্যায়। তাদের সাংস্কৃতিক বিকাশ অনেক দিন আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে। এখন তারা প্রকাশের মঞ্চ চায়। কিন্তু সেই দরজা আপাতত বন্ধ। যে সময়কালে মন সবচেয়ে বিক্ষিপ্ত থাকে, ঠিক আর ভুলের বিচার হয়ে ওঠে একদমই আপেক্ষিক, সেই বয়ঃসন্ধিতে সবচেয়ে ভাল বন্ধু হতে পারত নাচ, গান, ছবি, আবৃত্তি, নাটক। কিন্তু সেই সব বন্ধুরাই তো এখন আকাশের তারার মতো অনেক দূরে। হাত বাড়ালে তাদের ছোঁয়া যায় না। তাই না বলতে পারা মন খারাপটা সবারই।
দেবপ্রিয় চক্রবর্তী বেড়াতে বড্ড ভালবাসে। এবছরের মাধ্যমিক পরেই তার গুজরাট আর কাশ্মীর বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। সেই আশা বুকে নিয়েই পরীক্ষার আগের ছ-সাত মাস নিজেকে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি করে রেখেছিল সে। ভালয় ভালয় পরীক্ষা শেষ হল, কিন্তু বেড়াতে যাওয়াটা আর হয়ে উঠল না। কল্পনার কাশ্মীর রয়ে গেল কল্পনাতেই। ভেবেছিল, মাধ্যমিকের জন্য গান শেখাটা বন্ধ ছিল অবার সেটা শুরু করবে আবার, হয়ে উঠল না সেটাও। সবচেয়ে পছন্দের যে কাজ, গল্পের বই পড়া - তারও ভাঁড়ার শেষ। সমস্ত লাইব্রেরি বন্ধ, ঝাঁপ পড়ে গিয়েছে বই-এর দোকান গুলিরও। আসলে গোটা পৃথিবী জুড়েই থমকে গিয়েছে সব। স্তব্ধ কারখানা, স্তব্ধ যানবাহন, স্তব্ধ স্বাভাবিক জনজীবন। কিন্তু মানুষ তো জড় বস্তু নয়, বিশেষত শিশুর মন সবসময় অজানাকে জানতে, অদেখাকে দেখতে, অচেনাকে চিনতে চায়। যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে, মন নামক বস্তুটি সজীব আছে, ততক্ষণই তার খোরাক দরকার।
অমল জানত, সে খুব বেশি দিন বাঁচবে না। রাজার চিঠি এলেই তার চিরমুক্তি। তবুও সে দুঃখে কাতর হয়ে পৃথিবীর থেকে চোখ সরিয়ে থাকতে পারেনি, বরং দুহাত ভরে সংগ্রহ করেছে জীবনের রসদ। অমল জীবদ্দশায় মুক্তির স্বাদ পায়নি, কিন্তু আমরা আশা রাখি, অদূর ভবিষ্যতেই আমাদের সামনের ওই জানালার গরাদ সরে যাবে, সত্যি সত্যিই আমরা পৌঁছে যাব দইওয়ালার গ্রামে, হয়ে উঠব ছেলের দলের একজন সদস্য, সুধার সঙ্গে ফুল কুড়াতে যাব নাম না জানা কোনো প্রান্তরে। ছোট্ট স্পন্দন অমলের ভূমিকায় দুরন্ত অভিনয় করে হাততালি কুড়িয়ে নেবে হলভর্তি দর্শকের। আরাত্রিকা তার নতুন শেখা নাচ উপস্থাপন করবে অনেক মানুষের সামনে, শিঞ্জা তার মা বাবার হাত ধরে ছুটে বেড়াবে খোলা মাঠে, দেবপ্রিয় বাস্তবিকই একদিন পা দেবে তার কল্পনার কাশ্মীরে।
এই ছবিগুলো সত্যি হওয়ার আগের কয়েকটা দিন ডানা মেলুক ওদের কল্পনা, কল্পনার পৃথিবীতে কোনো ভাইরাস নেই। অভিভাবকেরা একটু দেখবেন, সেই কল্পনার আকাশে যেন কোনও বাধা না আসে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy