পর্যটকদের চমক দেওয়ার জন্য ঐতিহাসিক প্রাগ শহরে রয়েছে রকমারি উপাদান। ছবি: পিক্স্যাবে।
কিছু দিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছিল। ভিডিয়োটি একটি রাস্তার। রাস্তার উপরে ট্র্যাফিক লাইট। ট্র্যাফিক লাইটের সঙ্কেত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের জন্য নয়। মানুষ চলাচলের জন্য। হ্যাঁ, রাস্তাটি এতই সঙ্কীর্ণ, দু’জন পাশাপাশি হাঁটা যায় না। আর সেই কারণেই আলোর ব্যবস্থা।
রাস্তাটি প্রাগে। বিশ্বের অন্যতম সঙ্কীর্ণ রাস্তা। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, শুধু ছোট রাস্তাই নয়, খেলনার মতো ছোট বাড়িও আছে প্রাগে। পর্যটকদের চমক দেওয়ার জন্য এই ঐতিহাসিক শহরে রয়েছে রকমারি উপাদান। অনেকেই জানেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেল্লা চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগে। স্থানীয়রা যাকে বলেন প্রাজস্কি হ্রা। গিনেস বুকের হিসেব অনুযায়ী এটি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ‘কাসল কমপ্লেক্স’। বহু পর্যটক এই প্রাগ কাসলে ভিড় জমান। কিন্তু সঠিক তথ্য না থাকার দরুন ‘মাস্ট সি’ তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায় ছোট রাস্তা কিংবা ছোট বাড়ি।
এই প্রতিবেদক প্রাগে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছে। প্রাগে থাকার সময় সঙ্কীর্ণ রাস্তা কিংবা ‘খেলনাবাড়ি’ দেখেছি। সঙ্কীর্ণ রাস্তার সামনে বেশ ভিড় হয়। কিন্তু বাড়িটির সামনে তেমন পর্যটক দেখিনি। আসলে পর্যটকদের অনেকেই এই ছোট বাড়িটির খবর রাখেন না। আর বাড়িটিও মূল সড়ক থেকে সামান্য দূরে, গলির ভিতরে। আসুন, আমরা সংক্ষেপে গলি এবং বাড়ি— দুই অভিনব দ্রষ্টব্যের আলোচনা সেরে নিই। প্রথম গন্তব্য ছোট বাড়ি, তার পর সঙ্কীর্ণ রাস্তা।
কেল্লার মতোই প্রাগের আর এক দ্রষ্টব্য ‘অ্যাস্ট্রোনমিকাল ক্লক’। এই ঘড়িঘর থেকে উত্তর-পূর্বে ভলতাভা নদীর ধার দিয়ে দিকে মিনিট দশেক হাঁটলে আনেস্কা স্ট্রিট। এই আনেস্কা স্ট্রিটেই রয়েছে ‘ন্যেমেনসি দ্যুম প্রাজা’ বা প্রাগের সবচেয়ে ছোট বাড়ি। চিনতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কারণ দু’টি সাধারণ মাপের বাড়ির মাঝে লিলিপুটের মতো এই দ্রষ্টব্য বিরাজমান। তা ছাড়া বাড়ির উপরে লাল ফলকে সবচেয়ে ছোট বাড়ির স্বীকৃতি হিসাবে ওই ‘ন্যেমেনসি দ্যুম প্রাজা’ কথাটিও লেখা রয়েছে।
বাড়িটি ছোট হলেও, এর ইতিহাস বেশ লম্বা। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া সংবাদ অনুসারে রাসনোভকা এলাকার চিক্যাভু ভবনে প্রবেশের দ্বিতীয় রাস্তা ছিল এটি। সেই গলির উপর বাড়িটি তৈরি হয় ১৮৫৩ সালে। চওড়ায় মাপ মাত্র ২.২৫ মিটার। নির্মাণকারী হিসাবে জোসেফ লিবেল নামের এক স্থপতির উল্লেখ রয়েছে। কারা থাকতেন এই বাড়িতে? একেবারে প্রথম দিকের ইতিহাস বিস্তারিত জানা না গেলেও, শোনা যায় ১৮৮৩ সাল থেকে বাড়িটি যৌনকর্হিমীদের আভাস হিসাবে চিহ্নিত ছিল। প্রায় চার দশক, অর্থাৎ ১৯২২ সাল পর্যন্ত এমনই পরিচিতিই ছিল। তার পর তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পর্যটকেরা এখন গেলে ছবিতে যেমন দেখা যাচ্ছে, তেমনই শুধু প্রবেশদ্বারের অংশটি দেখতে পাবেন। একটি দরজা রয়েছে। তবে সেটি সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য নয়। বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে। বাড়িটি বাইরে থেকে দেখে, এবং ছবি তুলেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এর বেশি কৌতূহল ভাল নয়। এলাকাটি ওল্ড টাউনের মধ্যে পড়ে। সংরক্ষিত এলাকা হওয়ার দরুন প্রায়ই পুলিশ টহল দেয়। সুতরাং, ইন্ডিয়ানা জোন্সের ডক্টর হেনরি ওয়াল্টনের মতো ইতিহাস সন্ধানে বাড়তি অ্যাডভেঞ্চারে প্রবৃত্ত হলে ফলাফল সুবিধার না-ও হতে পারে।
এই প্রসঙ্গে একটি হোটেলের কথা উল্লেখ করা দরকার। নাম ‘হোটেল ক্লিমেনটিন’। এটিও ওল্ড টাউনে, প্রাগ পুর গ্রন্থাগারের কাছে। দু’টি ভবনের মাঝে স্যান্ডউইচ হয়ে থাকা হোটেলটি মাত্র ৩.২৮ মিটার চওড়া। ‘ন্যেমেনসি দ্যুম প্রাজা’র অস্তিত্ব এখন খাতায়কলমে। সম্পূর্ণ বাড়িটির অস্তিত্ব নেই। কিন্তু হোটেল ক্লিমেনটিন, যাকে বলে সগৌরবে বিরাজমান! সেই হিসাবে চালু থাকা আবাস হিসাবে এটিই প্রাগের সঙ্কীর্ণতম বাড়ি।
এর পর আসা যাক সঙ্কীর্ণতম রাস্তায়। রাস্তাটির নাম ‘ভিনারনা চেরতোভকা’। ঠিক
কতটা চওড়া এই রাস্তা? স্কেল দিয়ে মাপার বদলে
বরং একটা আন্দাজ দেওয়া যাক। একটি আট কলাম খবরের কাগজের মাপ যেমন, এই রাস্তা তার
চেয়ে সামান্য চওড়া। সবচেয়ে বেশি প্রশস্ত অংশটি ৭০ সেন্টিমিটার। সুতরাং একটি মাত্র
মানুষই এই রাস্তা দিয়ে যেতে পারবেন। পাশাপাশি দু’জন নয়। কিংবা উল্টো দিক থেকে কেউ এসে পড়লে, কোনও এক জনকে
রাস্তার এক প্রান্ত পর্যন্ত পিছু হটতে হবে। এখানে এক জনের কথা বলা হল বটে, তবে
সকলের স্বাস্থ্য সমান নয়। রোগা-পাতলা হলে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু যদি তার উল্টোটা
হয়, তা হলে চিন্তার বিষয়। খুব ‘স্বাস্থ্যবান’ মার্কিন পর্যটক হাতে ওয়াফেল নিয়ে
রাস্তা পার হতে গিয়ে মাঝপথে থমকে গিয়েছেন, এমনও হয়েছে। সুতরাং নিজের মাপ এবং
রাস্তার মাপ বুঝে নিয়ে এখানে পা বাড়ানো ভাল।
মজার বিষয়, এই রাস্তায় আবার ট্র্যাফিক লাইট রয়েছে। এক ঝলক দেখে কেউ বলতেই পারেন, এ যেন ‘পালং শাকের ক্যাশমেমো’। যে রাস্তায় মানুষ ছাড়া কেউ যায় না, গাড়ি তো দূরের কথা, সাইকেল নিয়ে যাওয়ারও প্রশ্ন ওঠে না, সেখানে ট্র্যাফিক লাইটের কী প্রয়োজন? হ্যাঁ, প্রয়োজন আছে, এবং সেটা বেশ জরুরি। ধরা যাক সন্ধ্যা হয়েছে, আলো পড়ে এসেছে। রাস্তার উল্টো মুখে কে আছেন, অন্য দিক থেকে বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তার মাঝখানে দুই পথিক মুখোমুখি হয়ে গেলে, এক জনকে যথারীতি পিছনপানে হাঁটতে হবে। এই বিপত্তি এড়ানোর জন্য বসানো হয়েছে ট্র্যাফিক লাইট। কেউ হাঁটা শুরু করলে পথের প্রান্তে ট্র্যাফিক লাইটের বাটনে চাপ দিয়ে রাখেন। সবুজ সঙ্কেত লাল হয়ে যায়। উল্টো দিক থেকে তখন আর কেউ যাত্রা শুরু করেন না। তিনি গোটা রাস্তা পার হয়ে গেলে লাল সঙ্কেত সবুজ হয়। এবার উল্টো দিকের যাত্রী আবার একই পন্থায় হাঁটা শুরু করেন।
ভিনারনা চেরতোভকা একেবারে ভলতাভা নদীর পাড়ে। এই রাস্তা পেরোলে আপনি হাজির হবেন এক রেস্তরাঁর সামনে। রেস্তরাঁর সামনে একফালি ফাঁকা জায়গা। সেখান থেকে নদীর সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়। ‘চেরতোভকা’ আসলে একটি খালপথ। মধ্যযুগে যা তৈরি হয়েছিল। একসময় এটিকে বলা হত প্রাগের ‘লিটল ভেনিস’। শহর সংস্কারের পর ওই এলাকায় অনেক বদল হয়েছে। বিশেষত বন্যার কারণে হয়েছে রকমারি সংস্কার। কোনও কারণে রয়ে গিয়েছে ওই সঙ্কীর্ণ রাস্তাটি। কারও মতে একটি আসলে একটি ‘ফায়ার এসকেপ’। অগ্নিকাণ্ডের সময় নির্গমনের পথ।
ভলতাভার পাড়ে মালা স্ত্রানা খুবই জমজমাট এলাকা। চার্লস ব্রিজ, কাফকা মিউজ়িয়াম, লেনন ওয়াল– ‘ভিনারনা চেরতোভকা’র আশপাশে একাধিক দ্রষ্টব্য। পর্যটকদের মরসুমে এই সব এলাকা ভিড়ে ঠাসা থাকে। ‘ভিনারনা চেরতোভকা’র সামনেও পর্যটকদের ভিড় থাকে। ফলে কোনও কারণে কেউ যদি রাস্তাটি খুঁজে না পান, তা হলে মোবাইলে ম্যাপ-অ্যাপে ‘nejužší pražská ulička’ কথাটি লিখে দিলে স্মার্টফোন আপনাকে দিকনির্দেশ দিয়ে দেবে। চেক ভাষায় লিখিত বাক্যটির অর্থ প্রাগের সবচেয়ে সরু রাস্তা। রাস্তার নামের চেয়ে এখন তার শিরোপাই বেশি জনপ্রিয়। এর পর নিজের মাপ আর আলোর সবুজ সঙ্কেত দেখে হাঁটা শুরু করুন। শুভ যাত্রা!
(ছবিগুলি প্রতিবেদকের তোলা। শুধু হোটেল ক্লিমেন্টিনের ছবি সংগৃহীত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy