দু’চোখে গড়াচ্ছে জল। বছর নয়ের শিশুটি বলছে, ‘সে মরে যেতে চায়। কেউ যেন তাকে মেরে ফেলে।’ বেশ কিছু দিন আগে অস্ট্রেলিয়ার ওই শিশুটির ভিডিয়ো গোটা দুনিয়ায় আলোড়ন ফেলে। জিনগত রোগে বামনত্বের শিকার শিশুটি সহপাঠীর ‘বুলিং’-এর কারণেই এই ঘটনা বলে তার মা জানায়। ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন নয়। আজকের শিশু-কিশোর, যারা ভবিষ্যতে দেশের চালিকা-শক্তি, তাদের ঠিক ভাবে বেড়ে ওঠা, শিক্ষা অর্জনের পথে ‘বুলিং’-এর মতো ঘটনা এখন গোটা বিশ্বেই মাথাব্যথার কারণ।
সাধারণ ভাবে ‘বুলিং’ হল ক্ষতি করার ইচ্ছে নিয়ে কাউকে (সাধারণত সমবয়সি) শারীরিক বা মানসিক উৎপীড়ন বা হয়রানি করা। ‘বুলিং’ বিভিন্ন রকমের হতে পারে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারও গায়ে হাত দেওয়া, ধাক্কা মারা, লাথি মারা, ফেলে দেওয়া ইত্যাদি শারীরিক উৎপীড়নের উদাহরণ। আবার খারাপ কথা বলা, ভয় দেখানো, কটাক্ষ করা ইত্যাদি মৌখিক বিষয়গুলি মানসিক উৎপীড়নের মধ্যে পড়ে।
আবার, কারও সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেওয়া, সহপাঠীদের সঙ্গে মেশার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ শিশু-কিশোরদের আবেগের উপরে আঘাত করে। একে ‘রিলেশন্যাল বুলিং’ বা আবেগীয় উৎপীড়ন বলা হয়। বর্তমানে আরও এক ধরনের ‘বুলিং’ দেখা যাচ্ছে, যার নাম ‘সাইবার বুলিং’। এ ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ব্যবহার করে চলে ভয় দেখানো, হেয় প্রতিপন্ন করা বা মানসিক নির্যাতন।
‘বুলিং’-এর ঘটনা সাধারণত ১২-১৫ বছর বয়সিদের মধ্যে সব চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে বলে দেখা গিয়েছে। সমীক্ষা অনুযায়ী, ছাত্রছাত্রীদের কমবেশি ১০-২৫ শতাংশ কখনও না কখনও ‘বুলিং’-এর শিকার হয়। ছেলেদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা গেলেও মেয়েদের মধ্যেও তা বিরল নয়। কিশোরদের ক্ষেত্রে শারীরিক উৎপীড়ন এবং কিশোরীদের ক্ষেত্রে মৌখিক আক্রমণের ঘটনা বেশি ঘটে।
কারা এই জাতীয় অত্যাচারের শিকার হয়? দেখা গিয়েছে, সাধারণত শারীরিক বা মানসিক ভাবে দুর্বলেরাই হয়রানির শিকার হয়। শারীরিক ভাবে দুর্বল বা রুগ্ণ; অতিরিক্ত মোটা, বেঁটে; যারা কোনও শারীরিক বা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত, অন্যদের সঙ্গে সহজে মিশতে পারে না, বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা কম, জাতি-ধর্ম-বর্ণ ইত্যাদি কারণে ক্লাসে সংখ্যালঘু, তারাই সাধারণত এই ধরনের অত্যাচারের শিকার হয়। ‘বুলিং’-এর ফলে স্কুল না যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। পড়াশোনায় মনোযোগ কমতে থাকে। এর সঙ্গে খিদে ও ঘুমের সমস্যা, মানসিক অবসাদ ও উদ্বিগ্নতার সমস্যাও দেখা দিতে পারে। তীব্র মানসিক অবসাদ থেকে আত্মহত্যার ঘটনাও অস্বাভাবিক নয়। পাশাপাশি, শারীরিক সমস্যাও, যার মধ্যে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা অন্যতম, দেখা দিতে পারে।
অন্য দিকে, যারা এই ধরনের হয়রানি ঘটানোর মূলে, তারাও স্বাভাবিক নয়। অনেক ক্ষেত্রেই এদের মধ্যে ব্যক্তিত্বজনিত সমস্যা খুঁজে পাওয়া যায়। বিশেষ করে ‘অ্যাটেনসন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার’ (প্রধান লক্ষণ মনোযোগের অভাব, অতি চঞ্চলতা ও হঠকারী আচরণ), ‘কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার’ (প্রধান লক্ষণ অসামাজিক আচরণ, নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করা, আচরণে ঔদ্ধত্য, জীবজন্তু বা অন্য কোনও মানুষের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন ও ক্ষতি করার প্রবণতা, মিথ্যা কথা বলা, স্কুল থেকে পালানো, চুরি করা ইত্যাদি) রোগে আক্রান্ত শিশু-কিশোরদের মধ্যে অত্যাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়। আবার, ক্লাসে জনপ্রিয় হওয়ার লোভেও অনেক কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এই ধরনের ঘটনা ঘটানোর প্রবণতা দেখা যায়।
পাশাপাশি, বিভিন্ন সিরিয়াল, সিনেমা বা ভিডিয়ো গেমে দেখানো উৎপীড়ন বা ওই জাতীয় কোনও দৃশ্য শিশু-কিশোর মনে প্রভাব ফেলে, যেগুলি অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। বাবা-মায়ের কড়া শাসন, তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন, পারিবারিক অস্থিরতা, পরিবারের কোনও সদস্যের নেশা করার প্রবণতা ইত্যাদিও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এই জাতীয় প্রবণতাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। ‘বুলিং’-এর শিকার হওয়া শিশু-কিশোরেরা ভবিষ্যতে অন্য শিশু-কিশোরদের ‘বুলি’ করছে, এমনটাও অস্বাভাবিক নয়।
এখন প্রশ্ন, বিষয়টি রোধ করা কী করে সম্ভব। স্বাভাবিক ভাবেই বাবা-মা, শিক্ষক-শিক্ষিকার ভূমিকাই এখানে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময়ে শিশু ও কিশোরেরা বাবা-মাকে নিপীড়নের বিষয়ে বলতেও পারে না। এতে সমস্যা আরও বাড়ে। বাবা-মা, বাচ্চার সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশলে এমন ঘটনার আঁচ পাওয়া অনেক সহজ হয়। তাই সতর্ক থাকা দরকারি। হঠাৎ করে বাচ্চার পরীক্ষার ফল খারাপ হতে থাকলে, খিদে ও ঘুম কমে গেলে, স্কুলে যেতে না চাইলে, শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন ইত্যাদি খুঁজে পাওয়া গেলে তৎক্ষণাৎ খোঁজখবর নিন। নিয়মিত স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ জরুরি।
তবে মূল পদক্ষেপ প্রয়োজন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তরফেই। বন্ধুর সঙ্গে কী ভাবে মিশতে হয়, তা বাচ্চাকে শেখানো ও বন্ধুত্ব স্থাপনে উৎসাহিত করার দায়িত্ব তাঁদের নিতে হবে। শিক্ষক-ছাত্রদের সুসম্পর্ক, ক্লাস ও খেলার মাঠে উপযুক্ত নজরদারি এই জাতীয় ঘটনা কমাতে পারে। এ ছাড়া, ‘বুলিং’-এ জড়িত ছাত্রছাত্রীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কমায়।
আর অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে ‘বুলিং’ সম্বন্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমগুলিকেও এগিয়ে আসতে হবে। মোবাইল ও ইন্টারনেটের উপযুক্ত ব্যবহার, অতিরিক্ত ব্যবহারে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলির ‘বুলিং’-বিরোধী নিয়ম-নীতি প্রণয়ন ও সেগুলির ঠিকমতো রূপায়ণ ‘সাইবার বুলিং’-এর মতো সমস্যাগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে।
(ছবি: আইস্টক)
(মনোরোগ চিকিৎসক, বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy