গোটা রাজ্য জুড়ে হইচই, উন্মাদনা। উপলক্ষ এ বছর ২৬ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বি-শতবার্ষিকী উদ্যাপন। এই অবসরে একটু ফিরে তাকাই কেমন কেটেছিল মনীষীর জীবনের শেষ কয়েকটি বছর।
তাঁর শেষ জীবন মোটেই সুখে কাটেনি। জ্যেষ্ঠ সন্তান, একমাত্র পুত্র নারায়ণচন্দ্রের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্যাসাগর ১৮৭২ সালে তাঁকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেন। কিছু দিন পরেই মারা যান স্ত্রী দীনময়ী দেবী। নিঃসঙ্গ বিদ্যাসাগর একটু নির্জনতার সান্নিধ্যের জন্য বড়ই আকুল হয়ে উঠেছিলেন। নানা বিরূপ অভিজ্ঞতার ঘাত-প্রতিঘাতে নাগরিক জীবনের পরিসরে বীতশ্রদ্ধ বিদ্যাসাগর গ্রামের গার্হস্থ্য দৈনন্দিনেও অনেক অশান্তিতে আহত হন।
পারিবারিক জীবন ও চারপাশের পৃথিবীটা যখন ভীষণ ভাবে তাঁর কাছে প্রতিকূল হয়ে উঠেছিল, তখন তিনি অনেক দূরে শান্তির খোঁজে বর্তমান ঝাড়খণ্ডের কার্মাটাঁড়ে স্টেশনের কাছে পাঁচশো টাকায় স্থানীয় এক ইংরেজ মহিলার কাছ থেকে আমবাগান সমেত প্রায় ১৪ বিঘা জায়গা কেনেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর সেই জমি তিনি বিদ্যাসাগরকে বিক্রি করে চলে যান। এখানেই একটি ছোট বাড়ি তৈরি করেন বিদ্যাসাগর। নাম দেন নন্দনকানন। রাতের স্কুল চালানোর জন্য মাঝখানে একটি হলঘর, একপাশে শোবার ঘর, অন্যপাশে পড়ার ঘর। বাড়িতে ঢোকার ডান দিকে নিজের হাতে লাগিয়েছিলেন একটি কিষাণভোগ আমগাছও। বাগানের দেখভালের জন্য কালী মণ্ডল নামে এক মালিও ছিল তাঁর। কালীকে দিয়ে বাগানের শেষ প্রান্তে লাগিয়েছিলেন একটি ভাগলপুরি ল্যাংড়া আমগাছ। কার্মাটাঁড়ে বসেই তিনি ‘সীতার বনবাস’, ‘বর্ণপরিচয়’-এর তৃতীয় সংস্করণের প্রুফ দেখেছেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায় পাই— ‘‘বাঙালি উচ্চারণে কর্মাটা। আসল নাম কর্মাটাঁড়। অর্থাৎ কর্মা নামে এক সাঁওতাল মাঝির টাঁড়, মানে উঁচু জায়গা যা বন্যাতে কখনও ডোবে না।’’ কার্মাটাঁড় জায়গাটি ছিল সাঁওতাল প্রধান। তাঁদের সারল্যে মুগ্ধ হয়ে বিদ্যাসাগর বাকি জীবনটা সেখানেই কাটাবেন স্থির করেছিলেন। তা অবশ্য হয়নি। মাঝে মাঝে তাঁকে কলকাতায় আসতে হয়েছে। মৃত্যুও হয় কলকাতা শহরে।
সহজ সরল আদিবাসী মানুষের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন তিনি। দলে দলে সাঁওতাল বিদ্যাসাগরের কাছে আসতেন ভুট্টা বিক্রি করতে। আর বিদ্যাসাগর সেই ভুট্টা কিনে ঘরে রাখতেন। কাজ শেষে সাঁওতালেরা বিকেলে ঘরে ফেরার পথে খেতে চাইতেন বিদ্যাসাগরের কাছে। ওঁদের থেকে সকালে কিনে রাখা ভুট্টা খেতে দিতেন বিদ্যাসাগর। সাঁওতালদের সঙ্গে বিদ্যাসাগরও সেই ভুট্টা পুড়িয়ে খেতেন। এলাকার আদিবাসীদের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে তাঁদের কাছে জীবনদাতা ঈশ্বর হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সেখানে মেথরপল্লিতে উপস্থিত থেকে তিনি নিজের হাতে কলেরা রোগীর শুশ্রূষা করেছেন। বিদ্যাসাগর দেখেছিলেন তাঁদের সহজ, সরল জীবনযাত্রা। যেখানে ছিল না কোনও দ্বিচারিতা বা কপটতা। প্রতি বছর পুজোর সময়ে তিনি তাঁদের জন্য জামাকাপড় কিনতেন। শীতে কার্মাটাঁড়ে হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা। তখন মোটা চাদর কিনে গরিব মানুষের মধ্যে বিতরণ করতেন। কখনও কলকাতা গেলে তাঁদের জন্য বিভিন্ন রকম ফল নিয়ে আসতেন।
ভাই শম্ভুচন্দ্র স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘‘তিনি (বিদ্যাসাগর) প্রাতঃকাল হইতে বেলা দশ ঘটিকা পর্যন্ত সাঁওতাল রোগীদিগকে হোমিওপ্যাথি মতে চিকিৎসা করিতেন এবং পথ্যের জন্য সাগু, বাতাসা, মিছরি প্রভৃতি নিজে প্রদান করিতেন। অপরাহ্নে পীড়িত সাঁওতালদের পর্ণকুটিরে যাইয়া তত্ত্বাবধান করিতেন। তাহাদের কুটিরে যাইলে তাহারা সমাদরপূর্বক বলিত, ‘তুই আসেছিস!’ তাহাদের কথা অগ্রজের বড় ভালো লাগিত।’’
শম্ভুনাথকে বিদ্যাসাগর বলেন, ‘‘বড়লোকের বাটিতে খাওয়া অপেক্ষা এ সকল লোকের কুটিরে খাইতে আমার ভালো লাগে, ইহাদের স্বভাব ভাল, ইহারা কখনো মিথ্যা কথা বলে না। ইত্যাদি কারণে এখানে থাকিতে ভালোবাসি।’’ এই সাঁওতালদের মধ্যেই তাঁর শেষ দিনগুলির একটা বড় অংশ কাটান। সভ্যতার প্রান্তশায়ী আরণ্যক সাঁওতালদের সারল্য তাঁকে ভীষণ ভাবে মুগ্ধ করেছিল। যেমন করেছিল বিভূতিভূষণকে।
কার্মাটাঁড়ের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক ছিল প্রায় ১৭ বছরের। শরীর-স্বাস্থ্যের ভগ্নদশার কারণে ১৮৯০-এর গোড়া থেকে আর কার্মাটাঁড়ে বাস করেননি বিদ্যাসাগর। কার্মাটাঁড় স্টেশনের সঙ্গেও তাঁর নানান স্মৃতি জড়িত। এক দিন এক যাত্রী ট্রেন থেকে নেমে কুলি, কুলি বলে চেঁচাচ্ছিলেন। বিদ্যাসাগর কুলি সেজে সেই যাত্রীর মালপত্র বহন করেছিলেন। পরে সেই যাত্রী বিদ্যাসাগরের পরিচয় পেয়ে খুবই লজ্জিত হয়েছিলেন।
এখন কার্মাটাঁড়ের নাম বিদ্যাসাগর। রেল স্টেশনটির নামও বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরের প্রতিকৃতি ও পরিচয় স্টেশনটিকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। হালে বিদ্যাসাগর স্টেশন ভরে উঠেছে ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনের নানা পর্যায়ের রঙিন চিত্রে। প্ল্যাটফর্মের প্রাচীরের গায়ে একের পর এক ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে মনীষীকে। কোথাও তিনি ছেলেবেলার ঈশ্বর, কোথাও কার্মাটাঁড়ে আদিবাসীদের বন্ধু। একটি ছবিতে রয়েছে ‘বর্ণপরিচয়’-এর প্রচ্ছদ। রেলের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন সকলে। ছবির মাধ্যমে বলা হয়েছে এই মহান মনীষীর জীবনের কাহিনি।
ছেলে নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের মোটেই সুসম্পর্ক ছিল না। শেষ দিকে বিদ্যাসাগর ছেলের সঙ্গে বাক্যালাপও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পিতার মৃত্যুর পরেই নারায়ণচন্দ্র কার্মাটাঁড়ের বাড়ি ও সম্পত্তি বিক্রি করে দেন কলকাতার এক মল্লিক পরিবারের কাছে। তাঁরা বাড়িটি এমনিই ফেলে রাখেন। ১৯৩৮ সালে বিহারের প্রবাসী ও প্রতিষ্ঠিত বাঙালিরা তৈরি করেন ‘বিহার বাঙালি সমিতি’। বিহারের বাঙালি সমিতি সেখানে বিদ্যাসাগরের স্মৃতিরক্ষার জন্য উদ্যোগী হয়ে মল্লিক পরিবারের কাছ থেকে কিনে নেয় চব্বিশ হাজার টাকায়। সেখানে এই সমিতি বিদ্যাসাগরের মা ভগবতী দেবী নামাঙ্কিত একটি মেয়েদের স্কুল চালু করে। ২০০১ সালে বিহার ভেঙে ঝাড়খণ্ড হল। আলাদা করে তৈরি হল ‘ঝাড়খণ্ড বাঙালি সমিতি’। ঝাড়খণ্ড সরকারের সামাজিক নিবন্ধীকৃত আইনে ২০১৬-র অক্টোবর মাসে দুই বাঙালি সমিতির সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে ১১ সদস্যের ‘বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা সমিতি’। আদি ডিসপেনসারি চাপা পড়লেও হালে একটি ‘বিদ্যাসাগর হোমিও চিকিৎসালয়’ চালু হয়েছে।
এখন সমিতির সদস্যরাই দেখভাল করছেন এই সমিতি। বছরে তিনটি অনুষ্ঠান করেন ওঁরা। ২৯ মার্চ পাল করেন ‘গুরুদক্ষিণা দিবস’, ২৯ জুলাই বিদ্যাসাগরের মৃত্যুদিন আর ২৬ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন। শহর থেকে দূরে এক সহজ, সাধারণ, নির্জন, অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান। যে নির্জনতা পছন্দ করতেন বিদ্যাসাগর নিজের জীবনের শেষ দিনগুলোয়।
সঙ্গের ছবি: কলকাতার বাড়ি
(উদ্ধৃতির মধ্যে বানান অপরিবর্তিত)
শিকারপুর উচ্চ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy