মানুষ বড় হয় বটে, তার মনও কি একই সঙ্গে পুরোটা বড় হয়ে যায়? না কি, তার অন্তত একটা অংশ থেকে যায় শিশুই— যে হয়তো দামি পাথর ফেলে নিজের গোপন তোরঙ্গে জমিয়ে রাখে খোলামকুচি? মনের গোপন ঘরেও তেমনই রয়ে যায় কিছু অকিঞ্চিৎকর স্মৃতি, স্মরণীয় ঘটনার পাশাপাশিই। স্মৃতিকথা পড়ার মজা এখানেই।
বিশ্বজিৎ রায় খ্যাতনামা প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিকও বটে। সে সব গুরুতর লেখার বাইরে তাঁর স্মৃতিকথায় ঢুকে পড়ে কোনও এক ধনবান আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে তাঁদের বিলেতি বাথরুম ব্যবহার করার থতমত অভিজ্ঞতা। নিজের কথা প্রথম পুরুষে লিখেছেন বিশ্বজিৎ, যেন ছোটবেলার নিজেকে তিনি দেখছেন এক ভিন্ন মানুষ হিসাবে— যে ছিল, এখন আর পুরোটা নেই। আসলেই তো তাই— কালকের আমির উপরে সময়ের পরত পড়ে তবে তো তৈরি হয় আজকের আমি। পরিচিত, কিন্তু ভিন্ন। “সে শুনেছিল মাসতুতো দাদাদের ওই বাথরুমে কমোড আছে”— এই বিস্ময় তো সেই শিশুটিরই। অকিঞ্চিৎকর বিস্ময়ের স্মৃতি, কিন্তু তাকে ফিরিয়ে আনলে, এই একটা বাক্যেই বলে দেওয়া যায় অনেক কিছু: শিশুটির নিম্নমধ্যবিত্ত পারিবারিক অবস্থান, আত্মীয়দের মধ্যেও আর্থিক অবস্থার তারতম্যজনিত অলঙ্ঘ্য ব্যবধান, এবং সবচেয়ে বড় কথা, সময়।
ফুরোনো কথা
বিশ্বজিৎ রায়
৩২৫.০০
রাবণ
বইয়ের অনেকগুলি লেখারই কেন্দ্রীয় চরিত্র তাঁর বাবা। নিতান্ত সাধারণ এক মানুষ, জাগতিক সব ক্ষেত্রেই হেরে যাওয়া। রেডিয়ো, ঘড়ি, সাইকেল, এমন অকিঞ্চিৎকর জিনিসকে আঁকড়ে থাকা; নিখুঁত মাসকাবারি হিসাব আর রেডিয়োতে শোনা টেস্ট ম্যাচের স্কোর লিখে রাখা এক জন মানুষ— কোনও স্মৃতিকথাতেই জায়গা পাওয়ার কথা নয়, এমন এক জন। ব্যক্তিগত স্মৃতি যে হেতু সামাজিক গুরুত্বের তোয়াক্কা করে না, তাই বাবা চরিত্রটিকে কেন্দ্র করেও মফস্সলে ছোট চাকরি করা এক জন মানুষ জীবন্ত হয়ে ওঠেন। কোনও পাঠক সেই লেখাগুলি পড়ার সময় উঁকি দিতে পারেন তাঁর নিজস্ব স্মৃতির কুঠুরিতে, তুলে আনতে পারেন এমনই আর কারও কথা। এই মুহূর্তটিতে নিতান্ত ব্যক্তিগত হয়ে ওঠে সর্বজনীন।
আমার কথা
গণেশ হালুই
৩৫০.০০
দেবভাষা
শিল্পী গণেশ হালুইয়ের স্মৃতিকথার একটি লাইন, “এখনও ব্লিচিং পাউডারের গন্ধে রানাঘাট উদ্বাস্তু শিবিরের কথা মনে পড়ে”— এই কলমচিকেই যেমন মনে করিয়ে দিল সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কথা। কৈশোরে এক বার দিঘা বেড়াতে গিয়েছিলাম, মা-বাবার সঙ্গে, জুলাইয়ে। প্রবল বৃষ্টি আর এলোমেলো ঝোড়ো হাওয়া ছিল সে দিন, তার মধ্যেই হলিডে হোম থেকে হাঁটতে হাঁটতে সৈকতে গিয়েছিলাম। তিন দশকেরও বেশি সময় কেটে গিয়েছে তার পর, কিন্তু এখনও তেমন বৃষ্টিভেজা দিন এলেই মনে হয়, সমুদ্র বুঝি কাছেই। গণেশ হালুইয়ের স্মৃতিটি অবশ্য সুখের নয়: উদ্বাস্তু শিবিরের অসহায়তার আগে ছিল দেশভাগ, সংখ্যালঘুর যন্ত্রণা, পরিযাণ; আর পরে ছিল আর্ট কলেজের ফর্ম ভরার সময় ঠিকানার ঘরে বারো নম্বর প্ল্যাটফর্ম লেখার বাধ্যবাধকতা। লিখেছেন, ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসার সময় ‘আমার পড়ার ঘরের জানালায় কাঠের পাল্লার বাইরের দিকটায় আমার আঁকা কয়েকটা ছবি সেঁটে দিলাম’। সে কিশোর জানত, ফেরার পথ নেই আর— তবু স্মৃতিচিহ্ন রেখে যাওয়া। স্মৃতি কি শুধু মনের গহনেই থাকে?
কমার্শিয়াল আর্টের ছাত্র হলেন কলেজে, আঁকতে হবে বিজ্ঞাপনের ছবি। “তখনও পর্যন্ত টুথপেস্ট, পাউডার ইত্যাদি ব্যবহার করিনি কোনোদিন।... যে জিনিস কোনোদিন দেখিনি বা ব্যবহার করিনি তাকে নিয়ে বিজ্ঞাপনের কাজ করি কীভাবে?” উদ্বাস্তু নিম্নবিত্ত পরিবারের ১৯৫০-এর দশকের বহু নরনারীই নিজেদের মনে এই কথাটির প্রতিধ্বনি শুনতে পাবেন। কলকাতা তাঁদের সামনে অনেক রকম সুযোগের দরজা খুলে দিয়েছিল, কিন্তু পদে পদে মনেও করিয়ে দিত যে, তাঁরা বহিরাগত, এই শহরে তাঁদের মানাচ্ছে না। সেই যুদ্ধের স্মৃতি কি শেষ অবধি ব্যক্তিগত হয়?
আট দশকের উজান বেয়ে
নিখিল সুর
৩০০.০০
আশাদীপ
নিখিল সুর লিখেছেন, তাঁর শৈশবে মিলিটারি ট্রাক বোঝাই গোরা সৈন্যদের দিকে ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা দিয়ে ইংরেজি ‘ভি’ অক্ষর দেখালে তারা ছুড়ে দিত ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুটের প্যাকেট। এক দিন তেমনই এক প্যাকেট বিস্কুট কুড়িয়ে বাড়ি ফিরলে মা জানতে চাইলেন, ওটা কী? সৈন্যদের ছুড়ে দেওয়া বিস্কুট, জেনে সটান আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিলেন তিনি। এই আখ্যান পড়লে রমাপদ চৌধুরীর ‘ভারতবর্ষ’ গল্পটির কথা মনে না-পড়ে যায় না— ফারাক হল, সেই আন্ডা হল্টে ছুড়ে দেওয়া প্যাকেট ফেলে দেওয়ার কেউ ছিল না। আবার, সেই মফস্সলের স্কুলেরই এক মাস্টারমশাইয়ের বাগানে পেয়ারা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর কেমন সস্নেহে ব্যাগ বোঝাই করে পেয়ারা দিয়েছিলেন তিনি, আছে সে কথাও। বঙ্গজীবন তো এমনই ছিল— কখনও কঠোর, কখনও কোমল। সাত দশক পেরিয়ে এসেও স্মৃতি কেমন ভাবে জমিয়ে রাখে সেই সব অকিঞ্চিৎকর খড়কুটো, এই বইগুলো তারই প্রমাণ বহন করছে সর্বাঙ্গে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy