Advertisement
০৬ জানুয়ারি ২০২৫
Book Review

নিম্নবর্ণ ও বাংলার রাজনীতি

অয়ন গুহ তাঁর বইয়ের ভূমিকা ও উপসংহার নিয়ে আটটি অধ্যায়ে রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতি, জনসংখ্যা, সমাজ ও সংস্কৃতির আন্তঃসম্পর্ক স্থাপন করে পশ্চিমবঙ্গে জাতি-বর্ণের রাজনৈতিক গতিপথের ধারাবাহিকতা, পরিবর্তন ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার মূল্যায়ন করেছেন।

একসূত্রে: অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের সমাবেশ। কলকাতা, ২০১০।

একসূত্রে: অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের সমাবেশ। কলকাতা, ২০১০। —ফাইল চিত্র।

মেরুনা মুর্মু
শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:১৫
Share: Save:

বিশেষজ্ঞদের মতে পশ্চিমবঙ্গ এমন একটি রাজ্য যেখানে নিম্নবর্ণের মানুষরা জনসংখ্যার নিরিখে ভারতবর্ষে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও তাদের ক্ষমতায়নের জন্য কোনও বলিষ্ঠ রাজনৈতিক দল বা স্বতন্ত্র জাতিভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলন সে ভাবে গড়ে ওঠেনি। এ-হেন ‘ব্যতিক্রমী’ রাজ্যে প্রায় সাড়ে তিন দশক পর বামফ্রন্ট সরকারের নির্বাচনী পতনের ফলে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের উত্তরসূরি ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস মতুয়া-নমশূদ্র সম্প্রদায়ের জাতিভিত্তিক নাগরিকত্বের দাবিগুলিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গে জাতপাতের রাজনীতির উত্থানের সম্ভাবনা গড়ে ওঠে।

অয়ন গুহ তাঁর বইয়ের ভূমিকা ও উপসংহার নিয়ে আটটি অধ্যায়ে রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতি, জনসংখ্যা, সমাজ ও সংস্কৃতির আন্তঃসম্পর্ক স্থাপন করে পশ্চিমবঙ্গে জাতি-বর্ণের রাজনৈতিক গতিপথের ধারাবাহিকতা, পরিবর্তন ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার মূল্যায়ন করেছেন। ভূমিকার পর দ্বিতীয় অধ্যায় মতুয়া-নমশূদ্র সম্প্রদায়ের প্রাথমিক বর্ণভিত্তিক সঙ্ঘবদ্ধতা থেকে ক্রমশ দলিত মতুয়া পরিচয়ের হিন্দুকরণের কারণ ও গতিপথের বিশ্লেষণ করেছেন। অয়ন দেখান যে, ভারতীয় জনতা পার্টি বাংলাদেশ থেকে আসা মতুয়া-নমশূদ্রদের ‘হিন্দু উদ্বাস্তু’ হিসেবেই বিবেচনা করে এসেছে। তবে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (২০১৯) নাগরিকত্ব সম্পর্কে যে উদ্বেগের জন্ম দেয়, তার প্রেক্ষিতে হয়তো কৌশলগত কারণে জাত-বিরোধী চেতনা দ্বারা উদ্বুদ্ধ সমষ্টিগত পরিচয় উপেক্ষা করে মতুয়া আন্দোলনকারীরা হিন্দুত্ববাদী লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত হন। পূর্ব পাকিস্তানে ও পরবর্তী কালে বাংলাদেশে নমশূদ্রদের সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের সম্মিলিত স্মৃতির উত্থাপন করে হিন্দুত্বের পরিসরে আত্তীকরণ করা ও বর্ণচেতনাকে অতিক্রম করে ধর্মীয় চেতনা প্রতিস্থাপন করার বিজেপির এই রাজনৈতিক কৌশলকে লেখক ‘স্মৃতির রাজনীতি’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে এই মতুয়া রাজনীতি যে-হেতু জাতি-বর্ণের রাজনীতি ছেড়ে আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রতি আনুগত্য নির্দেশ করে, অতএব এটি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির এক নমনীয় সংস্করণ।

তৃতীয় অধ্যায়ে নির্বাচন কমিশনের তথ্যের বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যে, বাম দলগুলির ক্ষয়িষ্ণু নির্বাচনী শক্তির পরেও নিম্নবর্ণের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব বা ক্ষমতায়নের কোনও প্রসার ঘটেনি। লেখকের মতে এই স্থিতাবস্থা ইঙ্গিত করে যে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ‘জাতের উত্থান’ থিসিসটির কোনও ভিত্তি নেই এবং সাম্প্রতিক কালে মূলধারার নির্বাচনী রাজনীতির প্রেক্ষিতে জাতিবর্ণ বিষয়টি সমান অপ্রাসঙ্গিক। ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’কে আজও বিভাজনমূলক রাজনীতি হিসেবেই গণ্য করা হয়।

দ্য কিউরিয়াস ট্র্যাজেক্টরি অব কাস্ট ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল পলিটিক্স: ক্রনিকলিং কন্টিনিউটি অ্যান্ড চেঞ্জ

অয়ন গুহ

১৪৫.০০ ইউরো

ব্রিল

চতুর্থ অধ্যায়ে ১৯৩১ সালের জনগণনার সঙ্গে ২০১১ সালের আর্থ-সামাজিক-অর্থনৈতিক ও জাতি-বর্ণ গণনা এবং অন্যান্য রাজ্যের জাতি-বর্ণভিত্তিক জনসংখ্যার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে লেখক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, এই রাজ্যে জাতিবর্ণভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠনের বেড়ে ওঠার জন্য প্রতিকূল পরিবেশ এখনও গড়ে ওঠেনি। কারণ হিসেবে তিনি বৃহদায়তন প্রভাবশালী নিম্নবর্ণের অনুপস্থিতি; নিম্ন ও মধ্যবর্তী জাতিগুলির অসম ও সীমিত ভৌগোলিক বিস্তার এবং তাদের জনসংখ্যাগত প্রতিকূল বণ্টনের ধরনকে চিহ্নিত করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জাতিগত শ্রেণিবিন্যাস এবং বস্তুগত সম্পদ আহরণের মধ্যে যথেষ্ট সম্পর্ক থাকলে সামাজিক প্রতিবাদ ও রাজনৈতিক সঙ্ঘবদ্ধতা মৌলিক পরিচয়ের ভিত্তিতে সংগঠিত হতে পারে। পঞ্চম অধ্যায়ে তাই অয়ন পশ্চিমবঙ্গের দলিতদের অর্থনৈতিক অবস্থান নির্ণয় করে তার ভিত্তিতে সমন্বিত বর্ণভিত্তিক রাজনৈতিক উত্থানের সম্ভাবনার বস্তুগত বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, জমির মালিকদের জাতিগত অবস্থানে অমিল, অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে উচ্চবর্ণের দ্বারা নিম্নবর্ণের আপেক্ষিক কম বঞ্চনা, বিভিন্ন নিম্নবর্ণ গোষ্ঠীর অসম অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আলাদা অর্থনৈতিক দাবি এবং স্বতন্ত্র অভীষ্ট লক্ষ্য জাতিভিত্তিক রাজনৈতিক সংহতির পক্ষে প্রতিকূল।

ষষ্ঠ অধ্যায়টি তৃণমূল স্তরে জাতপাত, দলীয় রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা আছে। নদিয়া জেলার বেলিয়াডাঙা গ্রাম পঞ্চায়েতে নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে অয়ন দেখিয়েছেন, কী ভাবে প্রভাবশালী নমশূদ্র ও অধীন বাগদিদের মধ্যে ভদ্রলোক সংস্কৃতির রীতিনীতিকে আদর্শ বলে মনে করা হয়। উচ্চাকাঙ্ক্ষী নমশূদ্ররা আধিপত্যবাদী ভদ্রলোক সংস্কৃতির বিপরীতে একটি বিকল্প দলিত প্রতিসংস্কৃতি গড়ে তুলতে না পারায়, তাঁদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রান্তিকীকরণকে হাতিয়ার করে জাতিভিত্তিক রাজনৈতিক সংহতির সম্ভাবনাকে তাঁরা বাস্তবায়িত করে তুলতে পারেননি। উল্ল্যেখযোগ্য বিষয় হল লেখকের গ্রাম-বাংলায় যথার্থ বাস্তবচিত্র তুলে ধরা। বর্তমানেও কোনও ব্যক্তির রাজনৈতিক পার্টিতে বরাদ্দ ভূমিকা ও তাঁর কার্যকলাপের পরিসর, পৃষ্ঠপোষক-আশ্রিত সম্পর্কের নির্ণয় এবং গ্রাম-সীমানার সামাজিক কল্পনার ক্ষেত্রেও জাতি-বর্ণ অবস্থানই গুরুত্বপূর্ণ। তবুও গ্রামীণ সমাজে নিম্নবর্ণের চেতনায় ব্রাহ্মণ্যবাদী মূল্যবোধের গভীর অনুপ্রবেশের ফলে ভেদাভেদ ও বৈষম্যের অভিজ্ঞতা নিয়ে কোনও রাজনৈতিক চর্চা বা সামাজিক সংলাপ অনুপস্থিত।

সংগঠিত দলীয় রাজনীতি ও ভদ্রলোক সংস্কৃতির আন্তঃসম্পর্কের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে সপ্তম অধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতির শিকড় ও তার বিস্তার অন্বেষণ করতে অয়ন ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অবলম্বন করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কী ভাবে ভদ্রলোকের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, বাম রাজনীতি ও বামপন্থী মতাদর্শের গভীর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ফলে এই রাজ্যের মূলধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি জাতিবর্ণের ভেদাভেদের থেকে শ্রেণির বিভাজনকে বিশেষাধিকার দিয়েছে। ফলস্বরূপ, বামফন্টের নির্বাচনী পরাজয়ের পরেও রাজনৈতিক চর্চায় এমন কোনও মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি যা সামাজিক ন্যায় স্থাপনকে রাজনৈতিক কর্মসূচির অপরিহার্য অঙ্গ বলে মনে করে। ভদ্রলোক সংস্কৃতির কর্তৃত্ব যে শুধু ভিন্ন ধরনের রাজনীতির উত্থান হতে দেয়নি তা নয়, বাম-পরবর্তী যুগেও রাজনৈতিক বয়ানের পুনরুৎপাদন পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক সংস্কৃতির রূপান্তরের সম্ভাবনার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। লেখক এমনটাও মনে করেন যে, জাত-ভিত্তিক সঙ্ঘবদ্ধ রাজনীতির ভবিষ্যৎ এ রাজ্যে প্রায় নেই বললেই চলে। বরং হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান যে পরিচয়সত্তাভিত্তিক রাজনীতি প্রচার করছে তা জাতি-বর্ণগত পরিচয়কে হিন্দু পরিচয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। লেখকের মতে, রাজনৈতিক প্রতিপত্তির আশায় ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করতে হওয়াটাই এই রাজ্যের রাজনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের দিক নির্দেশ করে।

পরিশেষে বলতেই হয়, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে জাতপাতের প্রভাবের বিষয়ে গত এক দশকে বেশ কিছু চিন্তা উদ্রেককারী বই প্রকাশিত হলেও এই বইটি বিদ্যমান গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। বইটি মূলত সীমিত সম্প্রদায়ের উদাহরণ ব্যবহার করলেও এই রাজ্যে জাতভিত্তিক রাজনৈতিক সঙ্ঘবদ্ধতার অনুপস্থিতির বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টায় অনেকাংশে সফল। তবে কেবল গ্রামীণ ব্যবহারিক জীবনে জাতিভেদ প্রথার প্রভাব আছে এমনটা নয়। বর্ণদ্বন্দ্বজনিত সামাজিক ঘৃণা, অবজ্ঞা, হিংসা, নীরব বহিষ্করণ শহুরে পশ্চিমবঙ্গেরও প্রাত্যহিক জীবনের নির্মম সত্য। এখানকার সমাজচিত্তে জাতিবৈষম্য সূক্ষ্ম ও প্রচ্ছন্ন আকারে লুকিয়ে থাকে। যারা সয় তারাও বাড়তি তাচ্ছিল্যপূর্ণ ব্যবহার ও অবমাননার যন্ত্রণা সইতে চায় না বলেই তাদের হিরণ্ময় নাগরিক নীরবতা এই রূঢ় বাস্তবকে প্রকট হতে দেয় না মাত্র। শোনার জন্য সংবেদনশীল ‘কান পেতে’ও কেউ রয়েছে, এমনটাও নয়!

অন্য বিষয়গুলি:

book review Books Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy