ভারতীয় রাজনীতির একটা বড় মিথ-কে আবার সর্বসমক্ষে নিয়ে এলেন বজুভাই বালা। মিথ-টি হল রাজ্যপাল পদের ‘নিরপেক্ষতা’। ইস্কুলের বইতে এ কথা লেখা থাকে, শিশুপাঠ্যের বাইরে এলেই সেটা মিথ এবং মিথ্যা হয়ে যায়। দেশের অনেক প্রধানমন্ত্রীই তা মনে রেখেছেন, তবে নরেন্দ্র মোদী যে ভাবে প্রথম থেকেই রাজ্যপাল নির্বাচনে সতর্কতা ও পারদর্শিতা দেখিয়েছেন, তার তুলনা মেলা ভার। জানেন তিনি, বিপদেআপদে কারা তাঁকে দেখবেন, রাজ্যের মাথায় বসে সময়ে অসময়ে দলের স্বার্থ কারা আগলাবেন। কর্নাটকের রাজ্যপাল বজুভাইকে দেখেও তিনি নিশ্চয় ভাবছেন, ভাগ্যিস তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন, গুজরাত থেকে তুলে!
যে ভাবে কর্নাটকে বিজেপি নেতা ইয়েদুরাপ্পাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাজ্যপাল বজুভাই স্বীকৃতি দিলেন, সেটাকে, আর যা-ই হোক, নৈতিক বলা যায় না। সে রাজ্যে এ বার একক দল হিসেবে বিজেপি সবচেয়ে বেশি আসন (১০৪) পেলেও, সরকার গড়ার জন্য একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা (১১১) তাদের ছিল না। এ দিকে, অনেক কম আসন পেয়েও কংগ্রেস (৭৮) এবং জনতা দল-এস (৩৮) হাত মিলিয়ে ফেলেছে, যাকে বলে পোস্ট-পোল অ্যালায়েন্স বা ভোট-পরবর্তী সমঝোতা। তাদের জোট এই প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাইলফলকটি ছাড়িয়ে গিয়েছে। এবং তাদের বোঝাপড়াটা কাগজেকলমেই ঘটেছে। এই জোটের জোরে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী জেডিএস নেতা কুমারস্বামী গেলেন রাজ্যপালের কাছে সরকার গঠনের আবেদনপত্র জমা দিতে। তার পরই নাটক। রাজ্যপালের কাছে যিনি যথেষ্ট সংখ্যা নিয়ে সরকার গড়ার আবেদন জানাবেন, তাঁকেই সরকার গড়তে দেওয়ার কথা। অথচ বজুভাই অপেক্ষা করলেন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ইয়েদুরাপ্পার আবেদনের জন্য। এবং দ্বিতীয় আবেদনপত্রটি পাওয়ার পর বেমালুম সরিয়ে রাখলেন প্রথম আবেদনপত্রটিকে! দ্বিতীয় আবেদনকারীকেই সরকার গড়ার আহ্বান জানালেন তিনি, যদিও দ্বিতীয় জনের কাছে প্রয়োজনীয় বিধায়ক-সংখ্যা ছিল না (আর প্রথম আবেদনকারীর কাছে ছিল)!
‘সংখ্যা’ নেই বলে নিদানও দিলেন বজুভাই। পনেরো দিনের মধ্যে বিধানসভায় ‘ফ্লোর টেস্ট’ করতে হবে। পনেরো দিনে কোথা থেকে আসবে ‘সংখ্যা’, সে বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই, কেবল কাকে কত কোটি টাকা দিয়ে কেনা হবে, সেটাই আলোচ্য। ঘোড়া কেনাবেচার সময়ও যথেষ্ট, দুই সপ্তাহ! এ দেশে নাকি ওই সময়ের মধ্যে গোটা বিরোধী দলকেই ভাঙিয়ে আনা সম্ভব, টাকার সাপ্লাইয়ে যদি কমতি না থাকে। এত সুখ সয় না অবশ্য। প্রথম আবেদনকারীর পক্ষ আদালতে গেলে সুপ্রিম কোর্ট প্রথমেই ‘ফ্লোর টেস্ট’-এর সময়টা কমিয়ে দিল অনেকটা।
কিন্তু এ তো শুধু সময়ের প্রশ্ন নয়। কাকে ডাকা হচ্ছে, কাকে হচ্ছে না, এর মধ্যে একটা গুরুতর বিবেচনার প্রশ্ন আছে। সেই বিবেচনায় যদি রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের প্রদর্শন স্পষ্ট হয়ে যায়? সংবিধানের ৩৬১ নম্বর ধারা বলে দিয়েছে রাজ্যপালের কাজকর্মে আদালতও হস্তক্ষেপ করতে পারে না, কিন্তু তার মানে কি রাজ্যপাল যা খুশি তা-ই করতে পারেন? এই পরিস্থিতিতে রাজ্যপালদের কী করণীয়, কোন নীতি মানা উচিত, দেশের সংবিধান বা আদালত কি তা নিয়ে কোনও দিনও কিছু বলেনি?
বলেছে। সুপ্রিম কোর্টের অন্তত দু’টি মামলা মনে করা যায়। প্রথমটি ১৯৯৪ সালে এস আর বোম্মাই বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া মামলা। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজ্যপালদেরও সতর্ক করা হয়েছিল তাঁদের বিরাট দায়িত্ব মনে করিয়ে দিয়ে— তাঁদের কাজে যেন ‘রং’ (‘কালারেবল এক্সারসাইজ় অব পাওয়ার’) ধরা না পড়ে! ‘রং’ প্রসঙ্গে না বলে পারছি না। কর্নাটকে বিজেপিকে ডাকা হল, কেননা প্রয়োজনীয় ‘সংখ্যা’ না থাকলেও তারা ‘সিঙ্গল লার্জেস্ট পার্টি’, আর একই পরিস্থিতিতে গোয়াতে ২০১৭ সালে প্রয়োজনীয় ‘সংখ্যা’ না থাকলেও ‘সিঙ্গল লার্জেস্ট পার্টি’ কংগ্রেসের দাবি উপেক্ষা করে সেখানকার রাজ্যপাল সরকার গড়তে পরবর্তী দল বিজেপিকে ডাকেন! উল্লেখ্য, সে দিন গোয়ায় বিজেপি কোনও জোটই দেখাতে পারেনি, অথচ কর্নাটকে কংগ্রেস-জেডিএস জোট ‘সংখ্যা’র নিশ্চয়তা দেখানো সত্ত্বেও তাদের সরকার গঠন করতে দেওয়া হল না। এর পরও কি প্রশ্ন উঠবে, কে রং লাগাল বনে বনে?
সুপ্রিম কোর্টের ২০০৬ সালের রায়টি আরও প্রত্যক্ষ, আরও জরুরি। বিহারের রাজ্যপাল বুটা সিংহের জন্য ইউপিএ সরকারকে সুপ্রিম কোর্টের সজোর ভর্ৎসনা হজম করতে হয়েছিল। সে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে কেউ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার পর নীতীশ কুমার-বিজেপি জোট ১১৫ জনের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনের দাবি জানায়। বুটা সিংহ তখন বিধানসভা ভেঙে দেন, কেননা এই ভাবে সমর্থন ‘জোগাড়’ করাটা তাঁর কাছে ‘অগণতান্ত্রিক’ ঠেকেছিল। সর্বোচ্চ আদালত তাঁকে প্রবল বকুনি দেয় এই বলে যে, দু’টি দল যদি প্রয়োজনীয় ‘সংখ্যা’ নিয়ে তাঁর কাছে আবেদনপত্র পেশ করে, তিনি তা স্বীকার করতে সাংবিধানিক ভাবে বাধ্য। তাঁর কোনও অধিকার নেই নিজের ইচ্ছেমতো চলার, সুপ্রিম কোর্টের ভাষায় ‘হুইমস অ্যান্ড ফ্যান্সিস’ দেখানোর! তিনি ‘ড্র্যাস্টিক অ্যান্ড এক্সট্রিম’ কাজ করেছেন— বলেছিল আদালত, যার মধ্যে সংবিধানের ‘সাবভার্শন’ আছে। প্রসঙ্গত, এ বার কর্নাটকেও প্রয়োজনীয় সংখ্যা নিয়ে হাজির প্রথম আবেদনপত্রটি গৃহীত হয়নি রাজ্যপালের ‘হুইমস অ্যান্ড ফ্যান্সিস’-এর চোটেই।
না, কথাটা একেবারে ঠিক হল না। ‘হুইম’ এবং ‘ফ্যান্সি’, শব্দ দুটোর মধ্যে একটা তাৎক্ষণিকতার ব্যাপার আছে। বজুভাই বালাকে কেউ কোনও দিন তাৎক্ষণিক আবেগের কথা তুলে দোষারোপ করতে পারবে না। তাঁর আনুগত্য তিরের মতো ঋজু, পাথরের মতো কঠিন। যৌবনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সদস্য থেকে তিনি প্রৌঢ়ত্বে বিজেপি মন্ত্রিসভার আসনে পৌঁছন। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল-সূত্রে নরেন্দ্র মোদী যখন ২০০১ সালে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হতে আসেন, সেই সময়ে তাঁকে রাজকোটে নিজের জেতা আসনটি শ্রদ্ধাবশত ছেড়ে দেন বজুভাই। সেই অসাধারণ ত্যাগে মুগ্ধ হয়ে গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদী তাঁকে পুরস্কার দেন— নয় বছর টানা রাজ্যের অর্থমন্ত্রী। মোদীর তেরো বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বে আগাগোড়া বজুভাই তাঁর প্রধান অনুগতদের মধ্যে ছিলেন। মোদী-পরবর্তী গুজরাতে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবেও উঠে আসে তাঁর নাম। নানা বাধায় সেটা ঘটে ওঠেনি। সেই অপ্রাপ্তির দুঃখ ঘোচাতেই নাকি মোদীর সিদ্ধান্ত— দক্ষিণ ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্যটির রাজ্যপাল হিসেবে তাঁকে নিয়োগ।
বজুভাইয়ের কাজকর্ম দেখে সারকারিয়া কমিশনের কথাও মনে পড়ে। ১৯৮৩ সালের জুন মাসে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পর্যালোচনার জন্য তৈরি এই কমিশনে রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে অনেক জরুরি কথা ছিল। অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি এ বার সুপ্রিম কোর্টের সামনে সেই কথাগুলো তুলেছেনও। ভোটের ফলাফলে যদি কেউ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায় তবে রাজ্যপাল কাকে সরকার গড়তে ডাকতে পারেন, তার তালিকা করে দেওয়া হয়েছিল সেই রিপোর্টে, গুরুত্বের ভিত্তিতে পর পর: ১) সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া প্রাক-নির্বাচন জোট, ২) সংখ্যাগরিষ্ঠ দল, যদি তাদের পিছনে অন্য কারও ‘ফর্মাল’ বা লিখিত সমর্থন থাকে, ৩) সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া নির্বাচন-পরবর্তী জোট, ৪) নির্বাচন-পরবর্তী জোট, যদি তারা বাইরে থেকে সমর্থন পেয়ে বাঞ্ছিত সংখ্যায় পৌঁছয়। কুমারস্বামী যখন বজুভাইয়ের কাছে আবেদনপত্র নিয়ে যান, তখন সেটা তিন নম্বর-মার্কা দৃষ্টান্ত ছিল। রাজ্যপাল তা অগ্রাহ্য করে যে পথটা বাছলেন, সারকারিয়া কমিশন তাকে মান্যই করেনি।
আরও একটা কথা ছিল রিপোর্টে। রাজ্যপালকে হতে হবে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে নিরপেক্ষ ও রাজনীতি-সংযোগহীন মানুষ, সাম্প্রতিক অতীতে যাঁকে রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা যায়নি (আ ডিটাচড ফিগার উইদাউট ইনটেন্স পলিটিক্যাল লিঙ্কস, অর শুড নট হ্যাভ টেকন পার্ট ইন পলিটিকস ইন রিসেন্ট পাস্ট)। বজুভাই কি জানেন, কোন ভূমিকায় তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন? কিংবা তাঁকে অবতীর্ণ করানো হয়েছে? সন্দেহ হয়, তিনি কেবল একটি কথাই জানেন— ‘উপরওয়ালা’কে তুষ্ট করতে হবে, সেটাই তাঁর ভূমিকা। তাই বলছিলাম, দেশের অন্যতম বড় মিথ-টাকে মনে করিয়ে দিলেন বজুভাই বালা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy