Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

বাইকে রক্তের গ্রুপ লিখে ‘উড়ে চলে’ তরুণ চালক

জোরে গাড়ি চালালে অনেকে আলোচনা করেন। এমনটাই ভাবনা কমবয়সি বাইক চালকদের। ‘হিরোইজমে’র বিপদ নিয়ে ভাবেন না তাঁরা। বিপদমুক্তির সম্ভাবনার খোঁজে আনন্দবাজারবাইক নিয়ে কম বয়সিদের দৌড় এবং দুর্ঘটনা প্রায় সমার্থক হয়ে গিয়েছে। তমলুকের রাজ ময়দানে ট্রাফিক পুলিশের স্টলের বাইকটিও ছিল কম বয়সিদের।

সাবধানতায়: দুর্ঘটনাগ্রস্ত বাইক নিয়ে ট্রাফিক পুলিশের প্রচার। নিজস্ব চিত্র

সাবধানতায়: দুর্ঘটনাগ্রস্ত বাইক নিয়ে ট্রাফিক পুলিশের প্রচার। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৫৭
Share: Save:

মুজতবা আলী জানিয়েছিলেন কৌশলটির কথা। তাঁর ‘দেশে বিদেশে’ সফরনামায়। লেখক তখন বিপদে ভরা খাইবার গিরি সংকট পার হচ্ছেন। আর শুনছেন দুর্ঘটনার নানা কাহিনি। তখনই জানিয়েছিলেন কৌশলটির কথা। তিনি লিখেছিলেন, কোনও এক শৈলশহরে গাড়িচালকদের সচেতন করতে এবং ‘ড্রাইভারদের বুকে যমদূতের ভয় জাগাবার জন্য রাস্তার কর্তাব্যক্তিরা একখানা ভাঙা মোটর ঝুলিয়ে রেখেছেন— নিচে বড় বড় হরপে লেখা, সাবধানে না চললে এই অবস্থা তোমারও হতে পারে’।

সম্প্রতি পূর্ব মেদিনীপুরে ‘দেশে বিদেশে’র সেই সচেতনতার পদ্ধতিই দেখা গেল। সৌজন্যে জেলা ট্রাফিক পুলিশ। তাঁরা মুজতবার আলীর লেখা থেকে প্রভাবিত হয়েছিলেন কিনা জানা যায় না। কিন্তু পদ্ধতিগত দিক দিয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের ট্রাফিক পুলিশ আর ‘দেশে বিদেশে’র শৈলশহরের রাস্তার কর্তাব্যক্তিরা একই ভাবনা ভেবেছিলেন। কী করেছিলেন ট্রাফিক পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা? তমলুকের রাজ ময়দানের মেলায় তাঁরা স্টল দিয়েছিলেন। সেই স্টলে রাখা হয়েছিল একটি ভাঙাচোরা মোটর সাইকেল। দুর্ঘটনায় মোটর সাইকেলটির এরকম হাল হয়েছিল। অর্থাৎ সেই ‘দেশে বিদেশে’র বার্তা, ‘সাবধানে না চললে এই অবস্থা তোমারও হতে পারে’।

বাইক নিয়ে কম বয়সিদের দৌড় এবং দুর্ঘটনা প্রায় সমার্থক হয়ে গিয়েছে। তমলুকের রাজ ময়দানে ট্রাফিক পুলিশের স্টলের বাইকটিও ছিল কম বয়সিদের। গত ১ অক্টোবর তমলুক থানার আলিনান গ্রামে ভোরবেলা দু’টি মোটর সাইকেলের চার আরোহী দুর্ঘটনায় পড়েন। তাঁদের মধ্যে তমলুকের রত্নালি এলাকার বাসিন্দা ২৩ বছরের প্রসেনজিৎ কুণ্ডুর মৃত্যু হয়। বাকি তিনজন গুরুতর আহত হন। পুলিশ জানিয়েছে, হেলমেট না পরে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন দুর্ঘটনাগ্রস্তেরা। আর তাতেই ঘটে বিপদ। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ট্রাফিক পুলিশ দুর্ঘটনার একটি খতিয়ান দিয়েছে। সেই খতিয়ান অনুযায়ী, ২০১৬ সালে জেলার বিভিন্ন সড়কে মোট দুর্ঘটনা ঘটেছিল ৮১০টি। মৃত্যু হয়েছিল ৩৮৪ জনের। আহত ৭১৫ জন। ২০১৭ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা ৭১৫। মৃত্যু হয় ৩৫১ জনের। আহত ৫৪০ জন। পরের বছরে জেলায় ৫৬১টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। মৃতের সংখ্যা ৩২৩ জন। আহত ৫২৪ জন।

প্রশাসনের সূত্রের খবর, পশ্চিম মেদিনীপুরে বছরে গড়ে ৬৫৪টি দুর্ঘটনা ঘটে। বছরে গড়ে ৩৩৯ জনের দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। ৭১৬ জন জখম হন। প্রশাসনিক আধিকারিকদের আক্ষেপ, সন্ত্রাসবাদী হামলায় দেশে বছরে যত মানুষের মৃত্যু হয়, দুর্ঘটনায় তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। রাজ্যের ৪০টি দুর্ঘটনাপ্রবণ থানার মধ্যে পশ্চিম মেদিনীপুরেই চারটি। কোথাও বছরে ১০০টি, কোথাও বছরে ১৫০টিরও বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। ওই চারটি থানা হল খড়্গপুর লোকাল, গড়বেতা, শালবনি এবং মেদিনীপুর কোতোয়ালি। এই চারটি থানা এলাকাতেই জাতীয় সড়ক রয়েছে। খড়্গপুর লোকালের মধ্যে আবার ৬ এবং ৬০ নম্বর, দু’টো জাতীয় সড়ক রয়েছে। গত বছর খড়্গপুর লোকালে প্রায় ১৫০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। শালবনি, গড়বেতায় প্রায় ৮০টি করে। মেদিনীপুর কোতোয়ালিতে প্রায় ১০০টি। জেলা পুলিশের এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, জেলায় দুর্ঘটনাপ্রবণ থানা রয়েছে, এই তথ্যটাই দুর্ভাগ্যের।

এই পরিসংখ্যানের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বাইক দুর্ঘটনা। সে কথা স্বীকারও করা হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে। এক আধিকারিক জানান, দুর্ঘটনায় যাঁরা মারা যান, তাঁদের একটা বড় অংশই মোটরবাইক চালক কিংবা আরোহী। এঁদের ৮০ শতাংশ মাথায় আঘাত পেয়ে থাকেন। কারণ হেলমেট থাকে না তাঁদের মাথায়। এবং অনেকেই বেপরোয়া বাইক চালান।

হেলমেট না পরা, জোরে বাইক চালানোর প্রবণতা কম বয়সিদেরই বেশি। কেন এমন হয়? এ বিষয়ে মনোবিদ দীপঙ্কর পালের বক্তব্য, ‘‘বাইকের সঙ্গে অনেক কিছু জড়িয়ে থাকে। বাইক বড় হওয়ার প্রতীক। স্বাধীনতার প্রতীক এবং স্টেটাসের প্রতীক। স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েরা বাবা-মাকে চাপ দিয়ে এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা দিয়ে বাইক কিনছে। হিরোহিজম অ্যাচিভ করতে চাইছে।’’ বড় হচ্ছি, এই ভাবনাটা দোষের নয়। কিন্তু বেপরোয়া হওয়াটা তো অবশ্যই দোষের। তাতে নিজের সঙ্গে অন্যেরাও বিপদে পড়েন। এটা কেন হয়? দীপঙ্করবাবুর কথায়, ‘‘এটা এক ধরনের সামাজিক স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা। আমরা সকলেই সমাজে স্বীকৃতি পেতে চাই। সবসময় যে ইতিবাচক ভাবে পেতে চাই তা নয়। জোরে বাইক চালাচ্ছি, লোকে বলছে, দেখছে এমন ভাবনা থেকেও কম বয়সিরা বেপরোয়া হয়। অনেক সময়ে মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেও অনেক সময়ে বাইক নিয়ে নানা কসরত করে বিপদ ঘটায় কম বয়সিরা।’’ মনোবিদের কথায়, অনেকে মদের প্রভাবেও জোরে বাইক চালায়।

বেপরোয়া হলে যে মৃত্যুও হতে পারে সেটা কম বয়সিরা জানেন। দীপঙ্করবাবু একটি ঘটনার কথা বললেন। তিনি দেখেছেন, একটি ছেলে তাঁর বাইকে রক্তের গ্রুপ লিখে রেখেছেন বড় বড় করে। দুর্ঘটনা হলে রক্তের প্রয়োজনে যাতে দ্রুত ব্যবস্থা করা যায়। তবুও সেই ছেলেটি জোরে গাড়ি চালান। এই মনোভাবের সঙ্গে পুলিশের সাবধান বাণী কি কাজে লাগবে? দীপঙ্করবাবু বলেন, ‘‘সাময়িক কাজ দেবে। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে খুশির চোটে এই সাবধান বাণী কাজ করে না। চেতনা আনতে হবে ভিতর থেকে।’’

সেই চেতনা আনতে কাজ হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। পশ্চিম মেদিনীপুরে নতুন করে ট্রাফিক গার্ডের ১৮টি ইউনিট তৈরি করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ দিয়ে ৭৬২ জন সিভিক ভলান্টিয়ারকে ট্রাফিকের কাজে যুক্ত করা হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরে স্কুল, কলেজে শিবির করে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ চলে। কিন্তু কম বয়সিদের তাতেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এই কম বয়সিরা নাবালক। কলেজের পড়ুয়ারা আইনের দিক থেকে বাইক চালানোর যোগ্য। যদিও অনেকেরই লাইসেন্স থাকে না। স্কুল পড়ুয়ারা তো লাইসেন্সের দাবিদারও নয়। তবুও তারা রাস্তায় বাইক নিয়ে বেরোয়।

পশ্চিম মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠ (বালক)-এর প্রধান শিক্ষক অরূপ ভুঁইয়া এ বিষয়ে বলেন, ‘‘স্কুলে কোনও ভাবেই মোটর বাইক আনা যাবে না। কারণ স্কুলের ছেলে মেয়েরা আইন অনুযায়ী বাইক চালাতে পারে না। তবে একটা প্রবণতা দেখাই যায়, কম বয়সি ছেলেরা জোরে গাড়ি চালাচ্ছে। হেলমেট নেই। এদের হাতে বাইক তুলে দিচ্ছেন অভিভাবকেরাই। হয় তাঁরা ইচ্ছে করে দিচ্ছেন। নয়তো সন্তানদের চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।’’

এর কি কোনও ভাবেই সুরাহা নেই? প্রধান শিক্ষক সচেতনতার কথাই বললেন। জানালেন, এর জন্য সচেতনতা প্রয়োজন। সেই সচেতনতায় সামিল করতে হবে অভিভাবকদেরও।

তথ্য: বরুণ দে, আনন্দ মণ্ডল

অন্য বিষয়গুলি:

Road Safety Road Accident Tamluk
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy