প্রতীকী ছবি।
নারীর আব্রু রক্ষার্থে, সমাজে নারীদের প্রাপ্য সম্মান জানাতে সম্প্রতি মহারাষ্ট্র ইউনিভার্সিটি অফ হেলথ সায়েন্সেস (এমইউএইচএস) ডাক্তারি পাঠ্যপুস্তক থেকে কুমারীত্বের চিহ্ন পরীক্ষা বা দুই আঙুলের পরীক্ষা (two finger test বা PV), বিষয়ে অধ্যায়গুলি অপসারণের অনুমোদন দিয়েছে। দেশের মধ্যে সর্বপ্রথম মহারাষ্ট্র স্বাস্থ্য দফতরের এই সাহসী সিদ্ধান্তের ফলে মহারাষ্ট্রের হবু ডাক্তারদের আর নারীর প্রতি অসম্মানজনক এই বিতর্কিত পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে পড়তেই হবে না। নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ।
আসলে কোনও মহিলা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন কিনা, তা বুঝতে দীর্ঘদিন ধরে দুই আঙুলের পরীক্ষার উপরেই নির্ভরতা রাখতেন ডাক্তাররা। যদিও এটি একটি অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, যা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে এবং কোনও ভাবেই যৌন নির্যাতনের তদন্তে সহায়তা করে না। অভিযোগকারী নারীর উপর এই পরীক্ষা রীতিমতো মানসিক অত্যাচার। সর্বোপরি, আইনের রক্ষাকবচ (sec 1 of IPC) না থাকলে এই জাতীয় নিরীক্ষা কালে নারীর গোপনাঙ্গে দুই আঙুল প্রবেশের দ্বারা পরীক্ষা যৌন নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছু নয়। আসলে ‘পিভি’ হল একটি অনধিকার প্রবেশমূলক শারীরিক পরীক্ষা যার দ্বারা নারীর যৌন অঙ্গের পেশিগুলির শিথিলতার পরিমাপ করে দেখা হয় যে, অভিযোগকারিণী যৌন সঙ্গমে অভ্যস্ত কিনা এবং এই অনুসারে ধর্ষণ হয়েছেন কিনা নিশ্চিত করা। কিন্তু নির্যাতিতার যৌন ইতিহাস ধর্ষণের পরীক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখ করা খুবই অমানবিক ও বর্বরোচিত কাজ। কারণ যৌন সহিংসতার মূল বিবেচ্য বিষয় হল অসম্মতিতে যৌনাচার।
তা ছাড়া, ধর্ষণের সঙ্গে ভার্জিনিটির কোনও সম্পর্ক নেই৷ একজন বিবাহিত নারী ধর্ষণের শিকার হতে পারেন। আবার একজন যৌনকর্মীও ধর্ষণের শিকার হতে পারেন। আর এই অযৌক্তিক, অমানবিক, বিতর্কিত পদ্ধতির মাধ্যমে প্রমাণের চেষ্টা চলত অভিযোগকারিনী যৌনাচারে অভ্যস্ত কিনা। যৌন হিংস্রতার শিকার হওয়া একটি ছোট্ট শিশু কন্যার অভ্যস্ত হওয়ার ইতিহাস বিচার করা, সভ্য সমাজের সুস্থতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। ২০০৩ সালে (sec 146 of Indian Evidence Act ) ধর্ষণের বিচারের ক্ষেত্রে লাঞ্ছিতার অতীত যৌন ইতিহাস উল্লেখ নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও টু ফিঙ্গার টেস্ট -এর চিকিৎসা অভিমত সাক্ষ্য প্রমাণকে পক্ষপাত দুষ্ট করে তুলছিল। দেশের আইনব্যবস্থা জেগে ঘুমিয়ে থেকে ‘পিভি’র নামে নারীর অতীত যৌন ইতিহাস দেখতে আগ্রহী ছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত দিল্লির রাজপথে হাড় হিম করা ঘটনা ঘটছে। দিল্লি গণধর্ষণ কাণ্ডের নৃশংসতার পরে বিভিন্ন আন্দোলনের ফলস্বরূপ যৌন হিংস্রতা সম্পর্কিত আইন ঢেলে সাজানো হয়। ২০১৩ সালে ফৌজদারি আইন সংশোধনী (Criminal Law Amendment Act) পাশ হয় এবং ভারতের সর্বোচ্চ আদালত আরও অধিকতর মাত্রায় নিগ্রহ ও মর্যাদা লঙ্ঘন থেকে জীবিত নির্যাতিতাকে রক্ষা করার জন্য, অমর্যাদাকর ‘দুই আঙুলের পরীক্ষা’ নিষিদ্ধ করে। তা ছাড়া এই অবৈজ্ঞানিক পরীক্ষাটি শুধুমাত্র নারীর গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারকে (ধারা ২১, সংবিধান)লঙ্ঘন করে তাই নয়, নারীর শারীরিক, মানসিক সম্পূর্ণতা ও সম্মান রক্ষা করে না। কারণ নারীর গোপনাঙ্গ ডাক্তারের সামনে কেবল চিকিৎসার জন্যই অনাবৃত হতে পারে নিরীক্ষার জন্য নয়।
শীর্ষ আদালতের দ্বারা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ‘দুই আঙুলের পরীক্ষা’কে আঁস্তাকুড়ে পাঠানোর পরেও বহাল তবিয়তে এই পাঠক্রম ডাক্তারি শাস্ত্রে বিদ্যমান এবং অনেক ক্ষেত্রেই প্রশাসনিক তৎপরতায় এই পরীক্ষা ধর্ষিতার উপর হতে দেখা গিয়েছে। অনেক ধর্ষিতাকেই বলতে শোনা গিয়েছে, উক্ত পরীক্ষা কালে তাঁকে শান্ত ভাব করে শুয়ে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় তাঁকে চড় মারা হবে বলে শাসানো হয়েছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যৌন হিংস্রতার ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে নয়, ধর্ষিতা নারীর উপরই প্রমাণের দায়িত্ব বর্তায়। ২০১৮-র ডিসেম্বরে, মহাত্মা গাঁধী ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস (সেভগ্রাম)-এর ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক, ইন্দ্রজিৎ খাণ্ডেকর মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া, ইউনিয়ন হেলথ মিনিস্ট্রি ও এমইউএইচএস-এর কাছে ‘পিভি’ পুরোপুরি ভাবে তুলে দেওয়ার আবেদন জানান। এই পরীক্ষার মাধ্যমে কোনও ভাবে কারও উপর ধর্ষণ হয়েছে কিনা, তা নির্ভুল বোঝা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি। শুধু তাই নয়, ডাক্তারি সিলেবাসে নারীর কুমারীত্ব নির্ধারণের বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ চিহ্ন নিয়ে পুরো একটা অধ্যায় রয়েছে, যা থেকে পরীক্ষায় প্রশ্নও করা হয়। তাঁর অভিযোগ এই অধ্যায়টি সমাজে ও হবু ডাক্তারদের মনে ভুল ধারণা ও লিঙ্গবৈষম্য জাগিয়ে তুলছে। এবং অভিযোগটি কিন্তু সর্বৈব সত্য। কারণ, মানবিক মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার সকলের আছে। মজার ব্যাপার হল, পুরুষদের ‘ট্রু ভার্জিন’ আর ‘ফলস্ ভার্জিন’ নির্ধারণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিন্তু ডাক্তারি শাস্ত্রে নেই, যা আছে তা শুধু নারীজাতির জন্য। অনভিপ্রেত ভাবে পুরুষতন্ত্রবাদ ডাক্তারির শাস্ত্রের বিজ্ঞাননির্ভর পাঠক্রমেও তার শিকড় গেঁড়ে বসে আছে ও সংবিধানের ধারা ১৫-কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে।
‘কুমারীত্ব’ শব্দটি চিকিৎসা শাস্ত্র বা বিজ্ঞানের শব্দ নয়। বরং, কুমারীত্ব বা অক্ষুণ্ণ যোনিপথ নারীর সতীত্বের প্রমাণ— ধারণাটি একটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় শব্দ। যা স্ত্রী-জাতির বিরুদ্ধে লিঙ্গ বৈষম্যকে প্রতিফলিত করে এবং তাঁর চরিত্র ও বিবাহযোগ্যতার চিহ্ন বহনকারী। এই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুধুমাত্র নারীর মানবিক অধিকার লঙ্ঘন করে তাই নয়, ধর্ষিতার সঙ্গে প্রকৃত যৌন নির্যাতনের অনুকরণ যাতে নির্যাতিতাকে আবার সেই ঘৃণ্য ঘটনার নিদারুণ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। নিগৃহীতা নারীকে ফলস্বরূপ শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক উদ্বেগ, বিষণ্ণতা ও ঘটনা পরবর্তী মানসিক পীড়নের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয় বা ‘সম্মান রক্ষার্থে হত্যা’র শিকার হতে হয়।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সংস্থা, ইউএন ওম্যান এবং হু, কুমারীত্ব পরীক্ষার অবসান এবং নারীজাতির অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে বিশ্বের সমস্ত দেশের সরকারের কাছে কুমারীত্ব পরীক্ষা নিষিদ্ধ আইন প্রণয়ন ও কঠোর ভাবে প্রয়োগ করার আবেদন করেছে অনেক আগেই। ২০১৪ সালে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের স্বাস্থ্য গবেষণা বিভাগের (ডিএইচআর) এবং ভারতীয় মেডিক্যাল কাউন্সিলের (আইসিএমআর) বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় এ ব্যাপারে জাতীয় নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। আমরা আশাবাদী এই ভয়াবহ চিকিৎসা প্রক্রিয়া শেষ হবে। সময় এসেছে সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে, নারীর যৌনতা ও শরীর নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত লিঙ্গ বৈষম্যমূলক মিথকে চ্যালেঞ্জ জানানোর। ভার্জিনিটি একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়।
দুর্ভাগ্যবশত, এমইউএইচএস -এর সিদ্ধান্ত শুধু মহারাষ্ট্রেই প্রযোজ্য হবে। ডক্টর খাণ্ডেকর দেশের সুপ্রিম কোর্ট এবং কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে এমবিবিএস পাঠ্যপুস্তক থেকে এই বিষয়টিকে অপসারণের আহ্বান জানিয়েছেন। আশা করা যায়, চিকিৎসা বিদ্যায় অপ্রয়োজনীয় বেদনাদায়ক ভয়ঙ্কর রীতিটির পঠনপাঠন অবশ্যই সমূলে উৎপাটন হবে এবং গোটা দেশেই এর প্রয়োজনীয়তা মেনে নেবে। সিদ্ধান্তটি কার্যকর হওয়ার মাধ্যমে নারীজাতি তাঁর প্রাপ্য সম্ভ্রম পাক।
শিকারপুর উচ্চ (উচ্চতর) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy