Advertisement
E-Paper

বন্দনাবিতণ্ডা

একাধিক পক্ষ একাধিক ক্ষেত্রে আপত্তি উঠিয়েছে ন্যূনাধিক এক শতাব্দীকাল যাবৎ। উঠিয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তারা, কিংবা অন্যান্য ধর্মে বিশ্বাসীরাও।

—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৪:২৯
Share
Save

বিতর্কে বাঙালির বিশেষ ব্যুৎপত্তি। নানা বিষয়ে নানা মত নানা তর্কের অবতারণা যেন বাঙালি সংস্কৃতির অচ্ছেদ্য অঙ্গ। লক্ষণীয়, তার পর সেই বিতর্কের মীমাংসাও কিন্তু সেই সংস্কৃতিরই আর একটি বিশেষ চরিত্র। ঘুরে ঘুরে সেই একই ট্র্যাডিশন চলেছে। বসন্ত পঞ্চমীর পুণ্য তিথিতে বাগ্‌দেবীর আরাধনা নিয়েও সেই ট্র্যাডিশন থেমে থাকেনি। বিশ এবং একুশ শতকের বাঙালির ইতিহাস নাড়াচাড়া করলে দেখা যাবে, সরস্বতী পুজো নিয়ে কত রকম প্রশ্ন, সংশয়, এমনকি সংঘাত উপস্থিত হয়েছে বার বার। কয়েক বছর আগে এই কলকাতারই দক্ষিণ প্রান্তের এক কলেজে হইচই শুরু হয়, কোনও শিক্ষায়তনে আদৌ কেন পুজো হবে, তা নিয়ে। তার পর মহানগরের তথাকথিত শ্রেষ্ঠ কলেজটিতেও দেখা গিয়েছিল এই একই ঘটনা। অশান্তির উৎস: যে কোনও ধর্মাচারের ঊর্ধ্বে বিদ্যায়তনের সংস্কৃতির স্থান হওয়ার কথা, তা হলে স্কুল-কলেজে পুজো-আর্চা কেন। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেও গত বছরে সরস্বতী পুজোর সঙ্গতি নিয়ে এমনই বিতর্কের আবহে লেখা হয়েছে যে, এই পুজোর মধ্যে আসলে ধর্মীয় আরাধনার থেকে বেশি— ধর্ম-উপলক্ষ করে ধর্ম-অতিক্রমী এক সাংস্কৃতিক উদ্‌যাপন, যাতে অন্য ধর্মের মানুষজন যোগ দিতে পারেন সহজে, স্বাভাবিক আনন্দে। তবু এই প্রশ্ন যে ওঠে, তার মধ্যেও অভ্রান্ত স্বাক্ষর বাঙালির চিন্তনশক্তির, সামাজিক প্রথাকে প্রশ্ন করার উদ্যমের। এই বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি: দুই পক্ষের সংঘাত হাই কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে।

তবে এ কথা ভাবলে ভুল হবে যে, সরস্বতী আরাধনায় বাধা এসেছে কেবল একটি বিশেষ ধর্মের পক্ষ থেকে। একাধিক পক্ষ একাধিক ক্ষেত্রে আপত্তি উঠিয়েছে ন্যূনাধিক এক শতাব্দীকাল যাবৎ। উঠিয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তারা, কিংবা অন্যান্য ধর্মে বিশ্বাসীরাও। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯২৮ সালে বঙ্গীয় সমাজে বাগ্‌দেবীর পূজার্চনাকে ঘিরে উত্তেজনার বারুদ হুহু করে বেড়েছিল, যার এক দিকে ছিল ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত একটি কলেজ, অন্য দিকে হিন্দু ছাত্রছাত্রীরা। কেবল তা-ই নয়, এই নিয়েই শেষ পর্যন্ত তীব্র মতসংঘাত বেধেছিল বাঙালির দুই শ্রেষ্ঠ যুগপুরুষের মধ্যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সুভাষচন্দ্র বসু। সিটি কলেজের রামমোহন রায় হস্টেলে সরস্বতী পুজোর পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আপত্তি তুলেছিলেন কর্তৃপক্ষ, কেননা সেটি ব্রাহ্ম সমাজ পরিচালিত কলেজ। এ দিকে ছাত্রছাত্রীদের বক্তব্য ছিল, কলেজের কার্যক্রমে তাদেরও সমান অধিকার, সুতরাং পুজোয় বাধাদান অকর্তব্য। বিষয়টি এত দূর গড়ায় যে কর্তৃপক্ষ পুজো না করতে দেওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরা কলেজ ছাড়িয়ে ছেলেমেয়েদের অন্যত্র ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নেন। এক সম্পদশালী হিন্দু ব্যক্তি এই কলেজের উন্নতিকল্পে বড় অঙ্কের অর্থদান করেছিলেন— এই ঘটনার অভিঘাত এত দূর গড়ায় যে তিনি সম্পূর্ণ টাকা ফেরত চান, সুদসমেত। তরুণ নেতা সুভাষচন্দ্র মনে করেছিলেন, পুজো হওয়াই উচিত, এই নিয়ে হিন্দু-ব্রাহ্ম সংঘাতের কোনও অর্থ থাকতে পারে না। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়েছিলেন ঠিক বিপরীত যুক্তিটি। প্রবাসী পত্রিকায় একটি তির্যকতাপূর্ণ প্রবন্ধ লেখেন তিনি, যেটি আবার অনূদিত হয়ে মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় ছাপা হয়। স্বরাজে বিশ্বাসের সঙ্গে কি অপর কোনও গোষ্ঠীর বিশ্বাসের অধিকার অস্বীকার করার সংযোগ আছে: সুভাষচন্দ্রের দিকে ধাবিত হয়েছিল তাঁর কঠিন প্রশ্ন।

প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বারংবার এই প্রশ্ন নানা ভাবে উঠে এসেছে— ধর্মাচারের অধিকারের নামে জাতীয় কার্যক্রমে কতখানি পরিসর পাওয়া যাবে, ভিন্ন ধর্মের আচারের সঙ্গে সংঘাত লাগলে তার সমাধান কী, ইত্যাদি। পরবর্তী কালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীকচিহ্নে সরস্বতী দেবীর মূর্তি নিয়েও বিপুল বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছিল। যে রবীন্দ্রনাথ উনিশশো কুড়ির দশকের শেষে ব্রাহ্ম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পুজোয় আপত্তি করেছিলেন, এবং সুভাষচন্দ্র তাঁর বিরুদ্ধতা করেছিলেন, উনিশশো ত্রিশের দশকের শেষে ‘বন্দে মাতরম্’ গানের একাংশে ভিনধর্মীদের আপত্তি মান্য করে চলার সিদ্ধান্ত নেন সেই রবীন্দ্রনাথেরই সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসু ও জওহরলাল নেহরু। বাঙালির ইতিহাস বুঝিয়ে দেয়, বিতর্ক কোনও ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী বিষয় নয়, বরং সুস্থ স্বাভাবিক চিন্তার চলন। তবে স্থিতবুদ্ধি মীমাংসা চাই। সে দিনের কিছু নেতা তা বুঝেছিলেন। সেই সুবিবেচনার ধারা কোথায় গেল, তা ভাবার দায় আজকের নেতাদের, নাগরিকদেরও। পরস্পরের সঙ্গে মতের অনৈক্য ঘটা স্বাভাবিক, তবে তা মেটানোর পথ বার করতে হয়, করা যায়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

saraswati puja

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}