স্বাস্থ্য-সচেতনতা নিয়ে কেন্দ্রের পত্রিকার বাংলা সংস্করণ।
কালিদাস ‘রঘুবংশম্’ কাব্যের সূচনায় বলিয়াছেন, যাঁহারা বাক্ ও অর্থের ন্যায় সম্পৃক্ত, সেই পার্বতী ও পরমেশ্বরের বন্দনা করি। ভাগ্যিস কালিদাসের কাল গিয়াছে। সম্প্রতি বঙ্গে অর্থহীন বাক্-এর বন্যা আসিয়াছে। কখনও বিজ্ঞাপন, কখনও বক্তৃতা, কখনও বা আস্ত বই নির্মিত হইতেছে অর্থহীন শব্দ, বাক্য, অনুচ্ছেদ দিয়া। অর্থহীনতা সুপ্রযুক্ত হইলে কৌতুকের খোরাক হইতে পারে। ‘কুমড়োপটাশ’ কথাটি সে যুগের শব্দকোষে মিলিত না, কিন্তু তাহা কল্পনাকে উসকাইয়া দিয়াছিল, হাসিরও উদ্রেক করিয়াছে। লুইস ক্যারলের ‘জ্যাবরওয়াকি,’ ও তাহার অনুসরণে সত্যজিৎ রায়ের ‘জবরখাকি’ আজগুবি শব্দ উদ্ভাবন করিয়াছে, অথচ ধ্বনিমাহাত্ম্যে তাহা অব্যর্থ— রহস্যময় অরণ্যে এক ভয়ানক জীবের সহিত যুদ্ধের বিবরণ পাঠকের নিকট ঠিকই পৌঁছাইয়াছে। ‘গালুম্ফিয়ে’ বা ‘হিলবিলিয়ে’ ভাষার বোধকে আহত করে নাই, প্রমিত ভাষার সীমান্তে ঢেউ তুলিয়া খেলা করিয়াছে। জনস্বাস্থ্য বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের পুস্তকে ‘জলয়োজন’ বা ‘ফল্সপ্রবণ’ শব্দগুলি দেখিলে কিন্তু মনে তেমন বিস্ময়-কৌতুক খেলিয়া যায় না। বিরক্তি ও ক্ষোভের উদ্রেক হয়। ভাষার প্রতি তাচ্ছিল্য নিজেরই অপমান মনে হইতে থাকে। এত অশ্রদ্ধা কেন?
অনেকে বলিবেন, ইহা যন্ত্রের দোষ। যন্ত্রের দ্বারা অনুবাদ কেমন দাঁড়াইবে, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় গল্পের ছলে বলিয়া গিয়াছেন। ইংরেজি হইতে নানা ভাষায় তরজমার পর ফের ইংরেজিতে আগের বাক্যটি ফিরিয়া পাইলে যন্ত্র পাশ করিবে। পরীক্ষায় ‘আউট অব সাইট, আউট অব মাইন্ড’ ফিরিয়া আসিয়াছিল ‘অন্ধ উন্মাদ’ হইয়া। অনুবাদ তত্ত্ব বলে: কেবল শব্দার্থ নহে, লেখকের অভিপ্রায়কেও পৌঁছাইতে হইবে। নচেৎ অনুবাদের অর্থ মিলিবে না, এমনকী ভুল অর্থ মিলিবে। ‘পোস্ট অপারেশন রুম’ কথাটির নীচে বিশুদ্ধ বাংলায় ‘পশ্চাৎ অস্ত্রোপচার কক্ষ’ লিখিয়া বঙ্গের এক হাসপাতাল লোক হাসাইয়াছে। পূর্বে যন্ত্রবুদ্ধি মানুষ এমন দুষ্কর্ম করিত, ইদানীং বুদ্ধিমান যন্ত্র তাহা করিতেছে। বিজ্ঞাপন কিংবা প্রচারপুস্তিকার উদ্ভট ভ্রান্তি ক্রমশ বাড়িতেছে। যন্ত্রের ভুল যদি হইয়াই থাকে, শুধরাইবার মতো মানুষ কি ছিল না? না কি, তাঁহারা বিশুদ্ধ যন্ত্রবুদ্ধি?
ভ্রান্ত বয়ান যে শুধরানো হয় নাই, তাহার কারণ হয়তো ইহাই যে, ‘সত্য-উত্তর’ যুগে বাক্-এর সহিত অর্থের সংযোগ সন্ধান করিয়া লাভ নাই। মন ও কথা, কথা ও অর্থের সংযোগ থাকিবে— এই প্রত্যাশাই কমিতেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাহার উৎকট নজির। তাঁহার বাক্যগুলি অসম্পূর্ণ, বাক্যগঠন অসিদ্ধ, বাক্যাংশগুলি পূর্বাপর সম্পর্কহীন, শব্দভাণ্ডার অতি সীমিত। তাঁহার অনুগামীরা কিন্তু নির্বিচার তাঁহাকে ভরসা করেন, হয়তো বিচার করিলে ভরসা অসম্ভব বলিয়াই। ভারতে সুবক্তা বিস্তর। কিন্তু নেতারা যাহা ভাবেন, যাহা বলেন আর যাহা করেন, তাহার মধ্যে সংযোগ সন্ধান পণ্ডশ্রম। বাক্য যখন অর্থহীন, তাহা ব্যাকরণ-অসিদ্ধ হইলেই বা কী? নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সংবাদে ‘ফচক্রজ্ঞ জ্ঞজ্ঞক্রফ’ দেখিয়া মুদ্রণপ্রমাদে বিরক্ত হইয়াছিলেন। কিন্তু খবর পড়িয়া বুঝিয়াছিলেন, নাগরিকের অনর্থক হেনস্তার বিবরণ দিতে ওই শব্দ দুইটিই যথার্থ। যত দিন যাইবে, আমরাও ‘ফল্সপ্রবণ’ হইয়া উঠিব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy