ক্ষুধার্ত শিশুর জন্য রুটি চুরি কি অপরাধ? ফরাসি ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগোর সৃষ্ট জাঁ ভালজাঁ চরিত্রটি অপরাধ ও অপরাধীকে নূতন করিয়া দেখিতে শিখাইয়াছিল। ভারতে আজ সেই শিক্ষার বড় প্রয়োজন। তেইশ বৎসরের শিল্পা এবং ছাব্বিশ বৎসরের সন্ধ্যা তিরুঅনন্তপুরমের একটি কারাগারের প্রাচীর অতিক্রম করিয়া পলাইয়াছিল। তাহাতে কেহ আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে ক্ষুব্ধ, কেহ মেয়েদের ‘কৃতিত্বে’ বিস্মিত। শোরগোলে চাপা পড়িয়াছে যে কাহিনি, তাহা হুগোর ন্যায় কোনও লেখকের কলমেরই উপযুক্ত। শিল্পা পাঁচ হাজার টাকা দামের একটি আংটি চুরি করিয়াছিল, সন্ধ্যা একটি নকল আংটি সোনা বলিয়া বন্ধক দিবার চেষ্টা করিয়াছিল। উভয়েরই ইহা প্রথম অপরাধ, ক্ষুধার্ত সন্তানের স্বার্থে। পুলিশ দুই তরুণীকে জেলে পাঠাইয়াছে, কিন্তু জানাইতে ভুলিয়াছে যে আবেদন করিলে বিনা পয়সায় আইনি সহায়তা পাওয়া যায়। আদালতেও পুলিশ জানায় নাই যে, ইহারা জামিন দিতে অক্ষম। বিচারে সাজা হইলে যাহাদের তিন মাস কারাদণ্ড হইত, তাহারাই চার মাস বিচারাধীন বন্দি হিসাবে কাটাইয়াছে। ইহা আশ্চর্য নহে। ভারতে কারারুদ্ধদের প্রতি তিন জনের মধ্যে দুই জন বিচারাধীন বন্দি। অন্তত পনেরো হাজার বন্দি তিন বৎসরেরও অধিক অপেক্ষা করিতেছেন বিচারের। কবে ছাড়া পাইবে, কী করিলে ছাড়া পাইতে পারে, তাহার আন্দাজ না পাইয়া দুই উৎকণ্ঠিত মা প্রাচীর ডিঙাইয়া পলাইলে, আইন তাহাদের অপরাধী বলিলেও মানবমন বলিতে পারে কি? ইহারা কি শাস্তির যোগ্য, না কি সহানুভূতির?
দোষ কাহার, বিচার করিতে গেলে সরকার ও বিচারব্যবস্থাকেই কাঠগড়ায় তুলিতে হয়। এই তরুণীরা যে ব্যতিক্রম নহে, তাহার প্রমাণ গত বৎসরের আইন সংশোধনের একটি প্রস্তাব। কেন্দ্রের মহিলা ও শিশু মন্ত্রক ফৌজদারি আইনে অনেকগুলি পরিবর্তন দাবি করিয়াছিল। সেগুলি কার্যকর হইলে নাবালক সন্তানদের নিরাপত্তার বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া শিল্পা বা সন্ধ্যাকে ধরিতে পারিত না পুলিশ। কারণ, যে মেয়েদের উপর অপরকে দেখাশোনা করিবার দায়িত্ব রহিয়াছে, তাহাদের জেলে পাঠাইবার পূর্বে সময় দিতে হইবে নির্ভরশীল ব্যক্তিদের ব্যবস্থা করিবার, এমনই প্রস্তাব করিয়াছিল মন্ত্রক। বন্দি হইলেও শিল্পা ও সন্ধ্যা এক মাসের মধ্যে ছাড়া পাইত। কারণ, মন্ত্রক প্রস্তাব করিয়াছিল, সর্বাধিক সাজা যাহা হইতে পারে, তাহার এক-তৃতীয়াংশ কাল কারাবাস করিলেই জামিন পাইবে মহিলা বন্দিরা। এই প্রস্তাবগুলি যে অতিশয় প্রয়োজনীয়, তাহাতে সন্দেহ কী? ২০১৬ সালের সরকারি তথ্য, চোদ্দো শতেরও অধিক বিচারাধীন বন্দি মহিলা সন্তান-সহ বাস করিতেছে কারাগারে। মায়ের অপরাধ যেমনই হউক, একটি শিশুকে শাস্তি দিবার কী অধিকার রাষ্ট্রের আছে?
আইন-আদালতের চক্ষে ধনী-দরিদ্র সকলেই সমান, কিন্তু আদালতে ‘ন্যায়’ পাইবার ক্ষমতা সকলের সমান নহে। যথাযথ আইনি পরামর্শ এবং জামিন জোগাইবার ক্ষমতার অভাবে যাহারা দীর্ঘ বন্দিদশা ভোগ করে, তাহারা অধিকাংশই দরিদ্র, দলিত-আদিবাসী, মুসলিম, নানা প্রান্তবাসী গোষ্ঠী। অসহায় মানুষের অকারণ কারাবাস সমাজের অপরাধ। সেই শাস্তি কি সমাজ পাইবে না? হুগোর উপন্যাসে পলাতক জাঁ ভালজাঁকে কারাগারে ফিরাইতে তৎপর পুলিশ আধিকারিকটি শেষে আত্মহত্যা করিয়াছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy