অঙ্কন: কুণাল বর্মন
হেনকালে পড়িতে গেলাম উত্তর দেশ।।
বৃহস্পতিবারের ঊষা পোহালে শুক্রবার।
পাঠের নিমিত্ত গেলাম বড় গঙ্গাপার।।
তথায় করিলাম আমি বিদ্যার উদ্ধার।
যথা যথা যাই তথা বিদ্যার বিচার।।...
রাজ পণ্ডিত হব মনে আশা করে।
পঞ্চ শ্লোক ভেটিলাম রাজা গৌড়েশ্বরে।।...
সন্তুষ্ট হইয়া রাজা দিলেন সন্তোক।
রামায়ণ রচিতে করিলা অনুরোধ।।
(কৃত্তিবাসের আত্মবিবরণ)
বাল্মীকির রামায়ণে রামের দুর্গাপুজোর উল্লেখ নেই। কিন্তু কৃত্তিবাসের রাম এই পৌরাণিক দেবীর অকাল-বোধন করেছিলেন। সেই রামায়ণ কৃত্তিবাস খুব সম্ভবত লিখেছিলেন উত্তরবঙ্গে বসে।
কৃত্তিবাস লিখছেন, ফুলিয়া থেকে নিতান্ত বালক বয়সে বড় গঙ্গা পার করে তিনি ‘উত্তরের দেশ’-এ গিয়েছিলেন। সেই বড় গঙ্গা কোথায়? পণ্ডিতদের মধ্যে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলছেন, এই গঙ্গা দক্ষিণবঙ্গেই। কৃত্তিবাস খুব সম্ভবত ফুলিয়া থেকে গঙ্গা পেরিয়ে নবদ্বীপে গিয়েছিলেন বলেও মনে করা হয়।
কিন্তু ‘উত্তরের দেশ’ বলতে উত্তরবঙ্গ, এমনটাও অনেকে মেনে নেন। বিদ্যা প্রসঙ্গে পঞ্চদশ শতকে গৌড়ের প্রতিষ্ঠাও কিছু কম ছিল না। কৃত্তিবাস নিজের গুরুর পরিচয় দিয়েছেন, ‘ব্যাস বশিষ্ঠ যেন বাল্মীকি চ্যবন।’ গুরুর কাছে পাঠ শেষ করে, তাঁকে দক্ষিণা দিয়ে কৃত্তিবাস গেলেন গৌড়েশ্বরের কাছে। যদি ধরে নেওয়া যায়, এখনকার গৌড়েই তাঁর রাজধানী ছিল, তা হলে এটাও ধরে নিতে হয়, কৃত্তিবাস তাঁর রামায়ণ লিখেছিলেন উত্তরবঙ্গেই বসে। গৌড় বেশ বড় শহর ছিল। রাজভবনে ন’টি দেউরি পার করে রাজার কাছে পৌঁছতে পেরেছিলেন কৃত্তিবাস। কৃত্তিবাসের প্রায় একশো বছর পরে ১৫২১ সালে এক পর্তুগিজ দোভাষী বলছেন, গৌড় একটি জনাকীর্ণ শহর। লোকের ভিড়ে পথ চলা মুশকিল। অভিজাতেরা পালকি করে দরবারে যাচ্ছেন, তখন সামনে তাঁদের লোকেরা লাঠি দিয়ে লোক সরাচ্ছে। তখন শহরটির আয়তন কুড়ি মাইল লম্বা, চার মাইল চওড়া। তার মধ্যে থেকে পথ, খাল, প্রাসাদ এলাকা, মসজিদ বাদ দিতে হবে। অভিজাতদের বড় বাড়িও বাদ দিতে হবে। ১৫৮০ সাল নাগাদ দু’লক্ষ বিশ হাজার জন সেখানে থাকতেন বলে ইতিহাসবিদদের অনুমান। এমন একটি শহরও প্রয়োজন ছিল কৃত্তিবাসের। দুর্গাপুজোর যে বিস্তৃত বিবরণ তাঁর কাব্যে রয়েছে, তাতে বোঝা যায়, দুর্গাপুজো সেই পঞ্চদশ শতকেই বেশ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে।
কৃত্তিবাসের সেই বিবরণে দুর্গাপুজো একটি বিরাট উৎসবই। যে উৎসবে সন্ধিপুজো, চণ্ডীপাঠের মতো নৃত্যগীতেরও একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। রামের পুজোর প্রতিটি দিনেই নৃত্যগীতের আয়োজন ছিল। কৃত্তিবাস লিখছেন, ‘শুদ্ধসত্ত্বভাবে পূজা সাত্ত্বিকী আখ্যান।/গীতনাট্ট চণ্ডীপাঠে দিবা অবসান।। সপ্তমী হইল সাঙ্গ অষ্টমী আইল।/পুনর্বার রামচন্দ্র অর্চনা করিল।।/নিশাকালে সন্ধিপূজা কৈলা রঘুনাথ।/নৃত্যগীতে বিভাবরী হইল প্রভাত।।/নবমীতে পূজে রাম দেবীর চরণে।/নৃত্যগীতে নানা মতে নিশি জাগরণে।।’
আর সেই তথ্য বা অভিজ্ঞতা কৃত্তিবাস কি দক্ষিণবঙ্গ থেকেই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন, না ‘উত্তরের দেশ’-এর পুজো থেকেও পেয়েছিলেন?
উত্তরের দুর্গাপুজোয় যে বিরাট বৈচিত্র রয়েছে, তা থেকে মনে হয়, সব জায়গা থেকেই খবর সংগ্রহ করেছিলেন কৃত্তিবাস। গৌড়েশ্বরের দরবারে সে সব খবরই তো আসত। শুধু তাই নয়, স্বয়ং গৌড়েশ্বরের দরবারেই নৃত্যগীতের আসর বসত। কৃত্তিবাস গৌড়েশ্বরের সভার বিবরণে বলেছেন, ‘চারিদিকে নাট্যগীত সর্বলোক হাসে।’
তার কিছু রেশ এখনও রয়ে গিয়েছে। যেমন, জলপাইগুড়ির রাজবাড়ির পুজো। কৃত্তিবাসের সময়ের অনেক পরে হলেও এই পুজোও পাঁচশো বছরের পুরনো বলে দাবি। জলপাইগুড়িতে রাজবাড়ির পুজো জড়িয়ে রয়েছে স্থানীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে। পুজোর বয়স আনুমানিক পাঁচশো বছর। সেখানেও সার রাত মেলা বসত। নাচে-গানে কখন ভোর হয়ে যেত। নৌকো করে লোক আসত। ঘাটে লেগে থাকত নৌকোর সারি। রায়কত রাজবংশের এই দেবীর রং তপ্তকাঞ্চন। এখানে পুজো হয় কালিকাপুরাণ মতে। দেবী রথে আসীন, কনকদুর্গা রূপে পূজিত। সঙ্গে পূজা পায় সিংহটি। তার রং শ্বেতশুভ্র। রয়েছে তার দু’টি ডানাও। পূজিত হয় বাঘ। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, মহামায়ার সঙ্গে পুজো করা হয় দুর্গার দুই সখী জয়া, বিজয়াকেও। পূজা পান মেচেনি দেবীও। দেবীকে পরানো হয় কোনও বার আসল বেনারসি শাড়ি, তো কোনও বার অসম সিল্ক। পঞ্চমীর দিন রাজপরিবারের পক্ষ থেকে দেবীকে সাজানোর জন্য পুরোহিতের হাতে তুলে দেওয়া হয় স্বর্ণালঙ্কার। চারুচন্দ্র সান্যালের ‘জলপাইগুড়ি শহরের একশ বছর’ প্রবন্ধে এই পুজোয় নরবলির উল্লেখ রয়েছে। আজও অষ্টমীর অর্ধরাত্রি পুজোয় চালের গুঁড়ি দিয়ে মণ্ড তৈরি করে প্রতীকী মানুষ বানিয়ে কুশ দিয়ে বলি দেওয়া হয়। এক সময় শাক-আনাজ, মহিষ, পাঁঠা, কচ্ছপ— পুজোর নানা উপকরণ আসত বিভিন্ন তালুক থেকে।
গবেষকদের একাংশ জানান, কোচবিহারের বড়দেবীর পুজোর ইতিহাসও প্রায় পাঁচশো বছরের প্রাচীন। এই দেবীপ্রতিমাও প্রচলিত প্রতিমার রূপের চেয়ে আলাদা। রক্তবর্ণা বড়দেবীর এক দিকে থাকে সাদা সিংহ, অন্য দিকে থাকে বাঘ। দুই পাশে জয়া ও বিজয়া। কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী থাকেন না। মনে রাখা দরকার, কৃত্তিবাসের কাব্যে দুর্গা যখন রামের কাছে এসেছিলেন, তাঁর সঙ্গে ছেলেমেয়েরা কেউ ছিল না।
দুর্গাপ্রতিমার যে বিরাট বৈচিত্র রয়েছে, তার অন্যতম বড়দেবীও। প্রতিমা তৈরি হয় ‘হাওয়া খাওয়া’ পর্বের পর। যূপছেদন পুজো হয় গুঞ্জবাড়ি ডাংগোরাই মন্দিরে। প্রায় ১১ ফুট লম্বা ময়না গাছের ডাল কেটে দেবীর মুখের অবয়ব বসিয়ে পুজো করেন পুরোহিত।
কেন উত্তরের দেবীর সঙ্গে এত বাঘ? কোনও গবেষক বলেন, উত্তরে জনবসতির ঘনত্ব ছিল কম। মহানন্দার পাড়ে ঘন জঙ্গল থেকে এক সময় শোনা যেত বাঘের গর্জন। সন্ধে নামার আগেই তাই বাড়িতে ঢুকে ঘরদোরে খিল এঁটে বসে থাকতেন বাসিন্দারা। বাঘের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে শুরু হয়েছিল মালদহের সামসির দুর্গতিনাশিনীর পুজো। তবে ৩০০ বছরের পুরনো ওই পুজো আগে হত সামসি লাগোয়া মহানন্দা নদী লাগোয়া পারাকরম এলাকায়। দেড়শো বছর বাদে চাঁচল রাজা সামসিতে ওই পুজো শুরু করেছিলেন। এই প্রতিমা রীতিমতো রাজকীয়। দেবীর মাথায় থাকে শিবগঙ্গা, দু’পাশে দুই পরি। গণেশের বদলে কলাবউ রাখা হয় কার্তিকের পাশে। পুরনো রীতি মেনে ডাকের সাজের প্রতিমা হয় একচালায়। পুজোর জন্য গঙ্গাজল নিয়ে আসা হয় ঝাড়খণ্ডের রাজমহল থেকে। প্রথা মেনে জন্মাষ্টমীর দিন থেকেই দেবীপ্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয়ে যায়। পুজোর পুরোহিতের ক্ষেত্রেও মেনে চলা হয় বংশ পরম্পরা। অষ্টমীতে ধুমধাম করে কুমারী পুজো করা হয়।
মালদহের রতুয়ার আড়াইডাঙার রতুয়ার আড়াইডাঙ্গা কুমার বাড়ির পুজোও সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো। কুমার পরিবারের প্রবীণ তারাপদ কুমার জানাচ্ছেন, ৬০-৬৫ বছর আগেও সারা রাত জাগতেন বাসিন্দারা। সে এক এলাহি ব্যাপার ছিল। সন্ধে থেকে শুরু হত চণ্ডীপাঠ। রাত ১২টা পর্যন্ত এলাকার প্রত্যেকেই আসরে বসে চণ্ডীপাঠ শুনতেন। তার পরে শুরু হত দেবীর জন্য মাংস-ভাত রান্নার প্রস্তুতি। প্রসাদ দেওয়া হত ভোরে। ওই সময় ছোটদের বাড়িতে রেখে রাত জাগতেন বড়রা। বাসিন্দাদের অনেকেই দেবীর জয়ধ্বনি দিয়ে ঢাকের তালে নেচে সময় কাটাতেন। রান্না শেষ হতেই বাসিন্দারা ছুটতেন বাড়িতে। পরিবারের বাকি সবাইকে ডেকে নিয়ে আসতেন। তারপর পাত পেড়ে খাওয়াদাওয়া শেষ হতে হতে ভোরের আলো ফুটে যেত।কোচবিহারের ধর্মতলা মোড় লাগোয়া ভট্টাচার্য বাড়ির পুজোও সাড়ে তিনশো বছরের বেশি পুরনো, এমনটাই দাবি করেন ওই পরিবারের সদস্যেরা। বাংলাদেশের রংপুরে বসবাস করার সময় থেকেই ওই পুজো হচ্ছে। পূর্বসূরি উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সময় থেকেই ওই পুজো শুরু হয়। দেবী এখানে সপরিবার একচালায় থাকেন। দেবীর গায়ের রং হালকা হলুদ। পুরনো রীতি মেনে প্রতিপদে স্থায়ী মন্দিরে ঘট বসিয়ে পুজোর শুরু হয়। তালপাতার উপরে লেখা প্রাচীন পুঁথি পড়ে মন্ত্রোচ্চারণ করেন পুরোহিত। প্রতিমা বিসর্জনের পর মন্দিরের সামনে কলাগাছ পুঁতে রাখা হয়। সেখানে সোনা, রুপো, তামা, লোহার মতো নানা ধাতু এবং সামগ্রীর ২২টি জিনিস থালায় সাজিয়ে বাড়ির লোকেদের কপালে ছোঁয়ানো হয়। দেবীকে পাঁচ রকম ভাজা, মোচার ঘণ্ট, সবুজ শাক দেওয়া হয়।
তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রাচীন রূপ বদলেছে। দেবী হয়ে উঠেছেন ঘরের লোক। উমা। উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ প্রান্তে ভারত ভাগ হওয়ার পরে বহু মানুষ ও-পার থেকে এসেছেন। অনেক ছোট গঞ্জ দেশভাগের পরে হয়ে উঠেছে বড় শহর। ভট্টাচার্য পরিবারের মতো ও-পারের অনেক পুজোও চলে এসেছে এ-পারে। কিন্তু পুজোর রীতিতে ধরা রয়ে গিয়েছে ও-পারের স্মৃতি। এখন এনআরসি আতঙ্কের মধ্যে দেশের অনেক মানুষ যখন ফের দেশছাড়া হওয়ার আশঙ্কায়, তখন এই দেবী তাঁর পুজোর নানা বৈচিত্র নিয়ে আবার আসছেন। তিনি সর্বভূতেষু সংস্থিতা। সর্বভূতেষু। এই দেবী কোনও স্থানভেদ মানছেন না। তাই প্রধানত বাঙালির এই পুজোয় তিনি যেন ঐক্যের সুরই হয়ে ওঠেন।
(তথ্য সহযোগিতা: অরিন্দম সাহা, নমিতেশ ঘোষ, জয়ন্ত সেন, বাপি মজুমদার, অনিতা দত্ত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy