সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যখন হাজার-হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি চলে গেল, সেই মর্মান্তিক অব্যবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে কিছু দৃশ্য মনের চোখে ভেসে ওঠে। এর সঙ্গে আদালতেররায়ের যোগ নেই তবে বিদ্যালয় স্তরে শিক্ষার অব্যবস্থার যোগ আছে। সেই অব্যবস্থায় ভুগছে— শুধু বাংলা নয়, ভারতীয় ভাষা-মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলিই। পশ্চিমবঙ্গে তার সঙ্গে আছে বিষফোড়ার মতো দগদগে দুর্নীতি।
সদ্য দাড়ি ওঠা এক কিশোর। তার সঙ্গে দেখা গল্ফ গ্রিনে। এখানে বাঙালি ভদ্রলোক-মধ্যবিত্ততার ভাষিক ও সাংস্কৃতিক চিহ্ন দু’-পাশের সরকারি ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা এখনও পর্যন্ত বহন করে চলেছেন। এক হাতে মোবাইল, অন্য হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে চলেছে ছেলেটি। বাইকে প্রায় ধাক্কা খায় আর কী! বাইক-চালক কোনও ক্রমে সামলে নিলেন। একটু রাগী চোখে তাকাতেই ছেলেটি বলে, ‘কী করব, কাকু? সুইগির ডেলিভারি কাউন্টার খুঁজছি। আজ জয়েন করেছি। খুঁজে পাচ্ছি না।’ কী আর বলব। বলি, সাবধানে! মনে-মনে বলি কোন অধিকারে সাবধান করছি। স্কুলেই তো পড়ার কথা, ইলেভেন-টুয়েলভে। ড্রপ আউট, জীবিকার সন্ধানে। অভিভাবকরা মেনে নিয়েছেন। কারণ তাঁরা জানেন ইস্কুলে পড়ে, সরকারি ইস্কুলব্যবস্থায় পড়ে আর কিচ্ছু হবে না। পড়াশোনার ডানায় ভর করে উঠে দাঁড়াবার গল্প ক্রমে অতীত রূপকথা হয়ে উঠছে। স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী কমছে।
এই ‘হবে না’-র কালো হাওয়া কেবল কলকাতার বাংলা-মাধ্যম সাধারণ সরকারি ইস্কুলগুলিতেই শুধু পাক খাচ্ছে না, পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় ভাষা-মাধ্যম বিদ্যালয়গুলিতেও পাক খাচ্ছে। বিজন হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র। পড়ান গুসকরায়, একটি হিন্দি-মাধ্যম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কত দিন আর সেই স্কুলে পড়াতে পারবেন তা অবশ্য জানেন না। হিন্দি-মাধ্যম স্কুলটিতে পড়ুয়ার সংখ্যা কমেই আসছে। পড়ুয়ার অভাবে স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেলে বিজনকে জুড়ে দেওয়া হবে অন্য কোনও স্কুলে। কারণ সেই এক। সাধারণ হিন্দি-মাধ্যম প্রাথমিকে পড়ে চাকরিযোগ্য হয়ে ওঠার মতো হিন্দি-মাধ্যম উচ্চতর বিদ্যালয় পশ্চিমবঙ্গের নিম্নবিত্ত হিন্দিভাষীদের চোখে ধরা দিচ্ছে না।
বর্ধমান থেকে এ বার প্রান্তিক পুরুলিয়া, দেবব্রত পুরুলিয়ার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ইস্কুলে না-আসা পড়ুয়াদের কী হল তা জানার জন্য বাড়ি বাড়ি যেতে হয় তাঁকে। যান আরও অনেক শিক্ষকই। কোভিডের পর থেকে চিত্রটি বড় অন্ধকার। দেবব্রতর স্কুলে উৎসশ্রীর কল্যাণে শিক্ষক নেই। শিক্ষকেরা পুরুলিয়া ছেড়ে নিজেদের বাড়ির কাছাকাছি নিরাপদে ফিরে গিয়েছেন। বিজ্ঞান পড়ানো অসম্ভব হয়ে উঠছে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে। অন্য বিষয়ের ক্ষেত্রে স্থায়ী শিক্ষকের অভাবে কোনও ক্রমে এক-দু’জনকে চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেছেন দেবব্রত। বেতন দেন মাস গেলে তিন হাজার টাকা। অনেক সময় কৌশলে এই ফান্ডের টাকা বাঁচিয়ে তিন হাজার টাকা ম্যানেজ করতে হয়। এই চুক্তিভিত্তিক শিক্ষকদের খাতায় কলমে টাকা দেওয়ার সময় শিক্ষকতার শ্রমের জন্য ইস্কুল থেকে টাকা দেওয়া হচ্ছে, তা দেখানো যায় না।
নিরুদ্দেশ পড়ুয়াদের খোঁজে গিয়ে দেবব্রত গ্রামে অভিভাবকদের দ্বারস্থ। প্রথমে কিছুতেই তাঁরা বলতে চান না, শেষে জানা গেল ছেলে পরিযায়ী চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক হয়ে তারা চলে গেছে অন্য প্রদেশে। তাতে অবশ্য বাবার দুঃখ নেই। বরং দেবব্রতকে বলেন, ‘মাস্টার, তুমি ওই চুক্তির মাস্টারগুলানকে কত দাও জানি। আমার ছেলে মাসে দশ হাজার পায়। পড়ে আর কী হবেক?’ দেবব্রত জানেন তিনি এই যুক্তির সামনে নিতান্ত অসহায়। এও জানেন রাতের ট্রেনে পুরুলিয়া থেকে অন্য প্রদেশে অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে পাড়ি দিচ্ছে যারা, তাদের অনেকেই অপুষ্টি ও বসবাসের অব্যবস্থায় কিছু দিনের মধ্যেই অসুস্থ হবে। শরীর ভেঙে বাড়ি ফেরে দশহাজারি অদক্ষ শ্রমিক। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না মালিক পক্ষের। এক জন অসুস্থ হলে তার বদলে সুস্থ অদক্ষ শ্রমিক ঠিক জুটে যাবে এই বিপুল জনসংখ্যার দেশে।
সরকারি আওতার স্কুল আর পড়াশোনা শেখার উপযুক্ত পরিকাঠামো প্রদায়ী আশ্রয় নয়। সেখানে টাকা-পয়সার অনুদান পাইয়ে দেওয়ার নানা আয়োজন আছে, সেই আয়োজনের হয়তো গুরুত্বও আছে। কিন্তু শুধু সেই আয়োজনটুকুই গুরুত্বপূর্ণ নয়। স্কুলে পড়াশোনা শেখানোর পরিকাঠামো চাই, চাই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সহযোগ। ব্যতিক্রমী-পরিশ্রমী শিক্ষকও আছেন সরকারি স্কুলে। কিন্তু তাঁরা সংখ্যায় আর ক’জন! কত দিন এই অসম অব্যবস্থার লড়াই চালাবেন! তাঁদের সৎ প্রচেষ্টার বাইরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ক্রমে ঘন থেকে ঘনতর হচ্ছে। সর্বত্র এক কথা। পড়ে যোগ্য হয়ে উঠে জীবিকা নির্বাহ এ ব্যবস্থায় নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েদের পক্ষে অসম্ভব, ফলে ইস্কুল থেকে যা-পাওয়ার সেটা নিয়ে নিতে হবে (সাইকেল, ট্যাব বা ফোন) কিন্তু প্রবেশ করতে হবে সেই কাজে, অদক্ষ শ্রমের থেকে যা উপার্জন হয় তাই হোক।
এ গল্প ক্রমেই কিন্তু ভারতীয় ভাষা-মাধ্যমের সমস্ত বিদ্যালয়ের পক্ষে সত্য হয়ে উঠতে পারে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে উচ্চবিত্ত মানুষেরা তাঁদের ছেলে-মেয়েদের অসরকারি বিদ্যালয়ে পড়ানোর সামর্থ্য অর্জন করেছেন। ফলে ক্রমাগতই উচ্চবিত্তের অধিকারে এক শ্রেণির পরিবারের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার, প্রচলিত ও অপ্রচলিত পড়াশোনার মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরি পাওয়া সম্ভব হবে। নানা রকম অসরকারি ব্যবস্থাপনা এই সম্পন্ন ছেলে-মেয়েদের দক্ষ করে তুলবে। ফলে এর বাইরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মানুষেরা তাঁদের ছেলে-মেয়েদের জন্য স্বপ্ন আর দেখতেই চাইবেন না। তাঁরা ক্রমে মেনে নেবেন, অদক্ষ, স্বল্পদক্ষ শ্রমিক হিসেবে ছেলেরা যা উপার্জন করে তাই সই। আর মেয়েদের জন্য রইল বিবাহব্যবস্থা, গতর খাটানোর কাজ, বাচ্চা দেখা, ফ্ল্যাটবাড়িতে রান্না করা। অসামঞ্জস্য আর নতুন বর্ণাশ্রমের এই যে পথ প্রস্তুত হচ্ছে তা অবশ্য এখন আমরা অনেকেই দেখছি না।
ভারতীয় ভাষা-মাধ্যমের যে প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলি সরকারি আওতায় গড়ে উঠেছিল তা তো বিশেষ এক পরিকল্পনা ও স্বপ্ন থেকেই গড়ে উঠেছিল। অন্য প্রদেশের কথা থাক, পশ্চিমবঙ্গের কথাতেই ফিরি। বাস্তব অভিজ্ঞতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পড়াশোনা করে ক্লাস সেভেন-এইটেও নিজের ভাষা ভাল করে পড়তে লিখতে পারে না এমন পড়ুয়ার সংখ্যা সুপ্রচুর। উচ্চতর বিদ্যায় যাওয়ার কথা ছেড়েও যদি দেওয়া হয়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কয়েক ধাপের মধ্যে অর্থাৎ স্কুলে চার থেকে ছ’বছর সময় কাটানোর মধ্যে কি তাকে নিজের ভাষা ভাল করে পড়তে-লিখতে শেখানো যায় না! খানিকটা অঙ্ক আর প্রাথমিক বিজ্ঞান। খুবই কি অসম্ভব কাজ! ভাষার শিক্ষা তো ফেলে দেওয়ার নয়। তার মধ্যে প্রয়োজনের জ্ঞান ও অপ্রয়োজনের জ্ঞানও রয়েছে। আমরা সবাই নিজের সাড়ে তিন হাত মাপের হলেও আমাদের ঘর তো নিতান্ত সাড়ে তিন হাত নয়। তার মধ্যে অনেক ফাঁক থাকে। আমাদের ভাষাও শুধু কাজের কথাটুকু শেখায় না, অকাজের দিকে মনকে টানে। পাটিগণিতের অঙ্ক নিজের ভাষায় কি একটা গল্পকেই সমস্যার মতো করে ভাবতে শেখায় না! মানুষেরই তো মন। তা তো কল্পনা করতে চায়, ভাবতে চায়। সেই ভাবনার জগৎটুকু খুলে দিতে পারে নিজের ভাষা— বাংলা-হিন্দি-অসমিয়া-ওড়িয়া। কিন্তু সেটুকুও তো স্কুলে ঠিকমতো করানো যাচ্ছে না। পড়ুয়া কমে আসছে।
বিদ্যালয় ব্যবস্থার সঙ্কট কিন্তু উচ্চতর শিক্ষাক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হবে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে বিদ্যালয়-শিক্ষা যদি অর্থহীন হয়ে যায় তা হলে বিভিন্ন জেলার মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও ক্রমশ পড়ুয়ার অভাবে ভুগবে ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল পড়ুয়া গ্রহণের মাধ্যমে কোনও ক্রমে টিকে থাকার চেষ্টা করবে। আবারও সরকারি উচ্চশিক্ষার দুর্বলতার সুযোগে বেসরকারি মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় আত্মপ্রকাশ করে অর্থকেন্দ্রিক বর্ণাশ্রমকেই স্থায়ী ও চিরন্তন রূপ দেবে। এ এক বিচিত্র চক্র।
উপায় কী? উপায় হয়তো শিক্ষকদের হাতে, সাধারণ মানুষদের কাছে খানিকটা হলেও আছে। যিনি যে স্তরে শিক্ষকতা করছেন তিনি যে ভাবে সম্ভব যতটা সম্ভব চেষ্টা করুন। বিদ্যালয় স্তরে অব্যবস্থা, দুর্নীতি এই পিছন দিকে এগিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে, এটা বলাই যথেষ্ট নয়। নাগরিক সমাজের মানুষেরা যাঁরা যেটুকু পারেন শিক্ষার সেতু নির্মাণে কাঠবিড়ালীর ভূমিকা গ্রহণ করুন। প্রকৃত শিক্ষার সামর্থ্য বর্ণাশ্রমকে ভাঙতে পারে।
সামনেই বাংলা নববর্ষ। বাঙালির কী হল, বাঙালির কী হবে, এই হাহাকার শুনতে পাওয়া যাবে। প্রশ্নটি শুধু বাংলা ও বাঙালির নয়। ভারতীয় ভাষা-মাধ্যমের বিদ্যালয়ব্যবস্থা সরকারি আওতায় বাঁচিয়ে না রাখলে দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী নিস্তেল অন্ধকারে ক্রমশই ডুবে গিয়ে অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষ শ্রমিক হিসেবে দিন-যাপনে বাধ্য হবে। এই আমরা চাইছি বুঝি!
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)