ভারতীয় সমাজে শতকের পর শতক ধরে চলা জাতপ্রথার কারণে সামাজিক উৎপীড়নের যে আবহ ছিল, তা এখনও বর্তমান। এই প্রথা সমাজের এক কোণে অবহেলায় নির্বিষ, নির্জীব হয়ে পড়ে নেই, রীতিমতো যাপিত হচ্ছে। এখনও ‘উঁচু জাত’-এর বিরাট একটা অংশ ‘দলিত’ মানুষকে দলন করে রাখতে সক্ষম হচ্ছে, কারণ আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক আবহাওয়া এখনও জাতপাতভিত্তিক শোষণ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট অনুকূল।
জাতপাতগত উৎপীড়নের কীর্তিকলাপ এক দিনে গজিয়ে ওঠেনি, অতএব সুইচ টিপে তাকে রদ করাও সম্ভব নয়, এ কথা ভারত স্বাধীন হওয়ার আগেই বার বার আলোচিত হয়েছিল। ১৯২৭ সালে সাইমন কমিশনের নথিতে ধরা পড়েছিল, ভারতে এই পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর প্রতি সামাজিক সহিষ্ণুতার মাত্রা অতীতের তুলনায় বেড়েছে যৎকিঞ্চিৎ। এমনই কম সেই অগ্রগতি, তা কমিশনকে প্রস্তাব করতে বাধ্য করেছিল যে, বঞ্চিত বর্গের জন্য বিশেষ সুরক্ষার প্রয়োজন আছে। স্বাধীনতার আগে, ‘অস্পৃশ্যতা’র প্রসঙ্গে অনেকেই যেমন বলেছেন যে, জাতব্যবস্থাকে ঝেড়েমুছে নিয়ে এই সমস্যা ঘোচাতে হবে, তেমনই অম্বেডকরের মতো অনেকেই এও বলেছেন যে, হিন্দু ধর্ম থেকে ‘জাতব্যবস্থা’কে শিকড়-সুদ্ধ ওপড়ানো গেলে তবেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
প্রথম প্রস্তাবটি নিয়ে ভাবলে বিস্ময় তৈরি হতে বাধ্য— অমানবিক রীতিবিধি নিয়ে গৌরবের সঙ্গে চলতে থাকা একটি ব্যবস্থাকে ঝেড়েমুছে আদ্যন্ত মানবিক করার গূঢ়ার্থ ঠিক কী? কে করবে সেই আশ্চর্য কাজ? সেই ভালমানুষটি, যিনি দর্শনগত ভাবে স্বীকারই করছেন না যে, উচ্চাবচতা ছাড়া জাতব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকে না, আবার উচ্চাবচতার কারবারই হল বৈষম্যচর্চা!
একের পর এক শতক পেরিয়ে যাওয়া এই প্রথার শিকার যাঁরা, তাঁদের জন্য বহু বছর ধরে নানা যোজনা, সঙ্ঘ, সেবা ইত্যাদির উদ্যোগ করা হয়েছে। পরাধীন ভারতে একাধিক কারণে সংরক্ষণের প্রস্তাবও আসে, যা নিয়ে বিতর্কও চলতে থাকে নিরন্তর।
তবে সব বিতর্কের একটি সাধারণ সুর ছিল, আর তা হল: বৈষম্যের এই কুপ্রথা বন্ধ করতে হবে। শিক্ষা, চাকরি, জনপ্রতিনিধিত্বে সংরক্ষণ চালু হয় সংবিধানে। নিত্য-বিবাদে জর্জরিত জাতভিত্তিক সংরক্ষণকে টিকিয়ে রাখার বা তার ধারা পরিমার্জনের প্রসঙ্গ নিয়ে যত বার আলোচনা হয়েছে, প্রত্যেক বার ‘উঁচু জাত’-এর কাছ থেকে সম্মিলিত প্রশ্ন শোনা গিয়েছে: কবে উঠবে সংরক্ষণ? কোনও বারই বঞ্চিত মানুষেরা পাল্টা-দর হেঁকে জিজ্ঞেস করতে পারেননি: কবে উঠবে জাতব্যবস্থা? অথচ, শিশুও বোঝে, ক্রিয়া বন্ধ না হলে প্রতিক্রিয়া বন্ধ হয় না, ক্রিয়া বন্ধ না হওয়া সত্ত্বেও প্রতিক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া হলে ক্রিয়ার দাপট আরও বেড়ে যেতে পারে।
একটি আপাত-দরদি এবং আপাত-লড়াকু যুক্তিও শোনা যায় সংরক্ষণের বিপক্ষে: বঞ্চিতের মুক্তিসংগ্রামের যে স্পৃহা, সংরক্ষণের মতো স্বস্তির বন্দোবস্তের কারণে তা নাকি মাঠে মারা যাচ্ছে। সামন্ততন্ত্রকে ফুসফুস বানিয়ে ধনতন্ত্রের দৌরাত্ম্য চলে যে দেশে, সে দেশে মর্যাদা নিয়ে ‘নিচু জাত’-এর টিকে থাকাটাই এক আশ্চর্য সংগ্রাম। এর পর তাকে শুনতে হবে যে, হকের ঢাল-তরোয়ালগুলি ত্যাগ দিয়ে রণক্ষেত্রে নামতে পারলে তবেই সে সাচ্চা যোদ্ধা!
সংরক্ষণের কারণে দেশের মেধার গৌরব রসাতলে যাওয়ার যুক্তিও ওঠে। ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে যখন— মেধা নয়, প্রবণতা নয়, দক্ষতা নয়, চেষ্টা নয়, পরিশ্রম নয়— চাইলেই স্রেফ কাঁচা টাকা দিয়েও হইহই করে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি শিক্ষাকে কিনে ফেলা যায়, তখন ‘মেধায় আপস’ নিয়ে সংরক্ষণের দিকে আঙুল ওঠে কেন? বেসরকারি ক্ষেত্রে শিক্ষাকে কিনতে দেওয়া হয় কোন মেধার ভরসায়!
আসলে, দখল নেওয়ার দোষ যদি এক বার মগজে ঢোকে, তবে কিসের উপর কোন স্পর্ধায় দখল নিতে চাইছি, সে খেয়াল থাকে না। যদি একটি সমাজে শতকের পর শতক পৈশাচিক বৈষম্য চলতে থাকে, তবে সভ্যতার টিকে থাকার জন্যই বহু ইতিবাচক বৈষম্যও তৈরি করতে হবে, নিপীড়িতের জন্য এমন কিছু বিশেষ অধিকার তৈরি করতে হবে, যা সুবিধাপ্রাপ্তের অধিকারের তালিকায় মোটেই থাকবে না— এই বোধ বহু সুবিধাপ্রাপ্তের মনে তৈরিই হল না। মোট আসনের যতটুকু সংরক্ষিত, তার দিকে লোলুপ চোখে তাকিয়ে থাকা যে চলে না, মায় সে দিকে পা বাড়ানো যে ‘অনধিকার প্রবেশ’, এই কাণ্ডজ্ঞান ‘উঁচু জাত’-এর মধ্যে সার্বিক ভাবে তৈরি হতে এখনও সমস্যা হচ্ছে। এখনও বহু সুবিধাপ্রাপ্ত জানেনই না যে, সমাজে বাস করতে হলে শুধুমাত্র ভোগ করতে জানলেই চলে না, অধিকারের সীমা পেরোতে নেই। তাঁরা মনে করেন, ‘সংরক্ষিত’টুকু তাঁদের প্রাপ্য থেকে নেওয়া হয়েছে। সারসত্যটি বিপরীত: ‘সংরক্ষিত’টুকু ‘উঁচু জাত’-এর প্রাপ্যের মধ্যে কোনও দিন ছিলই না, তাই ওগুলিকে কব্জা করার প্রসঙ্গই অবান্তর।
‘নিচু জাত’-এর সদস্য হয়েও অম্বেডকর প্রস্তাব করেছিলেন, সংরক্ষণ হবে দশ বছরের জন্য। তিনি বোধ করি আন্দাজই করে উঠতে পারেননি যে, স্বাধীনতার সত্তর বছর পরও বহু সংরক্ষণ-বিরোধী সাধারণ তর্ক-আড্ডা চালাতে গিয়েও একটা সময়ের পর ধৈর্য হারিয়ে ক্ষমতাবানের ভান্ডারের নীচ শব্দগুলি অনর্গল ব্যবহার করে বসবেন, বা ‘ক্রিমি লেয়ার’-এর রোহিত ভেমুলা আত্মঘাতী হবেন বা খেতমজুর ঘরের কন্যাটির ‘উচুঁ জাত’-এর ধর্ষক-খুনিদের সুরক্ষার জন্য এ দেশের নানা প্রান্তে মিটিং-মিছিল হবে।
‘নিচু জাত’-এর মানুষের জীবনে এই সমাজের উৎপাত বন্ধ করার উপায়গুলির ষোলো আনার মধ্যে সংরক্ষণ হয়তো চার আনা। ‘জাতব্যবস্থা’-র মতো নিকৃষ্ট মানের ব্যবস্থার শুদ্ধিকরণের প্রচেষ্টা বন্ধ হয়ে, শিকড় থেকে তা উপড়ে ফেলার সরকারি ও সামাজিক কাজটি যে-দিন সুসম্পন্ন হবে, ‘সংরক্ষণ’ সে-দিন আপনিই উঠে যাবে। সংরক্ষিত আসনগুলিকে বাগিয়ে নেওয়ার মতলব ছেড়ে সবার জন্য বিনা ব্যয়ে শিক্ষা, সবার জন্য কাজের কার্যকর দাবি তোলায়, আর ‘জাতব্যবস্থা’-কে নিকেশ করার পরিকল্পনায় বুদ্ধি ও ঘাম ঝরালে, বিরোধীদের ‘সংরক্ষণ’-এর বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া কুটিল শোক হয়তো খানিক কমতে পারে।
তার আগে ‘উঁচু জাত’-এর পক্ষ থেকে সংরক্ষণের বিরুদ্ধে দরাদরি করা নেহাতই নির্লজ্জ ‘অনধিকার চর্চা’-র মতো ঠেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy