ছবি: সংগৃহীত
স্থান কাল এবং পাত্র। খুব বেশি কিছু না, একেবারে প্রাথমিক এই তিনটি বিষয়ের প্রতি একটু মনোনিবেশ করলেই চলবে। অযথা পরিশ্রম করে ‘এর বেলা ওর বেলা তার বেলা’ করার দরকার হবে না। রবীন্দ্রভারতীতে বসন্তোৎসবকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছে, এখনও অবধি নাগরিক সমাজে তা নিয়ে মুখ্যত দু’ধরনের প্রতিক্রিয়া। প্রত্যাশিত ভাবেই একটি বড় অংশ নিন্দায় মুখর হয়েছেন। অন্য একটি অংশ এই নিন্দেমন্দকে নীতিপুলিশি বলে মনে করছেন। এই সাদা-কালোর ছকে যেটা বারবারই গুলিয়ে যাচ্ছে, সেটা ওই প্রাথমিক তিনটি বিষয়— স্থান, কাল এবং পাত্র।
এটা কোনও নতুন কথা নয় যে, ইদানীং তথাকথিত ‘ইতর’ শব্দের ব্যবহার প্রায় সর্বত্রগামী হয়ে উঠেছে। কেন এমন ঘটল, তার সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কার্যকারণের অনুসন্ধান একটি পৃথক আলোচনার বিষয়। কিন্তু জনমাধ্যমের দেওয়াল থেকে রাজনৈতিক ভাষণ, সাধারণ কথালাপ থেকে বিনোদনের বিভিন্ন শাখায় ‘ইতর’ শব্দের ছড়াছড়ি ক্রমশ অতি স্বাভাবিক, হালফিলের লব্জে ‘নিউ নরমাল’ হয়ে উঠছে। লিঙ্গ এবং বয়সের বেড়া আর তেমন চোখে পড়ছে না। সিনেমা হলে, নাটকের মঞ্চে গালাগালি শুনে দর্শকের উল্লাস-অভিজ্ঞতার শরিক আমি-আপনি সকলেই। এমনকি রবি ঠাকুরের গানের যে পঙ্ক্তিটির বিকৃতি নিয়ে এত হইচই, সেটা বেশ কিছু দিন ধরেই ভাইরাল। তার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা আমাদের অজানা ছিল, এমন নয়। ইডেনের ম্যাচে এই লাইন লেখা ব্যানার টিভির পর্দায় ধরা পড়েছিল। আজকের হাহাকার তখন ধ্বনিত হয়নি। এ বারে হল, তার কারণ ঢেউটা এ বার শিক্ষাঙ্গনে আছড়ে পড়েছে। ক্লাসরুমে টেবিল বাজিয়ে গান গাওয়া, কি ক্যান্টিনে হল্লা করার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক অনুষ্ঠানের জমায়েতে জায়গা করে নেওয়ার একটা তফাত আছে। অথবা বলা ভাল, তফাত আছে বা থাকা উচিত বলে মনে করা হচ্ছে বলেই নিন্দামন্দ হচ্ছে। আগামী সময়ে ক্রমে এটাও ‘নিউ নরমাল’ হয়ে গেলে, এই নিন্দা আর থাকবে না। সেটাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত কি না, ভেবে দেখার অনুরোধ রইল।
‘ইতর’ শব্দ নিয়ে আপত্তি তোলা মানেই নীতিপুলিশি, এতটা সরলীকরণ সব সময় না করলেও চলে। করলে, সেটা নিরালম্ব এবং প্রেক্ষিতবিযুক্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা। যে কোনও ভাষারই ‘ইতর’ শব্দের ভাণ্ডার আছে। এমনকি, সেই ভাণ্ডার কতটা সরেস, তা দিয়ে একটা ভাষার শক্তি এবং চলিষ্ণুতার আন্দাজ পাওয়াও সম্ভব। ঠিক একই রকম ভাবে ভাষা ব্যবহারের নানা পরিসরও আছে। পরিসরের নিজস্ব মানচিত্র আছে। সেগুলো গুলিয়ে ফেললে ভাষার দৈন্য যেমন প্রকট হয়, কাণ্ডজ্ঞান এবং পরিমিতির অভাবটা বেআব্রু হয়ে ওঠে তার চেয়েও বেশি। ঘনিষ্ঠ বন্ধুমহলে যে ভাষায় কথা বলি, মা-ঠাকুমাদের সামনে যে সেই ভাষা বলি না, তাতে ভাষার কণ্ঠরোধ হয় না, আমাদের চরিত্র দুর্বলও হয়ে যায় না। ভাষার বৈচিত্রের সংরক্ষণ সম্ভব হয়। ঘরের ভাষা, বাইরের ভাষা, রকের ভাষা, পোশাকি ভাষা--- সবেরই নিজ নিজ চৌহদ্দি এবং উপযোগিতা আছে। এই সহজ সত্যটুকু ভুলে গেলে বেঅকুবি হবে, রবিঠাকুর তো বটেই পুরন্দর ভাটও ক্ষমা করবেন না।
মুশকিল হল, জনমাধ্যমের রমরমায় ভাষার এই চেনা চৌকাঠগুলো হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। ফেসবুক-টুইটারের দেওয়ালে আমাদের যে অনন্ত দিনলিপি, তার ভাষাগোত্র নির্ধারণ করাই দুষ্কর। সেখানে একই সঙ্গে বিজয়ার প্রণাম আছে, ট্রোলও আছে। কবিতা আছে, আড্ডাও আছে। স্বগতোক্তি আছে, জনসভাও আছে। যেটা নেই, সেটা লাগাম। গোটা দিনমান এই বারোয়ারি উঠোনে নাওয়াখাওয়া সারতে সারতে শিষ্টতার পর্দাগুলো আপনা থেকেই খসে পড়েছে। ন্যূনতম আবডালের ধার আর কেউ ধারেন না। চায়ের দোকানে যে কথাটা মানায়, উন্মুক্ত দেওয়ালে আড়াই হাজার লোকের সামনে সেই বাক্যটা যে কদর্য শোনাতে পারে, সেই বোধটুকুই দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে। এ-ও এক ‘নিউ নরমাল’।
এই নব্য ভাষামণ্ডলে সবচেয়ে ক্ষতি যদি কারও হয়ে থাকে, তবে তা ওই তথাকথিত ইতর ভাষারই হয়েছে। শিল্পে-সাহিত্যে মোক্ষম ব্যবহারে সে ভাষার মধ্যে দিয়ে যে অন্তর্ঘাতের বীজ বোনা হত, আজ তার দিন গিয়াছে। শ্রেণি-বর্ণ-জাত খুইয়ে ট্রোলের রাজত্বে ইতরতাই আজ সম্রাট। একই শব্দসঞ্চয় ঘুরিয়েফিরিয়ে বলে যাচ্ছি। সেই ভাষাতেই আমোদ করছি, সেই ভাষাতেই খিমচে দিচ্ছি, সেই ভাষাতেই ডায়লগ লিখছি। হ্যাঁ, সেই ভাষাতেই বিপ্লবের বাণীও আওড়াচ্ছি।
ণত্ব-ষত্ব লোপ পাওয়া এই বসন্তে রবীন্দ্রভারতীর ঘটনাতেও যে তাই অনেকে শেকল ভাঙার গান শুনতে পাবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী! তাঁরা ভুলে যাবেন, রবিপুজো যদি বাঙালির একটা বদভ্যাস হয়েও থাকে, ঠাকুরঘরে জঞ্জাল ফেলে আসাটা তার নিদান হতে পারে না। রবীন্দ্রভারতীর ঘটনাকে শুধু রবিভক্তদের শুচিবায়ু বলে দেখারও কোনও কারণ নেই। বস্তুত প্রশ্নটা মোটেই রবি-বিকৃতির নয়। ছেলেদের বুকে যা লেখা ছিল, তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জড়িত নন। মেয়েদের অনেকের পিঠে যা লেখা ছিল, তার সঙ্গেও নন। ভাষা ও সংস্কৃতির দৈনন্দিনতায় এই মুহূর্তে আমরা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, এটা সেই চালচিত্রের একটা ঝলক মাত্র। এই ‘বিবর্তন’ এক দিনে হয়নি। আজ কিছু তরুণ-তরুণীকে কাঠগড়ায় তুলে আখেরে লাভ হবে না।
‘কাঠগড়া’ কথাটা এখানে প্রতীকী নয় কিন্তু। ইতিমধ্যেই প্রকাশ্য অশালীনতার অভিযোগে পুলিশের কাছে এফআইআর হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। সেখানে ছাত্রছাত্রীদের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সেটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেখার কথা। যে কোনও বিষয়ে পুলিশ-প্রশাসন-রাষ্ট্রকে টেনে আনাটাও অত্যন্ত বিপজ্জনক এক প্রবণতা। এই লকগেট খুললে কাল টি শার্টে লেখা স্লোগান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, পরশু পার্কে প্রেমিক-প্রেমিকাদের উপরে আক্রমণ হবে। কী আঁকবেন, কী লিখবেন, কী নাটক করবেন তার উপরে নিত্যদিন নজরদারি চলবে। চলবেই বা বলছি কেন, বাক্স্বাধীনতার উপরে যে জোয়াল ইদানীং চেপে বসেছে, তাতে হাল্লারাজার প্রজারা বোবা হয়েই গিয়েছেন প্রায়। যেটুকু ফিসফিস করা যাচ্ছে, নিজেদের নির্বুদ্ধিতায় তার পথটা বন্ধ না করাই শ্রেয়। খেয়াল রাখা দরকার, যাঁরা ক’মাস আগে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছিলেন, তাঁরাই আজ অনেকে রবীন্দ্রভারতীর ঘটনায় রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দের বাংলার ‘কী হল গো’ বলে মরাকান্না জুড়েছেন। ‘আর নয়, আর নয়’ বলে শিরা ফোলাচ্ছেন। তাঁদের খাসতালুকে এই সে দিন মেয়েরা পিঠে প্রবল প্রতাপান্বিত দুই রাষ্ট্রনায়কের মুখ এঁকে পোজ় দিচ্ছিলেন। অশালীনতা মানে শুধু কয়েকটা শব্দ নয়, ফ্যাসিবাদের পায়ে লুটিয়ে পড়াটাও তার মধ্যে পড়ে।
ফায়জানের কথা মনে পড়ছে? রাজধানীর রাস্তায় পড়ে কাতরানো যুবক। যাঁকে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বলা হচ্ছিল আর আজাদি আজাদি বলে ব্যঙ্গ করা হচ্ছিল। এই ভিডিয়ো শেয়ার করে এ দেশের অসংখ্য মানুষ উল্লসিত হয়েছেন। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে লিখেছেন, ‘‘চলো! দিল্লি পুলিশনে আজাদি বাঁটনা শুরু কি।’’ অশালীনতার এই উৎসবও আমরা দেখেছি। ফায়জান মরে বেঁচেছেন। এ দেশে আর কোনও দিন তাঁকে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে হবে না। শুধু ওই— স্থান কাল পাত্রটা একটু মনে রাখা ভাল। রবি ঠাকুরের গানের শরীরে এখন রক্ত লেগে আছে। সময়ের দাবি কোনটা? মূর্তি ভাঙা, না মূর্তি আগলানো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy