অতিরিক্ত আত্মতুষ্টিই কি কাল হল? মঙ্গলবারের জঙ্গি হামলার পরে উপত্যকার বাতাসে ভাসছে এই প্রশ্নই।
গত মার্চ মাসে কোয়েটা থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে বোলান পাসের কাছে জাফর এক্সপ্রেসের দখল নিয়েছিল বালুচ লিবারেশন আর্মি বা বিএলএ বিদ্রোহীরা। বেছে বেছে মারা হয়েছিল ট্রেনে সফরকারী পাকিস্তান সেনার অফিসার-জওয়ানদের। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে পাক প্রশাসন তাদের দেশের মানুষকে বোঝায়, পুরো ঘটনার পিছনে রয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল উইং’ বা ‘র’। যদিও এমন কোনও প্রমাণ মেলেনি। একটি সূত্রের দাবি, ওই এলাকায় র-এর যোগাযোগও তলানিতে। তবু এই যুক্তি দেখিয়েই জঙ্গিদেরও উস্কানি দিয়েছে পাকিস্তানের প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। তাই বালুচ বিদ্রোহীরা যেমন সেনার পরিচয় জেনে নিয়ে হত্যালীলা চালিয়েছিল, এ ক্ষেত্রেও হিন্দু পরিচয়ের ভিত্তিতে পর্যটকদের হত্যা তার বদলা নিতে ঘটানো হয়েছে বলে এখন মনে করছেন গোয়েন্দাদের একাংশ।
কিন্তু জঙ্গিরা যে পর্যটকদের নিশানা বানাবে, সেটা নিরাপত্তা বাহিনী থেকে শুরু করে গোয়েন্দা কর্তারা কেউই ভাবতে পারেননি। জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের এক পদস্থ কর্তার কথায়, ‘‘উপত্যকায় সন্ত্রাস যখন তুঙ্গে ছিল, তখন বিদেশি পর্যটকদের উপরে কিছু হামলা হয়েছে। দেশীয় পর্যটকদের এক-দু’টি ক্ষেত্রে নিশানা করা হলেও সাধারণত তাঁদের উপরে খুব বেশি হামলা হয়নি। কারণ, দেশীয় পর্যটকদের উপস্থিতি কাশ্মীরিদের আয়ের বড় উৎস ছিল।’’ সমস্যা হল, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পরে গত কয়েক বছরে কাশ্মীরে পর্যটকদের উপস্থিতি লাফিয়ে বাড়লেও, পর্যটনস্থলগুলিকে সুরক্ষিত করতে তৎপর হয়নি প্রশাসন। উল্টে যত পর্যটক বেড়েছে, তত ঢিলেঢালা হয়েছে নিরাপত্তা। তার সুযোগ নিয়েছে জঙ্গিরা। অথচ পহেলগাম বা গুলমার্গের মতো পর্যটনস্থলগুলিতে পর্যটকেরা আবার অল্প অল্প করে ফিরতে শুরু করেছেন।
শ্রীনগরের লালচক ও ডাল লেকের কাছেও বেশ কিছু পর্যটককে ঘুরতে দেখা গেল। অনেকেরই ফেরার টিকিট রয়েছে আগামী সপ্তাহে। স্থানীয়দের ভরসাতেই রয়ে গিয়েছেন তাঁরা।
ঘরোয়া ভাবে পহেলগামের বৈসরনে জঙ্গি হামলার পিছনে গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে গেড়ে বসা আত্মতুষ্টিকেই পরোক্ষে দায়ী করা হচ্ছে। অভিযোগের নিশানায় রয়েছেন রাজনীতিকেরাও। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার হওয়ার পরে পরিস্থিতি ‘প্রায় স্বাভাবিক’, এমন একটি বার্তা দেশবাসীর মনে বারংবার গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করেছে বর্তমান শাসক শিবির। খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে একাধিক বার দাবি করেছেন যে, কাশ্মীরে জঙ্গি তৎপরতা একেবারেই কমে গিয়েছে। পরিস্থিতি কার্যত স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, পর্যটকদের উপস্থিতি বাড়ায় আম কাশ্মীরবাসীর আয় বেড়েছে, ফলে তাঁরা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
অনেকের মতে, রাজনৈতিক ওই ভাষ্য ধারাবাহিক ভাবে প্রচার করায় তা মানসিক ভাবে প্রভাব ফেলেছে নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দাদের মনেও। পুলওয়ামার পরে বিক্ষিপ্ত কিছু কাশ্মীরি পণ্ডিত এবং ভিন রাজ্যের ঠিকা কর্মীকে হত্যা করা ছাড়া বিশেষ কোনও জঙ্গি আক্রমণ না হওয়ায় সার্বিক ভাবে বাহিনীর মধ্যে যে একটা আত্মতুষ্টি চলে এসেছিল, তা মেনে নিচ্ছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরাও। তৃণমূল স্তরে তথ্য সংগ্রহ ভাঁটা পড়েছিল। ফলে বৈসরনে যে হামলা হতে পারে, তা ঘুণাক্ষরে টের পাননি গোয়েন্দারা। সবর্দলীয় বৈঠকে সেটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তথা সরকারও। এটা বিরল ঘটনা।
আত্মতুষ্টির সুযোগে উল্টো দিকে ওই সময়ে ‘ওভার গ্রাউন্ড নেটওয়র্ক’ বানানোয় পাল্টা মনোযোগ দেয় আইএসআই। সূত্রের মতে, সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রেও পদ্ধতিগত কিছু পরিবর্তনের রাস্তা নেওয়া হয়। অতীতে দলে দলে যুবককে সন্ত্রাসমূলক কাজে নামার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হত। খবর ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকত। সেই পদ্ধতি পাল্টে সত্যিই জেহাদে বিশ্বাসী এমন যুবকদের কাছে টানার চেষ্টা শুরু হয়। যাদের একটি অংশ পহেলগামের জঙ্গিদের তথ্য দিয়ে, যাতায়াতের রাস্তা দেখিয়ে হামলা চালানো ও হামলার পরে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় বলে প্রাথমিক তদন্তে পেয়েছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা বা এনআইএ। গোয়েন্দাদের মতে, এই নেটওয়ার্কে বিশেষ ভাবে জোর দেওয়া হয়েছে শিক্ষিত যুবকদের উপরে। আপাতত গোটা কাশ্মীরে ছড়িয়ে থাকা ওই নেটওয়র্ক ও স্লিপার সেলগুলিকে চিহ্নিত করে সেগুলিকে নিকেশ করাই বড় চ্যালেঞ্জ গোয়েন্দাদের কাছে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)