Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

পম্পেইয়ের গল্প

ভিসুভিয়াস জাগল, সার্নাস নদীর তীরে শহরটা ইতিহাস হয়ে গেল। আর হুগলির ধারে আর এক শহরের পায়ের নীচে প্লেট সরে গেলে?তীব্র গরমে পর পর ভূমিকম্প দুই শহরকে এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছিল। হুগলি নদীর তীরের শহরটিতে ভূমিকম্পের পরই পাতাল রেল বন্ধ হয়ে যেত, বহুতল বাড়ি ও উড়াল পুলে চিড় ধরত। শপিং মল ও সিনেমা হল থেকে লোকেরা বেরিয়ে আসত, ‘আজও?’ সে দিন আড্ডার বিষয় হত কম্পনের অনুভূতি। এক জন সোৎসাহে জানাল, ‘কাগজ পড়ছিলাম।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৫ ০০:০৫
Share: Save:

তীব্র গরমে পর পর ভূমিকম্প দুই শহরকে এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছিল। হুগলি নদীর তীরের শহরটিতে ভূমিকম্পের পরই পাতাল রেল বন্ধ হয়ে যেত, বহুতল বাড়ি ও উড়াল পুলে চিড় ধরত। শপিং মল ও সিনেমা হল থেকে লোকেরা বেরিয়ে আসত, ‘আজও?’ সে দিন আড্ডার বিষয় হত কম্পনের অনুভূতি। এক জন সোৎসাহে জানাল, ‘কাগজ পড়ছিলাম। হঠাৎ দেখি চেয়ারটা দুলে উঠল।’ অন্য জন বেজার মুখে জানাল, ‘বাসে ছিলাম, টের পাইনি।’ ভূমিকম্পই নির্ধারণ করে দিত, গাঙ্গেয় সভ্যতায় কে কতটা অনুভূতিপ্রবণ!

হুগলি-তীরের এই শহরটি অর্বাচীন। প্রাচীন পুঁথিতে আছে, ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অগস্ট জোব চার্নক নামে এক বণিকের জাহাজ এখানে নোঙর ফেলেছিল। অন্য দিকে, ৭৯ খ্রিস্টাব্দের ওই ২৪ অগস্টই ভিসুভিয়াসে অগ্ন্যুৎপাত শুরু, ধ্বংস হয়ে যায় সার্নাস নদীতীরের পম্পেই নগরী। বিশ্বাসীদের কারও কারও ধারণা, পম্পেই নগরীই নাকি হুগলির তীরে পুনর্জন্ম নেয়।

তো, পম্পেই নগরীর শেষ দিনে অ্যাম্ফিথিয়েটারে খেলা দেখাতে আনা হয়েছিল এক বাঘ ও সিংহকে। ভাবা হয়েছিল, তারা আঁচড়ে কামড়ে রক্তাক্ত করে দেবে। তারা সে দিন লড়তে চায়নি, কোনও এক আতঙ্কের পূর্বাভাস পেয়ে শান্ত। হুগলি-তীরের শহরটিতেও রাজনীতির আরিনা-য় বাংলার বাঘিনি ও গুজরাতের সিংহের দেখা হয়েছিল। আক্রমণ নয়, দেখা গেল শান্ত সৌজন্য। সিংহের মুখব্যাদানেও ছিল না সারদা-গর্জন। রাজ্যসভার আকাশে ভিসুভিয়াসের কালো মেঘের মতো বুঝি ঘনিয়ে আসছে বিভিন্ন বিল পাশ না করাতে পারার শঙ্কা।

সারদা-গর্জন আসলে দেবীগর্জন। হুগলিতীরের শহরে কয়েক মাস আগেও রমরমিয়ে চলছিল সারদা নামে এক দেবীমন্দির। জনতা সেখানে টাকা রেখে আশীর্বাদধন্য হত। একদা পম্পেই শহরের আইসিস মন্দিরে এমনটাই ঘটত। বাণিজ্যে রওনা হওয়ার আগে বণিকরা সেখানে স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা দান করে দেবীর বরাভয় চাইতেন। কোথায় দেবী? আইসিসের নামে জমা হওয়া সমস্ত ধনরত্ন হাতিয়ে নিত আর্বাসেস নামে এক ধূর্ত মিশরীয়। জনমানসে আইসিসকে জাগ্রত করে তোলার বিভিন্ন ফন্দিফিকির ছিল তারই ব্রেনচাইল্ড। সততার মুখোশের আড়ালে কত যে ভয়ঙ্কর মুখ লুকিয়ে থাকে, পম্পেই-এর আইসিস মন্দিরই দুনিয়াকে প্রথম দেখিয়েছিল।

এবং সুরা। মদই দুই শহরের প্রধান অর্থনীতি। হুগলি-তীরের শহরটিতে সিন্ডিকেট ব্যতীত অন্য শিল্প ছিল না, আবগারিই রাজস্বের প্রধান উৎস। পম্পেই শহরে তৈরি বিভিন্ন মদ বিখ্যাত, সেগুলি যেত রোম শহরে। অগ্ন্যুৎপাতের আগে উর্বর জমিতে গম, যব, বার্লি ও হরেক দানাশস্যে সবুজ হয়ে থাকত মাটি। কৃষিই ছিল পম্পেইয়ের ভিত্তি, ভূমিকম্প ভবিষ্যৎ।

ছিল বখরার জন্য লড়াই-করা মাস্তান সব মল্লযোদ্ধা। কখনও তরুণ বীর লাইদন ছুরি হাতে হারিয়ে দেয় অভিজ্ঞ গ্ল্যাডিয়েটর তেত্রাইদিসকে, কখনও নাইজারের হাতে ধরা লোহার জালে বন্দি হয় প্রতিদ্বন্দ্বীরা। লড়াইয়ে জিতে এরা টাকা পায় ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও দ্বিগুণ মুনাফা করে পম্পেইয়ের অভিজাতরা। তারা এক-এক জন মল্লকে নিয়ে বাজি ধরে। গাঙ্গেয় সভ্যতাতেও ক্ষমতাবানরা গ্ল্যাডিয়েটর পুষতেন। পিংলা টু কাটোয়া, তাদের বোমায় চমকে উঠত।

দুই সভ্যতাতেই ছুটত গুজবের রথ। রোমান সেনাপতি মার্কাস সিসেরো তুরস্কের কাছে বদলি হচ্ছেন। বন্ধুদের বলে গেলেন, অন্যদের চিঠি, রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক সব যেন তাঁকে লিখে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ‘‘জানি, অনেকেই খবর পাঠাবে, তার চেয়েও বেশি গুজব রটাবে।’’ লিখলেন তিনি। গাঙ্গেয় সভ্যতার সোশাল নেটওয়র্ক অবশ্য শুধু কপি-করা চিঠির ওপর নির্ভর করত না। ভূমিকম্পের সময় সেখানে ফেসবুক থেকে হোয়াটস্অ্যাপ সর্বত্র খবর আসত, সাবধান! আজ রাত তিনটেয় আরও বড় মাত্রার ভূকম্পন।

পম্পেইয়ে ভূমিকম্পের কারণ ছিল আগ্নেয়গিরির জেগে ওঠা। যে ভিসুভিয়াসকে সবাই জানে শান্ত, সেখানে আচমকা আগ্নেয় বিস্ফোরণ। আর গাঙ্গেয় সভ্যতার অন্তরে ছিল সর্পিল চ্যুতির বিশ্বাসঘাতকতা। কেউ জানত না, বহু দূরে নেপাল হিমালয়ে কখন একটি প্লেট আর একটি প্লেটের নীচে ঢুকে গিয়ে সবাইকে কাঁপিয়ে দেবে। নিঃশব্দে পায়ের নীচের প্লেট সরিয়ে নেওয়াটা আধুনিক গাঙ্গেয় সভ্যতার কৌশল। ধ্রুপদী রোমান সভ্যতার নয়।

তবে দুটি সভ্যতাই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের। গঙ্গারিডিতে এক কালে আগ্নেয়গিরির শিখরে পিকনিক নিয়ে অনেক শঙ্কা, অনেক সতর্কবাণী। কিন্তু সে-সব সত্তরের দশকেই জুিড়য়ে গিয়েছিল, তার ওপর চৌত্রিশ বছরের পলি পড়ে সব শান্তিকল্যাণ। পম্পেইও রোমান অধিকারে আসার পর বিদ্রোহ জানায়, খ্রিস্টের জন্মের ৮০ বছর আগে সেই বিদ্রোহ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। তার পর প্রাচীরে গ্রাফিত্তি, ঘরবাড়ি থেকে ফুলদানি সর্বত্র ছবি আঁকার অলঙ্করণ।

রোমান সভ্যতায় বীর নায়কেরা ছিলেন। পম্পেইয়ের শেষ দিনে মিসেনাম শহরে বই পড়তে পড়তে রোমান নৌবহরের সেনাপতি ‘প্লিনি দি এল্ডার’ দেখতে পেলেন আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। একটু বাদে ভিসুভিয়াসের পাদদেশ থেকে এক মহিলার চিঠি: বাঁচান। প্লিনি সঙ্গে সঙ্গে জাহাজ নিয়ে এগোলেন। আকাশে ঘন ছাই, অপরাহ্ণেই অন্ধকার, নদীতে গলিত লাভার স্রোত। ক’জনকে বাঁচিয়ে সেনাপতি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। গাঙ্গেয় সভ্যতার ভূমিকম্পে পুলিশ, দমকল, সেনাবাহিনি ছিল, কন্ট্রোল রুম ছিল, ছিল হতচকিত মন্ত্রীদের নবান্ন থেকে নেমে রাস্তায় মোবাইল হাতে বসে পড়া। ছিল না ব্যক্তিগত বীরগাথা।

একুশ শতকের হুগলি-তীরে কোথা থেকেই বা রোমান বীর আসবে? ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক এডওয়ার্ড বুলওয়ার লিটন-এর ‘দ্য লাস্ট ডেজ অব পম্পেই’-এর নায়ক গ্লকাস সেই শহরে আসার পথে দেখেছিল জীর্ণ মিনার্ভা মন্দির। লোকে মদ্যপান, বাজি ধরা, মল্লযুদ্ধ, হইচইয়ে মেতে থাকে, জ্ঞানের দেবীকে পাত্তা দেয় না। হুগলি-তীরে জ্ঞানচর্চার মন্দিরগুলি বোমারু রাজনীতির অ্যাম্ফিথিয়েটারে পরিণত হয়।

দুই সভ্যতাতেই কবি ও শিল্পীরা ছিলেন রাজনৈতিক ক্ষমতার ছত্রছায়ায়। পম্পেই-যুগে দার্শনিক সেনেকা থেকে কবি লুসান, অনেকেই তখন সম্রাট নিরোর কাছের লোক। অব্যবস্থিতচিত্ত সম্রাট অবশ্য পরে দু’জনকেই আত্মহত্যার নির্দেশ দেন। তা, সে আর কী করা? ক্ষমতাবানেরা অব্যবস্থিতচিত্ত হয়েই থাকেন, বিরুদ্ধ কথা শুনলেই গর্দান নেন। কিন্তু কবি, দ্রষ্টা বা দার্শনিকদের রুখবে কে? দার্শনিক সেনেকা তাই সটান বলেছিলেন, ‘তরবারি কাউকে খুন করতে পারে না। সে শুধুই খুনির হাতের যন্ত্র।’ গাঙ্গেয় সভ্যতার বিদ্বজ্জনেরা অবশ্য ছিলেন অন্য রকম। কেউ সম্রাজ্ঞীর ভিজে চেয়ার মুছে দিতেন। কেউ ছত্রধরকে নিয়ে গান বেঁধেও বিনোদনসভায় চুপ করে যেতেন। পলিমাটিতে পায়ের নীচে প্লেট বাঁচানোর কৌশল।

রোমান সভ্যতা ঠেকে শিখেছিল। ভিসুভিয়াস যে কবে জাগবে, অগ্নি উদ্গিরণ আর ভূমিকম্পে সবাইকে টালমাটাল করে দেবে কেউ জানে না।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE