প্রতীকী ছবি।
বিস্ময়ের কিছুই নাই, শুধু একটু চমক লাগিয়াছে। চোরাই কয়লার ব্যবসা কিংবা সীমান্তের গরু পাচার যে ব্যাঙ্কের চেক কাটিয়া হয় না, তাহা শিশুও জানে। তবু কয়লা কারবারির একটি অ্যাকাউন্ট হইতে ১৩০ কোটি টাকা উদ্ধার, কিংবা গরু পাচারে অভিযুক্তের ছয়-সাতটি প্রাসাদোপম বাড়ির সংবাদে ছাপোষা গৃহস্থ হোঁচট খায়। বেতন-পেনশনের জগতে যাহা দুষ্প্রাপ্য, অপর এক সমান্তরাল জগতে তাহা রাখিবার জায়গা নাই। পাথর খাদান-বালি খাদানের চোরাকারবারে, অবৈধ ভেড়ি আর ইটভাটাতে, সীমান্তে গরু কিংবা ঔষধ পাচারে তো নগদেরই একাধিপত্য। রাজনীতি ও অর্থনীতি, উভয়ের সুতা তাহারই হাতে। অপরাধ-প্রসূত অপরিমিত সম্পদ যেন ভারতে গণতন্ত্রের রঙ্গমঞ্চের নির্দেশক হইয়া উঠিয়াছে। আড়ালে থাকিয়া তাহা কুশীলব নির্ধারণ করে, চিত্রনাট্য স্থির করিয়া দেয়, সংলাপও রচনা করে। যাহারা এক দিন বলিয়াছিল, নোটবন্দির দুঃখ সহিলে কালো টাকা অদৃশ্য হইবে, আজ তাহারা সেই সংলাপ ভুলিয়াছে। এখন তাহারা বলিতেছে: কালো টাকার প্রাবল্য কেন্দ্রের নীতির ব্যর্থতার নিদর্শন নহে, রাজ্য সরকারের দুর্নীতির প্রমাণ। অপর পক্ষে রাজ্যের নালিশ, নির্বাচনের পূর্বে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিতেছে কেন্দ্র। ভূরি ভূরি দুর্নীতির দায়ে কি কেন্দ্রের শাসক দলও দায়ী নহে? তাহার তদন্ত কোথায়?
রাজ্যবাসী কান পাতিয়া রহিয়াছে, যদি দুই পক্ষের এই সকল অতি-পরিচিত সংলাপের ফাঁকে একটি নূতন তথ্য, এক ছটাক সত্য, মিলিয়া যায়। ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার দুর্নীতির মামলার কিনারা আজও হইল না। কখনও তদন্তকারীরা পড়ি-মরি ছুটিয়া সংবাদে তুফান তুলিয়া দেন, আবার কখনও অতি মন্থর হইয়া মিলাইয়া যান। যেন তাঁহাদের কাজের গতি নির্ধারণ করিতেছে কোনও অদৃশ্য অঙ্গুলি। আয়কর দফতর পশ্চিমবঙ্গে অবৈধ কয়লা কারবার লইয়া, কিংবা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই সীমান্তে গরু পাচার লইয়া তদন্ত শুরু করিতে না করিতে নেতাদের পরস্পরকে বিঁধিবার পালা শুরু হইয়াছে। যেন এই অনুসন্ধান অপরাধমুক্তির অভিযান নহে, নির্বাচনী যুদ্ধে অস্ত্র জুগাইবার অভিযান। আইনের শাসন অছিলা মাত্র। এই পর্যায়ে রাজ্যবাসী কিছু নাম পাইল। যথা অবৈধ কয়লা বেচাকেনায় অভিযুক্ত অনুপ মাজি, গরু পাচারে অভিযুক্ত এনামুল হক। কিন্তু সে সকলের মূল্য কী? সহস্র কোটি টাকার কারবার এক ব্যক্তি এক বৎসরে গড়িয়া তোলে না। বিবিধ চোরাকারবার সর্বসমক্ষে প্রতি দিন ঘটিয়া থাকে। উন্মুক্ত হিংসা তাহার অন্যতম প্রকাশ। ‘তদন্ত’ কি তবে নিয়মরক্ষা মাত্র? অথবা দলীয় রাজনীতির প্রকরণ?
কয়লা অথবা বালি খাদান, পাথর খাদান, খড়ি খাদান, ভেড়ি, ইটভাটা ঘিরিয়া একটি সমান্তরাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নানা অঞ্চলে গড়িয়া উঠিয়াছে। কয়েক লক্ষ মানুষ তাহার সহিত সংযুক্ত, তাহাদের লেনদেনের নিজস্ব সঙ্কেত ও পদ্ধতি কাজ করিতেছে। দুষ্টচক্রে বাঁধা পড়িয়া এলাকার রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশ, সকলই ঘুরিতেছে। চাহিদা-জোগানের ব্যবস্থা একাধিক রাজ্যে বিস্তৃত, সেগুলিতে নানা দলের সরকার ক্ষমতাসীন। এতগুলি রাজ্যে, এমনকি আন্তর্জাতিক সীমান্তে, পুলিশ-প্রশাসন, শাসক-বিরোধীর নজর কী করিয়া এড়াইয়াছে চোরাকারবারিরা, সেই প্রশ্নটি কোনও দলের পক্ষেই স্বস্তিকর হইবে কি? নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি আধিকারিকদের অংশীদারি ব্যতীত এই ব্যবস্থা চলিতে পারিত না। বহু সাংবাদিক নানা সময়ে দেখাইয়াছেন, কী প্রক্রিয়ায় পাচারচক্র চলিতেছে, কাহাদের সহায়তায়। তাহাতে কিছুই বদলায় নাই। ইহার মোকাবিলা করিতে পারে ভিন্ন এক রাজনীতি, যাহার মূলধন স্বচ্ছতা। তাহার কারবারি নাই। প্রচলিত রাজনীতির নিকট এই ছায়া-অর্থনীতি অপরিহার্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy