দ্য টেল অব আ বালিগার্ড সোলজার।
উপন্যাসটির নাম শুনলে মনে হতে পারে কোনও যুদ্ধের ধারাভাষ্য অথবা কোনও বিপন্ন সৈনিকের আত্মকথন। কিন্তু তেজনাথ ধরের লেখা ‘দ্য টেল অব আ বালিগার্ড সোলজার’ আসলে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক থেকে বিংশ শতকের উপান্তকাল পর্যন্ত কাশ্মীরের ইতিহাসকে বিধৃত রেখেছে।
তেজনাথ ধর এই সময়ের এমন এক লেখক, যিনি সমসাময়িক রাজনীতিকে সাহিত্যরসে জারিত করতে জানেন। তাঁর লিখন, শিল্পের সঙ্গে রাজনৈতিক সচেতনতার মেলবন্ধনের যথার্থ উদাহরণ। সত্যের উদ্ভাস সেই লিখনকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। এই উপন্যাসে তিনি কাশ্মীরের পণ্ডিত সম্প্রদায়কে নিয়ে কলম ধরেছেন। অত্যন্ত গতিময় এই উপন্যাসের এক উজ্জ্বল দিক হল এর সংলাপ। এই সংলাপই পাঠকের সামনে কাশ্মীরি পণ্ডিত সম্প্রদায় সম্পর্কে এমন বহু তথ্য তুলে ধরে, যার সঙ্গে বেশির ভাগ মানুষেরই সম্যক পরিচয় নেই।
উপন্যাস শুরু হয় আহত সৈনিকের কথা দিয়ে, যাকে জনৈক স্বামীজি দয়াপরবশ হয়ে তাঁর আশ্রমে নিয়ে এসে সুশ্রূষা করছেন। সেই সৈনিকের স্মৃতি লোপ পেয়েছে, তার নিজের নামটুকুও মনে নেই। স্বামীজি তাকে জানান, তার নাম মানব। শরীর সেরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সৈনিকের স্মৃতিও ফিরে আসতে শুরু করে। কিন্তু এই ফেরত আসা স্মৃতিটি জন্ম-জন্মান্তরের। মানব মনে করতে পারে, তার পূর্বজ কাশ্মীরি ব্রাহ্মণদের বিজয়ের কাহিনি, পাশাপাশি তাদের দুর্দশার কথাও।
আখ্যানের নায়ক মানব জন্ম-জন্মান্তর পেরতে থাকে এক সাধারণ ব্রাহ্মণ হিসেবে। সে পার হয় রাজা ললিতাদিত্য, তাঁর পৌত্র জয়াপীড় (অষ্টম শতকের শাসক), কোটা রানি, চতুর্দশ শতকে শেষ হিন্দু রাজার রাজত্ব। জৈন-উল-আবদিন (১৩৯৫-১৪৭০)-এর সময়ে সে গবেষক-চিকিৎসক শ্রিয়া ভট্ট। আবার পঞ্জাব-কেশরী রঞ্জিৎ সিংহের আমলে সে বীরবর ধর।
মানবের সাম্প্রতিক জন্ম বিংশ শতকে। ১৯৪৭-এ সে প্রত্যক্ষ করেছে বারামুলায় পাকিস্তানি হানাদারি, ১৯৮৬-তে অনন্তনাগের দাঙ্গা এবং ১৯৮৯ সাল থেকে তার নিজস্ব সম্প্রদায়ের মানুষের দলে দলে ভূমিত্যাগের ঘটনা।
মানবের জন্মান্তরের ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকও পরিচিত হতে থাকেন বিভিন্ন ঐতিহাসিক চরিত্রের সঙ্গে। যাঁদের মধ্যে মহারাজ ললিতাদিত্য, আধ্যাত্মবাদী কবি লাল দেদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। লেখক এখানে যেন গবেষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। ইতিহাসের ধুলো সরিয়ে তিনি নিয়ে এসেছেন কাশ্মীরি শৈব ঐতিহ্যের মরমিয়াবাদী কবি লাল দেদকে, যিনি কাশ্মীরের প্রাচীন ভাষায় রচনা করে গিয়েছেন তাঁর ‘বাক’ সমূহকে।
পাঠক পরিচিত হন ললিতাদিত্যের বৈভব ও প্রতিপত্তির সঙ্গে, সেই সঙ্গে তাঁর আক্ষেপের সঙ্গেও। সুফি সন্ত শামস আরাকির প্রতি অন্যায়ের সঙ্গেও। লেখক তাঁর অভিব্যক্তিকে তুলে ধরেছেন কূটনীতির জটিল পথে, যুক্তিবাদী, নন্দনতাত্ত্বিকদের সঙ্গী হয়ে।
এই সময়ে মানব এক পিতামহের ভূমিকা নিয়ে দেখে যায় তার সম্পত্তির উপর আগ্রাসন। দেখে চলে বিপন্ন মানুষের ভিটেমাটি বিক্রি করে উচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনাস্রোত। ইতিহাসের বহু পতন-অভ্যুদয়কে লেখক তুলে এনেছেন। ক্রমে এই কাহিনি হয়ে দাঁড়ায় এক ভাগ্যতাড়িত জনগোষ্ঠীর ক্রমশ যাযাবর হয়ে ওঠার আখ্যান। যা পাঠককে স্তম্ভিত করে।
তেজনাথের এই উপন্যাস একাধারে পাণ্ডিত্য এবং সৃজনীশক্তির মিশেল। আজকের পাঠকের সামনে যা তুলে আনতে পারে সেই ভূমির জনপ্রিয় ধর্মীয় চেতনা, বহুত্ববাদী ঐতিহ্য, সেই অঞ্চলের যুক্তিবাদী আন্দোলনের প্রবক্তাদের ভাবনাকে, হারিয়ে যেতে বসা নন্দনতাত্ত্বিক ঐতিহ্যকে, তার ঋদ্ধ কাব্য-সাহিত্যকে। এই উপন্যাস পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেয় এক কঠিন সত্যের সামনে। ভাবতে বাধ্য করে, কী ভাবে এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে এমন ঘটনা ঘটতে পারে! উপন্যাসের পাঠক প্রত্যয়ী হতেই পারেন এই ভেবে যে, এই সৈনিক একদিন তার নিজের ‘ভূমি’-তে ফিরে আসবেই। তার দীর্ঘ দীর্ঘ বছরের বঞ্চনার ইতি ঘটবেই। এমন এক ঐতিহাসিক উপন্যাসের জন্য তেজনাথ পাঠকের কাছে ধন্যবাদার্হ হয়ে থাকলেন।
দ্য টেল অব আ বালিগার্ড সোলজার/ তেজনাথ ধর/ প্রকাশক অথরপ্রেস/ দাম ৩৯৫.০০
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy