মৃত্যুর পরে কী? এই প্রশ্ন মানুষকে চিরকাল ভাবিয়েছে। আদিম, গুহাবাসী অবস্থা থেকে সাইবার যুগ পর্যন্ত সে খোঁজ পেতে চেয়েছে মরণের পারের রহস্যের। এই সন্ধানই মানুষকে বাধ্য করেছে এমন এক বিশ্বাসে থিতু হতে, যেখানে মৃত্যুর পরেও একটি ‘জীবন’ বহমান থাকে। সেই অবস্থা বা জীবনটির নাম ‘প্রেতযোনি’ বা সাদা বাংলায় ‘ভূত’। আধুনিক জনপ্রিয় সাহিত্যের একটা বড় অংশে জাঁকিয়ে বসে রয়েছেন ‘তেনারা’। কখনও মজার খোরাক, কখনও বা ভয়ের উপকরণ হিসেবে ভূত অবতীর্ণ হয় সাহিত্যে। কিন্তু ‘লিখিত’ সাহিত্যের বাইরে তার অবস্থান কেমন?
অগণিত মানুষের লোকবিশ্বাসে ভূত ঠিক কোন রূপ নিয়ে দেখা দেয়, তা সাহিত্যের খাসমহলে সচরাচর উঠে আসে না। আবার এমনও হয় যে, সাহিত্যের দরবারে উঠে আসে লোকবিশ্বাস থেকে জন্মানো ভূতের দল। কিন্তু তাদের উপর পালিশ পড়ে সাহিত্যিকের ভাষা সৌন্দর্যের। সেখানে লোকবিশ্বাসের আকাঁড়া ভাবটি কোথাও যেন হারিয়ে যায়। গণবিশ্বাসের সেই আকাঁড়া ভৌতিকতার সন্ধান করলেন তরুণ গবেষক-লেখক ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘দ্য বুক অব ইন্ডিয়ান ঘোস্টস’ গ্রন্থে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের লোকবিশ্বাসে ছড়িয়ে থাকা প্রেত এবং অশরীরীদের বর্ণানুক্রমিক খতিয়ান এই বই। তবে নিছক অভিধান বা কোষগ্রন্থ নয়। ভৌতিক বিবরণ এখানে এসেছে তার রসহানি না ঘটিয়েই। এসেছে সাহিত্যিক সূত্র ধরে। কখনও কাহিনির আকারে কখনও বা তাদের প্রত্যক্ষ চরিত্র বৈশিষ্ট্যকে বর্ণনা করেছেন ঋকসুন্দর। সে দিক থেকে দেখলে বলা যেতে পারে এই বই ভারতীয় ভূতেদের একটি ডাইরেক্টরি।
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের লোকবিশ্বাসে লালিত ভূত বা অতিপ্রাকৃত জীবদের দু’মলাটের মধ্যে ধরতে চেয়েছে এই বই। এতে যেমন সিকিমের শিশু ভূত ‘আচেরি’ রয়েছে, তেমনই রয়েছে বাংলার চিরপরিচিত ‘একানড়ে’। প্রত্যেক অপ্রাকৃতের বর্ণনার শেষে লেখক রেখেছেন তাদের সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য। তাদের স্বভাব কেমন, কতটা ভয়ঙ্কর তারা, দেশের কোথায় তাদের অস্তিত্ব স্বীকৃত ইত্যাদি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অতিলৌকিক এই সব ‘জীব’-দের অস্তিত্বের পিছনে রয়েছে কোনও না কোনও কাহিনি। কোথাও তা নেহাতই লোককথার পরম্পরা, কোথাও আবার সে সবের পিছনে কাজ করছে পুরাণ বা কালোজাদুর আলো-আঁধারির দুনিয়া। এই বইতে যেমন স্থান পেয়েছে হিন্দু পুরাণে উল্লিখিত গন্ধর্বরা, তেমনই রয়েছে মধ্য এশিয়া বা আরও স্পষ্ট ভাবে বললে ইসলামি পরম্পরায় উল্লিখিত জিন বা ইফরিত। বাংলার ভূতেরা বা তথাকথিত ছায়ালোকের বাসিন্দারা যথেষ্ট পরিমাণে উঠে এসেছে এই বইয়ের পাতায়। একানড়ে তো বটেই, রয়েছে বাঙালির চিরচেনা ‘মাঁছটাঁ দেঁ নাঁ’ বলে পিছু নেওয়া মেছোভূতও।
সর্বদাই ভূতেরা যে তাদের চেনা চরিত্রে বইয়ের পাতায় ‘ছায়াশরীর’ বিছিয়ে দিয়েছে, তা নয়। যেমন কানপুর অঞ্চলের ভূত ‘মুনচোওয়া’। এই প্রেত নাকি অন্যের মুখাবয়বটুকু চুরি করে পালায়। শুধু রেখে যায় দু’টি নাসারন্ধ্র আর চোখ। গ্রন্থের বিবরণীতে রয়েছে একটি ছোট্ট গল্প। সদ্য মডেলিং জগতে পা-রাখা এক তরুণীর মুনচোওয়ার পাল্লায় পড়ার কাহিনি। অল্প পরিসরে হাল্কা মোচড়ে সেই কাহিনি সহজে পিছু ছাড়ে না। মুনচোওয়া যদি স্বল্পপরিচিত হয়ে থাকে, তা হলে কয়েক পাতা উল্টালেই দেখা পাওয়া যাবে ‘নালি বা’-র। ‘স্ত্রী’ নামের এক সাম্প্রতিক হিন্দি ছবির দৌলতে সে বেশ বিখ্যাত। ‘নালি বা’ এক প্রেতিনী। সে এসে গৃহস্থের দরজায় টোকা দেয়। এক বার মাত্র। সেই টোকা শুনে কেউ দরজা খুললে ‘নালি বা’-র কৃপায় তার ভবলীলা সাঙ্গ। এই লোকবিশ্বাস বেঙ্গালুরু অঞ্চলের। দরজায় এক বার টোকা পড়লে নীচু স্বরে বলতে হয় ‘নালি বা’। যার অর্থ ‘কাল এসো’। এ ভাবেই প্রতিদিন ফেরত পাঠাতে হয় সেই অশুভ আত্মাকে। ‘নালি বা’-র কথাও লেখক এনেছেন এক গল্পের মোড়কে।
গল্পের মোড়কে উঠে এসেছে নিশিডাকের কথাও। গভীর রাতে কেউ তিন বার নাম ধরে না ডাকলে সাড়া দিতে নেই। নিশি নাকি দু’বার মাত্র ডাকে। তাই তৃতীয় ডাকের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এই জায়গায় ‘নালি বা’-র সঙ্গে নিশির মিল। কিন্তু ‘নালি বা’ প্রেতাত্মা আর নিশি অপতান্ত্রিকের অভিচার ক্রিয়ায় উঠে আসা এক শক্তি। তাদের ক্রিয়াও দু’রকম। নিশি বাংলার একান্ত বিশ্বাস। পরে হয়তো তা দেশের অন্যত্র অন্য চেহারায় দেখা দেয়। সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের দিক থেকে দেখলে এই ধরনের কিংবদন্তির গুরুত্ব যথেষ্ট। লেখক অবশ্য তাঁর চর্চা সে দিকে নিয়ে যাননি। এই বই ভূতান্বেষীদের কাছে প্রাথমিক গাইড-গ্রন্থ। কিন্তু দু’একটি জায়গায় খটকা থেকে যায়। যেমন লেখক ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’-র রচয়িতা হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামোল্লেখ করেছেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর এই কাহিনির অনুবাদক মাত্র। ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’-র প্রথম উল্লেখ সোমদেব ভট্টের ‘কথাসরিৎসাগর’-এ। পরে তা শিবদাস নামের জনৈক লেখকের হাতে বিস্তার পেয়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থের আকার পায়। বেতাল ও বিক্রমাদিত্যের আখ্যান সম্ভবত গুপ্তযুগে প্রচলিত মৌখিক কিংবদন্তি। তবে এই বই বিশদে জানিয়েছে ‘প্যাঁচাপেঁচি’, ‘স্কন্ধকাটা’, ‘পোটাচুন্নি’ প্রভৃতি বাঙালি ভূতেদের কথা। রয়েছে কম পরিচিত জলা বা পুকুরবাসী বঙ্গীয় পেত্নী ‘শিকলবুড়ি’-র কথাও। ‘ব্রহ্মদৈত্য’ আর ‘ব্রহ্মরাক্ষস’-এর তফাত কোথায়, তা-ও জানায় এই ‘ভূত-সহায়িকা’। পাশাপাশি, ‘তোলা’ নামের এক কিশোর ভূতের অস্তিত্বও জানিয়েছেন লেখক। সে নাকি উপনয়নের কালে মৃত কিশোরের প্রেত। এই বিশ্বাস বেঙ্গালুরু অঞ্চলের। তবে এই সব ‘ব্রাহ্মণ’ ভূত সে অর্থে আক্রমণাত্মক নয়। বরং ব্রহ্মদৈত্য পারলে মানুষের উপকারই করে।
ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর ‘রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিত চর্চা’ গ্রন্থে উল্লিখিত ভূত বিষয়ক অধ্যায়ে প্রেতজগতে শ্রেণি বিভাজন নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা সেরেছিলেন লেখক। ভূতরাজ্যেও কিন্তু উচ্চ-নীচ ভেদ রয়েছে। উদার-ছ্যাঁচড়া বিভাজন রয়েছে। সর্বোপরি ফল্গুস্রোতের মতো রয়েছে প্রাপ্তি, বঞ্চনা, প্রতারণা ইত্যাদির ইতিবৃত্ত। বিশেষত প্রেতিনীদের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই উঠে এসেছে যৌন প্রতিহিংসার প্রসঙ্গ। এই সব কাহিনির পিছনে রয়ে গিয়েছে সামাজিক অবচেতনের অপরাধবোধ। বঞ্চিতা, নিপীড়িতা নারীর ইহজীবন বিনষ্ট হলে সে পরজীবনে প্রতিশোধ নিতে পারে— এই আপ্তবাক্য অকথিত ভাবে খেলা করেছে বহু আখ্যানেই। প্রেতবিশ্বাসের সামাজিক বা সাংস্কৃতিক গবেষণার প্রাথমিক পাঠ দিতে পারে ঋকসুন্দরের বই। বইটির অলঙ্করণ করেছেন রাকা চৌধুরী। সর্বমোট ৮৪ ভূতের সমাহারে সেই সব ছবি যোগ্য সঙ্গত করেছে।
দ্য বুক অব ইন্ডিয়ান গোস্টস/ ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়/ আলেফ/ ৫৯৯টাকা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy