ফাইল চিত্র।
সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য, অধিকার অর্জনের জন্য সংগ্রাম আর ছোট-ছোট নির্মাণ। যা বিকল্প গড়ার ক্ষেত্রে নতুন রচনার উন্মেষ ঘটাবে। আমরা এই নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছি।’’ শঙ্কর গুহ নিয়োগীর এই কথাগুলো প্রকাশিত হয় একটি সাক্ষাৎকারে (১৯৮৯)। শ্রমিক অধিকারের জন্য গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অনন্য মানুষটির ‘ছোট-ছোট নির্মাণ’-এর একটি হল শহিদ হাসপাতাল।
১৯৮৩ সালের ৩ জুন শুরু হয় শহিদ হাসপাতালের যাত্রা, দল্লি-রাজহরায়। দল্লি-রাজহরার নাম দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে উঠে আসে ১৯৭৭ সালের ২-৩ জুন, যখন তদানীন্তন জনতা সরকার ছত্তীসগঢ় খনি শ্রমিক সঙ্ঘের (সিএমএসএস) আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলি চালিয়ে এগারো জনকে হত্যা করে। তাদের নামেই ‘শহিদ হাসপাতাল’ গড়ে ওঠে শ্রমিকদের স্বেচ্ছাশ্রমে ও অর্থে। পরিচালনায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন শ্রমিকরা। আজও ট্রাস্টের অধিকাংশ সদস্য সিএমএসএস সদস্য। হাসপাতাল উদ্বোধনের লিফলেটের ওপরে স্লোগান ছিল, ‘তুমনে মওত দি, হমনে জিন্দগি।’ বিকল্পের সন্ধানেই তৈরি হয় শহিদ হাসপাতাল। সরকারি চিকিৎসা মানুষের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না, সত্তরের দশকে সেই সমালোচনার শুরু। তখনও অবধি স্বাস্থ্যকে মনে করা হত রাজনীতি-বহির্ভূত, নিরপেক্ষ একটি বিষয়। এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করে স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক, এবং সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, বিষয়টি আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক, স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বৈষম্যের ছাপ স্পষ্ট। তার বিকল্প হিসেবেই ‘জনগণের স্বাস্থ্যের জন্য জনগণের আন্দোলন।’
পনেরোটি শয্যা নিয়ে যার শুরু, আজ তা ১০৬ বেডের ব্যস্ত হাসপাতাল। সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ৭০ বেডের মাতৃসদন। অপারেশন থিয়েটার, অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি, ডিজিটাল এক্স রে ও ফিজ়িয়োথেরাপির সুবিধা নিয়ে এর পরিষেবার আওতায় প্রায় ১০০ কিলোমিটারের আদিবাসী-প্রধান এলাকা। হাসপাতালের ঘোষিত নীতি, দেশি বা বিদেশি অনুদান নেওয়া চলবে না। এমনকি হাসপাতালে দানপাত্র বা ‘ডোনেশন বক্স’ও চোখে পড়বে না। এই নীতির জন্যই শহিদ হাসপাতাল নিজের মতো চলতে পারে, কোনও দাতার নির্দেশে নয়।
শ্রমিক ইউনিয়নের সহায়তা আর রোগীর থেকে ফি নিয়েই দীর্ঘ দিন চলেছে এই হাসপাতাল। সামান্য টাকায় কাজ করেছেন ডাক্তার থেকে স্বাস্থ্যকর্মী সবাই। তবে কয়েক বছর আগে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা আর মুখ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্য বিমা যোজনায় যুক্ত হয়েছে শহিদ হাসপাতাল। রোগীর বিমা থাকলে তার খরচ হাসপাতালকে দেয় সরকার। এর পরে ডাক্তার-কর্মীদের পারিশ্রমিক বাড়ে, টেকনিক্যাল পরিষেবারও উন্নতি হতে থাকে। সম্প্রতি দু’টি খনন কোম্পানি শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করেছে। সেখান থেকেও উপার্জন হচ্ছে। এখন হাসপাতালে আছেন নয় জন ডাক্তার, ছাব্বিশ জন নার্স। সেই সঙ্গে ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান, স্বাস্থ্যকর্মী, অন্যান্য কর্মী মিলিয়ে জনা ষাট। নিজস্ব দু’টি অ্যাম্বুল্যান্স আছে। বিশেষজ্ঞরা আসেন সপ্তাহে অন্তত এক বার। দু’বছর ধরে শুরু হয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা। আলাদা বিভাগে নয়, আউটডোরের ডাক্তারদেরই এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা প্রয়োজন বুঝলে মনোরোগের অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে পাঠান রোগীকে। ফলে মানসিক রোগের জন্য সঙ্কোচের অবকাশ নেই।
কিছু পরিসংখ্যান দেওয়া যেতে পারে। গত বছর এই হাসপাতালে চিকিৎসা পেয়েছেন তেষট্টি হাজারেরও বেশি মানুষ, যাঁদের মধ্যে আউটডোরে দেখিয়েছেন পঞ্চান্ন হাজার। প্রতি মাসে গড়ে আড়াইশোটি প্রসব হয়। সাফল্য কম নয়। তবু শহিদ হাসপাতালের সামনে অনেক প্রশ্ন। সব থেকে বড় প্রশ্ন, হাসপাতাল মতাদর্শ ধরে রাখতে পারবে কি? শঙ্কর গুহ নিয়োগীর মতো নেতা আর আসেননি। এক সময়ে যে ইউনিয়নের হাজার হাজার সদস্য ছিল, আজ তা কয়েকশোতে ঠেকেছে। ইউনিয়ন এখনও কিছু চাঁদা দেয়, কিন্তু এখন হাসপাতালই কার্যত ইউনিয়নের খরচ চালায়!
নতুন কর্মীরা অনেকেই জনস্বাস্থ্য আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলনের ভাগিদার নন। আন্দোলনের মতাদর্শ তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। নতুন ডাক্তাররাও বেশির ভাগই দ্রুত কাজ শিখে অন্যত্র কেরিয়ার গড়ার লক্ষ্যে আসেন। আদিবাসী, দরিদ্র শ্রমিকেরা তাঁদের কাছে শুধুই রোগী।
প্রশ্ন ওঠে, শহিদ হাসপাতাল কি বিকল্প ‘মডেল’ হতে পেরেছে? অনেকেই ‘জনগণের সহযোগিতায় জনস্বাস্থ্য’ আদর্শটি গ্রহণ করেছে। ছত্তীসগঢ়ের বিলাসপুরের ‘জনস্বাস্থ্য সহযোগ’ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। পশ্চিমবঙ্গের বেলুড় এবং সুন্দরবনে শ্রমজীবী মানুষের জন্য হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। তবে যত দূর জানা যায়, দেশি বা বিদেশি কোনও ‘ফান্ডিং’ না নিয়ে, শুধু খেটে-খাওয়া মানুষের সাহায্যে একটা হাসপাতাল চালানোর দৃষ্টান্ত কেবল শহিদ হাসপাতাল। এটি ব্যতিক্রমী।
গুহ নিয়োগী ভেবেছিলেন, স্কুল, গ্যারাজ, হাসপাতাল, এমন ‘ছোট ছোট নির্মাণ’ মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়াবে, যা বৃহত্তর সংগ্রামকে পুষ্ট করবে। তাঁর নানা প্রচেষ্টার মধ্যে হাসপাতালটিই টিকে আছে। বৃহত্তর সংগ্রামের উপর তার প্রভাব কী, সে প্রশ্ন এখন না হয় থাক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy