Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
গালগল্প আর কুসংস্কারে ‘বিজ্ঞান’-এর স্ট্যাম্প

প্রমাণ আবার কী?

কথাগুলো আপাতত সবাই জেনে গিয়েছেন। স্টেম সেল থেকে স্ট্রিং থিয়োরি, মিসাইল থেকে মহাকর্ষ, সব কিছুর চর্চাই যে রামায়ণ-মহাভারতের যুগে ছিল, হকিং থেকে ডারউইন, কেউই যে আমাদের মুনিঋষিদের চেয়ে বড় মাপের কেউকেটা নন, তা নিয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই।

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

কথাগুলো আপাতত সবাই জেনে গিয়েছেন। স্টেম সেল থেকে স্ট্রিং থিয়োরি, মিসাইল থেকে মহাকর্ষ, সব কিছুর চর্চাই যে রামায়ণ-মহাভারতের যুগে ছিল, হকিং থেকে ডারউইন, কেউই যে আমাদের মুনিঋষিদের চেয়ে বড় মাপের কেউকেটা নন, তা নিয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই। কারণ, গত কয়েক বছর ধরে বিজ্ঞানীরাই আমাদের এই সব জ্ঞান বিতরণ করে আসছেন। আর এই বিজাতীয় জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রটি হল বিজ্ঞান কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন।

ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশন ভারতের সবচেয়ে পুরনো সংস্থাগুলোর মধ্যে একটা, যার মুখ্য দফতর কলকাতায় আর যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নামগুলো হল আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ প্রমুখ। ‘এভরিম্যান্‌স সায়েন্স’ নামে একটি বিজ্ঞান পত্রিকা এরা নিয়মিত প্রকাশ করে। ২০১৩ সালে কলকাতায় এদের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানের কথা হয়তো এখনও অনেকের মনে আছে। আকৃতি ও প্রকৃতিতে বিজ্ঞান কংগ্রেসের বার্ষিক অনুষ্ঠানটি প্রায় কুম্ভমেলার কাছাকাছি। দেশের সমস্ত প্রান্ত থেকে সমস্ত বিষয়ের নানা মাপের গবেষক ও বিজ্ঞানীরা এই অধিবেশনে আসেন। বিভিন্ন শাখায় কয়েক জন তরুণ বিজ্ঞানীকে নির্বাচন করে পুরস্কার দেওয়া হয়। বিজ্ঞানের সমস্ত শাখাকে জড়ো করে এমন অনুষ্ঠান ভারতে আর হয় না। তাই উৎকর্ষের বিচারে বিজ্ঞান কংগ্রেসের অনুষ্ঠান যেমনই হোক, ঐতিহ্য, ব্যাপ্তি ও বৈচিত্রের দিক থেকে এর গুরুত্ব অনেকখানি। এ হেন অনুষ্ঠানে অদ্ভুত সব ‘তত্ত্ব’-এর খিচুড়ি পরিবেশন হলে বিপদের আশঙ্কাও গভীর।

বিপদটা প্রথমত অপবিজ্ঞানের, অর্থাৎ বিজ্ঞানের অনুষঙ্গ ব্যবহার করে যুক্তিহীন বিষয় পরিবেশনের। আমাদের পৌরাণিক গল্পগাথাগুলো বেশির ভাগই রূপকাশ্রিত; তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে, ইতিহাস আছে, সে সব নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। সেটা ক্ষতিকর নয় যত ক্ষণ না তাকে বাস্তব বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু পুষ্পক রথকে বিমান বা গণেশের মাথাকে প্লাস্টিক সার্জারির প্রমাণ ইত্যাদি বলে উপস্থাপন করার অর্থ হল কোনও ব্যাখ্যা ছাড়াই কাল্পনিক ঘটনাকে বিজ্ঞানাশ্রিত (অতএব সত্য) বলে বিশ্বাস করানো। বিজ্ঞানের মূল কথাই হল কার্যকারণ সম্পর্কের অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যা, তাই এই ধরনের ধারণা ছড়ানো মানে আসলে বিজ্ঞানচেতনার গোড়ায় আঘাত। আর এক বার বিজ্ঞানের ‘স্ট্যাম্প’ পড়ে গেলে যে কোনও গালগল্প-কুসংস্কার-অন্ধবিশ্বাসের ভিত অনেক বেশি শক্ত হয়ে পড়ে। এটা ক্ষতিকর।

ব্যাপারটা দু’ভাবে ঘটানো হয়। কোনও একটা যুক্তিহীন বিশ্বাসকে বিজ্ঞানসম্মত বলে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কখনও তার সঙ্গে একটা ছদ্ম কার্যকারণ (বা একটা যন্ত্রের অনুষঙ্গ) জুড়ে দেওয়া হয়; তাতে বিশ্বাসটা দৃঢ় হয়ে বসে। যেমন সূর্যগ্রহণের সময় কিছু খেতে নেই, আগের খাবার, জল ফেলে দিতে হয়— এই ধারণার পিছনে রাহু-কেতু’র একটা পৌরাণিক গল্প আছে। ওটা যে গল্প; সত্যি নয়, সেটা মানুষকে বুঝিয়ে বলা সহজ, কিন্তু যেই বলা হল ওই সময় সূর্যের রশ্মি থাকে না বলে বাতাসে জীবাণুর সক্রিয়তা বেড়ে যায়, বা গ্রহরত্নের মধ্যে দিয়ে ‘মহাজাগতিক রশ্মি’ শরীরে ঢোকে, অমনি লোকে ভাবতে লাগল এর পিছনে তা হলে সত্যিই একটা কার্যকারণ আছে। সঙ্গে সঙ্গে ভুল ধারণা ও অন্ধবিশ্বাসটা মনে শিকড় গেড়ে বসে গেল। কখনও আবার বিজ্ঞানীদের কথাকে পছন্দমতো মাপে কেটে নিয়ে অযৌক্তিক বিশ্বাসের সমর্থনে ব্যবহার করা হয়। যেমন আইনস্টাইনের একটা উক্তি: ‘ঈশ্বর মহাবিশ্ব নিয়ে দাবা খেলেন না’। এই উক্তির সূত্র ধরে ঈশ্বরবিশ্বাসীরা আইনস্টাইনকে চির দিন ঘোরতর ঈশ্বরবিশ্বাসী বলে দলে টেনে এসেছেন। কিন্তু আইনস্টাইন নিজেই যেখানে পরিষ্কার করেছেন যে তিনি কোনও ‘ব্যক্তিগত ঈশ্বর’-এ বিশ্বাস করেন না, বলেছেন ‘‘আমি সেই (স্পিনোজ়ার) ঈশ্বরে বিশ্বাস করি যিনি যাবতীয় সুচারু ছন্দ ও নিয়মের মধ্যে প্রকাশিত হন, যিনি মানুষের ভাগ্য ও কর্ম নিয়ন্ত্রণ করেন সেই ঈশ্বরে নয়।’’ সেখানে তাঁকে দলে টানাটা নেহাতই মান্যতা বাড়াতে। অর্থাৎ বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে ভগবান থেকে শয়তান কেউই মান্যতা পাচ্ছে না। আর আধুনিক ‘স্মার্ট’ (ফোনধারী) জনতার বিশ্বাস অর্জন করতে গেলে বিজ্ঞানের (মানে প্রযুক্তির) বিশ্বস্ততা জরুরি। তাই বিজ্ঞানকেই ব্যবহার করতে হচ্ছে বার বার। দেখাতে হচ্ছে, আমরা ধর্মে আছি, বিজ্ঞানেও।

গত কয়েক বছর এই অতীতের বিজ্ঞান গৌরবগাথার জয়গান যে খুব বেশি শোনা যাচ্ছে তার পিছনের কারণটা বোঝা সহজ। এই ‘বিজ্ঞান’ হল বিশুদ্ধ ‘হিন্দু’ বিজ্ঞান যা রামায়ণ-মহাভারত-গীতা-পুরাণে বিস্তৃত। সুতরাং ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞানের পর এ বার বিজ্ঞানকে (!) দিয়েও এই মিথ্যে-কথাটা বলিয়ে নিতে হবে যে প্রাচীন (হিন্দু) ভারতই ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ, যাতে সেই দিকেই আমাদের জয়যাত্রার রথ দৌড়তে পারে। আর তার জন্য বিজ্ঞান কংগ্রেসের বিস্তৃত মঞ্চের চেয়ে ভাল জায়গা আর কী হতে পারে, যেখানে ইস্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরাও আসে, তাদের মাস্টারমশাইরাও আসেন!

প্রাচীন ভারতের এই বিজ্ঞান (!) মূলত প্রায়োগিক বিজ্ঞান, যার ফলাফল হাতে হাতে দেখানো যায়। গবেষণার জগতে যাঁরা আছেন তাঁরা জানেন গত কয়েক বছরে বিজ্ঞান গবেষণায় সরকারের ভূমিকা ঠিক এইখানে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশুদ্ধ গবেষণায় অনুদান প্রায় শূন্য হয়ে গিয়ে ভরে উঠছে কেবল প্রযুক্তি (এবং যোগব্যায়াম) গবেষণার ঝুলি। কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের (ডিএসটি) পাতায় গেলে দেখা যায় প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে ‘বিজ্ঞান’ নিজেই; বিভিন্ন মন্ত্রকের অধীনে যে সব ছোট ছোট প্রকল্পে গবেষণার অনুদান পাওয়ার সুযোগ ছিল, সে সব বন্ধ হয়ে যাবতীয় অনুদান মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের অধীনে একটা-দুটো বড় মাপের প্রকল্পে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এদের মন্ত্রই হল ‘গবেষণা থেকে কারখানা’ অর্থাৎ সরাসরি কৃষি-শিল্প-স্বাস্থ্যে প্রয়োগ হবে এমন গবেষণা, তাতে বেসরকারি সংস্থার অংশগ্রহণও প্রায় বাধ্যতামূলক। বিজ্ঞান দিবস এবং বিজ্ঞান কংগ্রেসের কিছু বছরের ‘থিম’-এর দিকে তাকালেও দেখা যায় গত ক’বছরে ‘থিম’ ক্রমাগত ‘টেকনলজি’র দিকে ঘুরে গিয়েছে, আর এই বছর বিজ্ঞান কংগ্রেসের আসর বসেছেও এক বেসরকারি কলেজ প্রাঙ্গণে, যারা মূলত কারিগরি শিক্ষা দেয়। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

আপাতত ডিএসটি-র পাতা আলো করে শোভা পাচ্ছেন স্বামী বিবেকানন্দ। বছরের বিভিন্ন সময়ে যোগব্যায়াম, স্বচ্ছ ভারত, গাঁধী ১৫০ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের খতিয়ান দেখতে দেখতে ভুলে যাই এ বিভাগটা বিজ্ঞানের। সে কথা থাক। তবে আর্যভট্ট-শ্রীধরাচার্য-কণাদ-বরাহমিহির-সুশ্রুতের কর্মক্ষেত্র যে প্রাচীন ভারত, তার সত্যিকারের বিজ্ঞান-ঐতিহ্যের গৌরব যে নেহাত কম নয়, ধর্মক্ষেত্রের কারবারিরা সেটা বোঝেন না; বুঝলে তাঁদের এত কাল্পনিক বিষয়ের উপর নির্ভর করতে হত না।

ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট-এ শিক্ষক

অন্য বিষয়গুলি:

Indian Science Congress annual meeting
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE