গত পাঁচ বছরে হিন্দুত্ববাদীদের কল্যাণে ‘ঘর ওয়পসি’ কথাটা মুখে মুখে ফিরেছে। এই ছোট্ট কথার আড়ালে এক কালো ইতিহাস উস্কে দেওয়া হয়: আজকের ভারতীয় মুসলমানরা আদতে হিন্দু ছিলেন, মধ্যযুগে মুসলিম শাসকদের অত্যাচারে বাধ্য হয়ে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হন, এখন তাঁদের আবার পুজোআচ্চা করে ঘরে ফেরত আনা হবে। এটা নতুন নয়। একশো বছর আগে পঞ্জাবে আর্যসমাজের নেতা শ্রদ্ধানন্দ এই ধাঁচেই শুদ্ধিকরণ আন্দোলন শুরু করেছিলেন; তারও আগে তাঁর গুরু দয়ানন্দ সরস্বতী একই নিদান দিয়েছিলেন। দয়ানন্দ-শ্রদ্ধানন্দ কদর্য হিন্দুত্ববাদী ছিলেন না, কিন্তু ঘর ওয়পসির গল্পটি তাঁরা বিশ্বাস করতেন। মধ্যযুগের মুসলিম শাসকদের তাড়নায় হিন্দুর মুসলমান হওয়ার গল্প আধুনিক হিন্দু-রাজনীতির প্রাণভোমরা।
অথচ ইতিহাস পড়তে পড়তে খটকা লাগে। সাত-আটশো বছর আগে বাংলায় অনেক নিম্নবর্গীয় হিন্দু-বৌদ্ধ যে মুসলমান হয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করাকে কি তাঁরা ঘরছাড়া হওয়ার মতো মনে করেছিলেন? আজকের হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ঠুলি পরে সে কালের সমাজকে দেখা অর্থহীন। সামাজিক ভাষা ও ধ্যানধারণা দ্রুত পাল্টায়: যেমন ‘সেকুলার’ শব্দটি সাংবিধানিক বিশেষণ থেকে দ্রুত গালিতে পরিণত হয়েছে, তেমনই গত সাত-আটশো বছরে কোটি কোটি মানুষের ধর্ম-সমাজ বহু বার আমূল পাল্টেছে। ঐতিহাসিক সমাজে সত্যের সন্ধান করতে হবে সে কালের চিন্তাভাবনাকে ভিত্তি করে, বর্তমান রাজনীতির বাইরে এসে।
সমস্যা বাড়ে যখন দেখি উনিশ শতকের আগে ইংরেজি ‘কনভার্শন’ শব্দের উপযুক্ত বাংলা প্রতিশব্দই নেই। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের গবেষক টোনি স্টুয়ার্ট সমস্ত বাংলা অভিধান ঢুঁড়েও ইংরেজি থেকে ভাষান্তর ছাড়া শব্দটির হদিস পাননি। প্রথম দিকে কনভার্শনের বাংলা অর্থ হত মন পরিবর্তন বা মনান্তর, ধর্মীয় ইঙ্গিত ছাড়াই। খ্রিস্টান মিশনারিরা ‘কনভার্শন’ বলতে বোঝালেন, পুরনো ধর্ম-সমাজের সব বাঁধন ছিঁড়ে তাঁদের তৈরি খ্রিস্টান সমাজে যোগ দেওয়া। এই প্রক্রিয়া বোঝাতে দিশি শব্দ খুঁজে না পেয়ে মিশনারিরা কিছু নতুন, খটমট শব্দ তৈরি করলেন: ধর্মান্তর, ধর্মান্তর-করণ ইত্যাদি। শ্রীরামপুরি প্রেসের গন্ধমাখা আড়ষ্ট শব্দগুলি মিশনারিরা আসার আগে ছিল না। মিশনারিদের আগে বাংলা হিন্দুস্থানি আরবি ফারসি কোনও ভাষাতেই কনভার্শন কথাটা ছিল না। দিশি শব্দ খুঁজে না পেয়েই তো হিন্দুত্ববাদীদের শুদ্ধিকরণ, ঘর ওয়পসির মতো নতুন অদ্ভুত সব কথা তৈরি করতে হচ্ছে।
মধ্যযুগে ফারসি-বাংলা দুইয়েই ব্যবহার হত সোজাসাপ্টা ইসলাম গ্রহণ বা আরও সোজাসুজি, মুসলমান হওয়া। ধর্মান্তর আর মুসলমান হওয়া কথা দুটোর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম অথচ গুরুতর পার্থক্য রয়েছে। ধর্মান্তরিত হওয়া মানে পুরনো সব বিশ্বাস ও সামাজিক বন্ধন ত্যাগ করে নতুন ধর্ম ও জীবন নেওয়া। মুসলমান হওয়ার অর্থ ঈশ্বরের একত্ব ও মহম্মদের নবি-ত্ব স্বীকার, সেটা পুরনো সমাজ-জীবন না ছেড়েও করা যেত। তার নজির মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে প্রচুর: মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে দেবীর বরে রাজা কালকেতু বন কেটে গুজরাট নগর (মোদীর রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক নেই) পত্তন করেন, সেখানে “বীরের পাইয়া পান, বৈসে যত মুসলমান, পশ্চিম দিগ বীর দিল তারে।” শহরের এক দিকে থাকে ব্রাহ্মণ, ব্যবসায়ী, রাজা প্রভৃতি, আর পশ্চিম নগরে সৈয়দ মোলানা কাজি আসেন, পাঁচ বার নমাজ হয়, পিরের কবরে ফুল-শিরনি হয়, মুরগি-বকরি জবাইও হয়, “জত শিশু মুসলমান, করিয়া দলিজখান, মকদ্দম পড়ায়ে পড়ান; রচিয়া ত্রিপদী ছন্দ, গান কবি শ্রীমুকুন্দ, গুজরাটপুরের বর্ণনা।”
মধ্যযুগের বাংলায় ইসলাম প্রচলন করেন পির-সুফিরা, প্রায়শই তাঁদের ভক্তি-সাধনার ধারা বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনের কাছাকাছি ছিল। ভগবানের প্রতি তীব্র অনুরাগের সম্পর্ক সুফিদের, ঠিক সে যুগের আর এক বিদ্রোহী ধার্মিক শ্রীচৈতন্যের কৃষ্ণপ্রেমের মতো। মহাপ্রভুর প্রিয় শিষ্য যবন হরিদাস দিনভর কৃষ্ণনাম জপ করতেন। এই তথাকথিত যবন, স্টুয়ার্ট দেখিয়েছেন, সম্ভবত কোনও সুফি ধারার সাধক ছিলেন। জপমালা বা তসবি গুণে ঈশ্বরের নাম জপা বা জিকির করা সুফি সাধনার এক মূলমন্ত্র। তসবিতে ঈশ্বরনাম জপা আর জপমালায় কৃষ্ণনাম জপায় অভ্যাসগত বিশেষ পার্থক্য নেই, দুই ধারাই ভক্তিবাদী। হরিদাস মুসলমান থেকে বৈষ্ণব হওয়ায় পাকাপাকি ঘরবদল করেছিলেন বলে মনে হয় না।
সুফি-বৈষ্ণব আদানপ্রদানের স্পষ্টতর রূপ দেখি সে যুগের বাংলা সুফি কাব্যে। সৈয়দ সুলতানের ‘নবীবংশ’ কাব্যে দেখি মহম্মদ হলেন বিষ্ণুর অবতার, আবার নারায়ণ হয়েছেন ইসলামের নবি। ইসলাম-প্রচারের সুফিরা আদি যুগে মক্কা থেকে বহু দূরে থাকা বাংলার মানুষের কাছে অবতারের ধারণাটি একটু অদলবদল করে নবি-ত্বের ধারণাটি বোঝানোর চেষ্টা করেন। জাভা এবং মালয়েও ঠিক এ ভাবে ইসলামের প্রচার করা হয়, যাতে মানুষ ঘর না ছেড়েও নিজের মনে করেই নতুন ধর্ম গ্রহণ করেন।
তবে মধ্যযুগের বাংলায় এত সংখ্যক মানুষ কেন মুসলমান হয়েছিলেন? হিন্দুত্ববাদীরা বলে, মুসলমান শাসকরা জোর করে, তরবারির মুখে মুসলমান করে। এ যুক্তি টেকে না। কিছু রাজা এবং সভাসদ সুলতানি আমলে ছলে-বলে-কৌশলে মুসলমান হয়েছিলেন, রাজা গণেশের পুত্র যদুর জালালউদ্দিন মহম্মদ শাহ হওয়ার কাহিনি পড়ি, পান্ডুয়ায় তাঁর বিরাট একলাখি সমাধিও দেখি। কিন্তু অবিভক্ত বাংলার অধিকাংশ মুসলমান গরিব চাষিদের মুসলমান করে সুলতানের কিছুমাত্র লাভ ছিল না, উল্টে নানা অধিকার ও আর্থিক ছাড় দিতে হত। বরঞ্চ হিন্দু রাখলে কৌশলে তাঁদের থেকে সময় সুযোগ বুঝে কর আদায় করা যেত। সাধারণত কর পেয়ে গেলে মুসলমান শাসকরা হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস বিশেষ ঘাঁটাতেন না, তবে কর ফাঁকি দিলে বা বিদ্রোহ করলে অত্যাচার করতেন। ব্যাপক হারে বাংলার মানুষকে মুসলমান করায় মুসলমান শাসকদের বিশেষ আগ্রহ ছিল বলে মনে হয় না। অন্য দিকে ইসলামি মৌলবাদীদের যুক্তি: জাতপ্রথার বিরুদ্ধে মুক্তি পেতে দলে দলে নিম্নবর্গীয় হিন্দু ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এ যুক্তিও দাঁড়ায় না, কারণ উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে জাতপ্রথা প্রাচীন উচ্চবর্গীয় আশরাফ শ্রেণি আতরাফ-বর্গীয় চাষাদের কোনও দিনই বিশেষ আপন করে দেখেনি।
প্রশ্নটির উত্তরের কাছে পৌঁছতে পারব যদি চেনা ছাঁদের ভাবনা ত্যাগ করে সে যুগের মানুষের জীবন ও চিন্তাকে পাথেয় করি। কেন আমরা আজও ধর্মবিশ্বাসের আশ্রয় নিই? সমস্যা-চিন্তা-অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেতে, জীবনে সুখ-শান্তি আনতে। তাই আজও সেক্টর ফাইভ-এর পথে পাঁচুঠাকুর-শীতলার মন্দিরে বাইক থেকে নেমে কেউ মায়ের অসুখ সারার প্রার্থনা করে একটা টাকা দেন, আবার মেয়ের বিয়ে দেওয়ার আশায় কেউ মৌলালির মাজারে চাদর চড়ান। এ বারে দেখি সে যুগের সত্যপিরের পাঁচালি, বা বনবিবির জহুরানামা-রায়মঙ্গল। মুসলমানরা বলেন সত্যপির, হিন্দুরা সত্যনারায়ণ, শিরনি চড়িয়ে বা সিন্নি মেখে একই প্রার্থনা: নিঃসন্তানকে সন্তান দাও, বিদেশে থাকা সওদাগরকে নিশ্চিন্তে বাড়ি আনো, ভালবাসার মানুষের সঙ্গে বিয়ে দাও।
মধ্যযুগের পির-সুফিরা, সাধু-সন্ত-যোগীর মতোই, নিজেদের অলৌকিক শক্তি বা কেরামতি জাহির করে বলেছিলেন, ঈশ্বরের দয়ায় তাঁরা অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। সুফিদের লেখায় যোগী ও সুফিদের কম্পিটিশনের বহু গল্প আছে। নিজামুদ্দিন আউলিয়ার ফাওয়াঈদ-অল-ফুয়াদ গ্রন্থে তো সুফি ও যোগীরা নানা ভাবে নিজেদের উড়ে বেড়ানোর প্রতিযোগিতা করে ভক্তদের সমর্থন আদায় করেন। বহু মানুষ পির ও সুফিদের ক্ষমতায় আকৃষ্ট হয়েই ইসলামে দীক্ষা নেন, যেমন বহু হিন্দু সাধুবাবার কাছে দীক্ষা নেন। দুই ধর্ম জপ-ধ্যান-প্রণামী-সিন্নির মতো এক রকম অভ্যাস করত। বিশ্বাসের তফাত ছিলই, বাংলার মানুষ সেই পার্থক্য মেনেই পরস্পরের বিশ্বাসকে মর্যাদা দিয়েছেন।
আজ প্রয়োজন অন্য এক ঘর ওয়পসির। মধ্যযুগে আলাদা ধর্মবিশ্বাস নিয়েও হিন্দু-মুসলমান ঘর ছাড়েননি, দেবীভক্ত কালকেতু আর সৈয়দ মোলানা কাজি গুজরাটে পাশাপাশি থেকেছেন। ক্রমে ব্রিটিশ শাসনে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে, দেশভাগ-যুদ্ধ-দুর্ভিক্ষের যন্ত্রণায় বিশ্বাস বিষ হয়ে ফিরে এসেছে। অথচ আমাদেরই ইতিহাস শিক্ষা দেয়, পার্থক্য নিয়েও সম্মান করা যায়, দুঃসময়ে একে অপরের ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা যায়, এক সঙ্গে থাকা যায়। ফিরতে চাই সেই ঘরে, পাশাপাশি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস ও নৃতত্ত্বের গবেষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy