ত র্কটি ‘আর্ট ফিল্ম বনাম কমার্শিয়াল ফিল্ম’-এর ন্যায়। কেহ বলে, আমজনতার পছন্দ অনুযায়ী শিল্পকে চলিতে হইবে। কেহ বলে, জনতোষণে শিল্পের অন্তঃসার কলুষিত হয়, সমষ্টিকে বরং গাঢ় শিল্পবোধ আয়ত্ত করিতে হইবে। অপর পক্ষ উত্তর দেয়, জন-মনোরঞ্জনে গ্লানি নাই, যুগোপযোগী হইয়া উঠিবার নিশ্চিত পরিচয় আছে। ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল’ বা আইসিসি এই মুহূর্তে এই বাণিজ্যিক শিল্পের পরিচিত পথ ও পোঁ ধরিয়াছে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, অর্থাৎ পঞ্চাশ ওভারের খেলার একটি প্রচলিত টুর্নামেন্ট তুলিয়া দিয়া, সেইটিকেও করিয়া দেওয়া হইল টি-টোয়েন্টি খেলারই প্রতিযোগিতা। আর বলা হইল, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হইবে প্রতি দুই বৎসর অন্তর। অর্থাৎ, চার বৎসর অন্তর বিশ্বকাপ হইবার অলিখিত প্রথাকেও ছুড়িয়া ফেলিয়া, ধৈর্যহীনতাকে সম্মান জানানো হইল। আইসিসি-র অধীন ১০৪টি দেশকেই টি-টোয়েন্টি স্বীকৃতি দেওয়া হইল। মহিলাদের টেস্ট বাতিল করিয়া দেওয়া হইল। সমগ্র পরিকল্পনা ও প্রকল্পগুলিতে ইঙ্গিত স্পষ্ট: যে হেতু টি-টোয়েন্টিই এখন জনমোহিনী গণউত্তেজক ক্রিকেট-সংস্করণ, তাই এইটিকেই প্রাধান্য দেওয়া হইবে। ইহার পর হয়তো দশ ওভারের টুর্নামেন্টও আসিতে পারে। বা পাঁচ। যাহা দর্শককে অধিক বিনোদন দিবে, যাহা সম্প্রচার করিলে বিজ্ঞাপন-পিছু বহু কোটি টাকা রোজগার করা যাইবে, তাহাই করিয়া ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক সংস্থা কোষাগার পূর্ণ করিবে। কিন্তু ক্রিকেটের কোষগুলি তাহাতে সঞ্জীবিত হইবে কি?
সন্দেহ নাই, টি-টোয়েন্টি আসিয়া ক্রিকেট দেখিবার বুঝিবার ও অনুভব করিবার ভঙ্গিই পাল্টাইয়া দিয়াছে। খেলার মধ্যে এই পরিমাণ দ্রুতি ও দুঃসাহস আসিতে পারে, কল্পনা করা যায় নাই। পূর্বে পাড়ার খেলাতেও কেহ একটি ছক্কা হাঁকাইলে পরের বলটি ঠুকিয়া দিত। তাহার মূলে ছিল এই মনোভাব: ঝুঁকির পর সংযম, এই ছন্দেই জীবনে চলিতে হয়। কিন্তু টি-টোয়েন্টি আসিয়া উদ্ধত ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করিল, কেন আতিশয্যই আমার ভূষণ হইবে না, অতিরেক হইবে না আমার শৈলী? আকাঙ্ক্ষা যত দূর যায়, মানুষের আচরণ তত দূর যাইবে না— ইহা ছিল মহাপুরুষদের উপদেশ। নূতন যুগ আসিয়া বলিল, একটা খাইব, দুইটা খাইব, সমূহ ব্যাটাকে চিবাইয়া খাইব। যখন মধ্যবিত্ত পাইতেছে বিশাল বাড়ি গাড়ি বিলাসব্যবস্থা, মাথায় ঋণের বোঝাকে পাত্তাই না দিয়া বেড়াইতে যাইতেছে দিঘার পরিবর্তে রোম, উচ্চবিত্ত প্রকাণ্ডতর অর্থ চাহিয়া ব্যাঙ্ককে ফেল মারাইয়া চম্পট দিতেছে অন্য দেশে, নিম্নবিত্ত ভাত না কিনিয়া মোবাইল কিনিতে ব্যস্ত থাকিতেছে, তখন ক্রিকেট কেন থাকিবে উপর্যুপর বিরামহীন ভোগের ব্যাকরণের বাহিরে? টি-টোয়েন্টি আসিয়া মানুষের হুড়ুমতাল-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করিবার নিমিত্ত নূতন যোদ্ধা নির্মাণ করিল, যাহাদের ভয়ডর নাই, নীতিবাক্য লইয়া মাথাব্যথাই নাই। সচিন সৌরভ দ্রাবিড়ের ন্যায় নিখুঁত নক্ষত্রেরা কিঞ্চিৎ বিস্ময়াহত নেত্রে পার্শ্বে পড়িয়া রহিলেন। ক্রিস গেল আসিয়া তাঁহাদের বলিলেন, শাস্ত্রগ্রন্থ চুলায় যাউক, মারো, কারণ তাহাতেই তালি, আমোদ। টি-টোয়েন্টি স্পর্ধা আনিয়াছে, আনিয়াছে অতুলন তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনা, কিন্তু নষ্ট করিয়াছে সহনশীলতা, নষ্ট করিয়াছে বহু ভাবে বহু রকমের খেলাকে আস্বাদন করিবার মানসিকতা। ক্রিকেটকে ও ক্রিকেটবোধকে ছাঁটিয়া সে ক্ষুদ্র স্থূল অগভীর পরিসরে আঁটিয়া দিয়াছে।
কিন্তু আমজনতা যাহা চাহিবে, নিয়ামক সংস্থাও তাহাই চাহিতে লাগিলে, মহা বিপদ। সকল ছাত্রই বানান ভুল করিতেছে, ইহা হইতে যদি শিক্ষার বোর্ডগুলি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে ছাত্রদের আরামার্থে বানানবিধিই তুলিয়া দেওয়া উচিত, তবে উল্টা ফল হয়। ছাত্রেরা আর ভাষা শিখিতে পারে না, একটি অশিক্ষিত প্রজন্ম তৈয়ারি হয়। টেস্ট ক্রিকেট আজ বিপন্ন, অধিকাংশ মানুষ তাহা দেখিতে চাহে না। তবে ভাবিতে হইবে উহাকে বাঁচানো যাইবে কী করিয়া। দ্রুতির পার্শ্বে ধীরতার মূল্য কোন কৌশলে আদায় করিয়া লওয়া যায়। কিন্তু ক্রীড়ার অপেক্ষা যুগলক্ষণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হইল, সার অপেক্ষা আড়ম্বরকে। কেহ বলিতেই পারে, অভিযোজনই সর্বোচ্চ কর্তব্য, নহিলে ডোডোপাখি হইতে হইবে। আবার কাহারও মতে, ডোডো তবু আত্মমর্যাদা লইয়া মরিয়াছে, ময়ূরপুচ্ছবান কাক যথেচ্ছ লোকরঞ্জন করিলেও, ভাঁড় বই কিছু নহে।
যৎকিঞ্চিৎ
মেট্রোয় জড়াজড়ি বনাম মারামারি নিয়ে তুলকালাম। তা ছাড়া যে চড়চড়ে রোদ্দুরটা উঠছে, মেজাজ মুহূর্তে মগডালে। তার ওপর মাংস বন্ধ। রবীন্দ্র জয়ন্তীতে অবধি বিরিয়ানি হবে না। একটা জাত আর কত সইতে পারে? সব কিছুর পিছনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কালো হাত দেখে ফেলা যেত, কিন্তু সে তত্ত্ব বস্তাপচেছে, যতই মার্ক্সের ২০০ বছর চলুক। তবু যে কেকেআর-এর কচি প্লেয়ার শুভমান গিল-কে নিয়ে বাঙালি অপত্যস্নেহে মাথা ঘামাচ্ছে, সে কি উচ্চ সংস্কৃতির পরিচয় নয়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy