শিক্ষায় দুর্নীতি, খাদ্যে দুর্নীতি, স্বাস্থ্যে দুর্নীতির পর এ বার রাজ্যের ক্রেতা সুরক্ষা দফতরকে নিয়েও নানা অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সাধারণ আদালতে উপভোক্তাদের অভিযোগ নিষ্পত্তি হতে অতিরিক্ত বিলম্ব হত বলে ১৯৮৬ সালে ২৪ ডিসেম্বর চালু হয় ক্রেতা সুরক্ষা আইন। এই আইনে উপভোক্তাদের জন্য স্বীকৃত ছ’টি অধিকারের অন্যতম হল প্রতিকার দাবি করার অধিকার। এই আইনের বলেই দেশের অন্যান্য রাজ্যের মতো এ রাজ্যেও ত্রিস্তরীয় কাউন্সিল গঠন, এবং ত্রিস্তরীয় বিচার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ১৯৯৯ সালে বাম আমলে এ রাজ্যে ‘ক্রেতা সুরক্ষা দফতর’ নামে একটি স্বতন্ত্র দফতর গঠন করা হয়। এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ নিঃসন্দেহে দেশের মধ্যে একটা বিশিষ্ট ভূমিকা নিয়েছে। এর পর ২০০১ সালে রাজ্যের প্রতিটি জেলায় গঠিত হয ‘ডিস্ট্রিক্ট ফোরাম’ এবং রাজ্যস্তরে ‘স্টেট কমিশন’। ওই বছরেই ‘লিগাল মেট্রোলজি’ বিভাগ, যা ওজনযন্ত্র ও অন্যান্য মানক যন্ত্রের যথার্থতা নির্ণয় করে, তাকে এই দফতরের অধীনে আনা হয়। এর ঠিক দু’বছর পর ২০০৩ সালে এটি ডিরেক্টরেট-এ উন্নীত হয়।
এগুলি আধুনিক প্রচেষ্টা হলেও, প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে উপভোক্তা সুরক্ষার বিষয়টি যে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখা হত, তার প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও উপভোক্তা কল্যাণার্থে রাষ্ট্রীয় বিধি ও তার প্রয়োগ কৌশল সম্পর্কে একটি সম্পূর্ণ অধ্যায় রয়েছে। ভারতে তুর্কি আমলে ক্রেতা সুরক্ষানিয়ে আইন কানুন যথেষ্ট কঠোর ছিল। বর্তমানে ক্রেতার সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর ক্রেতা সুরক্ষা মেলা হয়। ২৪ ডিসেম্বর জাতীয় উপভোক্তা দিবস এবং ১৫ মার্চ বিশ্ব উপভোক্তা অধিকার দিবস পালন করা হয়।
তবে রূঢ় বাস্তব এই যে, প্রতি দিন অসংখ্য ক্রেতা ও উপভোক্তা প্রতারিত হয়ে বিচারপ্রার্থী হচ্ছেন, কিন্তু বিচার মিলছে না। জমে থাকা মামলার সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, এ বছর মে মাস পর্যন্ত অমীমাংসিত মামলার সংখ্যা ১৬,৫৯৯। এর মধ্যে ৮১৫টি চিকিৎসা সংক্রান্ত মামলা। এই বিপুল মামলা জমে থাকার প্রধান কারণ, বিচারকের অভাব। ক্রেতা সুরক্ষা দফতর সূত্রের খবর, জেলার ক্রেতা সুরক্ষা কমিশনে সভাপতি নির্বাচিত হন জেলা দায়রা আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক। ১৫টি জেলায় ওই পদে কেউ নেই। বেশ কয়েকটি জেলার সভাপতিকে দু’টি জেলার দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই এতে বিচারে দেরি হচ্ছে। আবার, মামলার শুনানির সময়ে তিন সদস্যের ফোরাম দরকার, এক জন সভাপতি, যিনি জুডিশিয়াল সদস্য, বাকি দু’জন সদস্য, যাঁরা নন-জুডিশিয়াল হতে পারেন। অভিযোগ, অধিকাংশ জেলায় ফোরামের প্রতিনিধি না থাকায় বিচারপ্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটছে। যেমন, বীরভূমের ক্রেতা সুরক্ষা কমিশনে তিন জন প্রতিনিধির মধ্যে রয়েছেন মাত্র এক জন। ফলে, সেপ্টেম্বর থেকে বীরভূম জেলা ক্রেতা সুরক্ষা কমিশনে শুনানি হচ্ছে না।
এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে দ্রুত নিয়োগ দরকার। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বেনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বাম আমলে ফোরাম এবং কমিশনের সভাপতি এবং মেম্বার পদে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে নিয়োগ করা হত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের আমলেও সেই নিয়ম চালু ছিল। কিন্তু সম্প্রতি নিয়োগ নিয়ে বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় কেন্দ্রীয় লিখিত পরীক্ষা এবং সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সরকার নিয়োগ পদ্ধতিকে স্বচ্ছ করতে সভাপতি এবং মেম্বার পদে প্রার্থীদের নিয়োগ করার নিয়ম চালু করেছে। জাতীয় ক্রেতা সুরক্ষা আদালতও এর পক্ষে সওয়াল করে। ফলে ২০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা এবং ৫০ নম্বরের সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা হয়।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে কয়েকশো পরীক্ষার্থীর লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু স্কুলশিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার মতো, কমিশনের সদস্যদের নিয়োগেও অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠল। লিখিত পরীক্ষার ফল যথাসময় প্রকাশ না করে আচমকাই ১২ জুন ২০২৪-এ সাক্ষাৎকারে ডাকা হয় কয়েকজন প্রার্থীকে। অন্য প্রার্থীরা দাবি তোলেন, লিখিত পরীক্ষার যথাযথ ফল সর্বত্র প্রকাশ করে তবেই সাক্ষাৎকারে ডাকা হোক। সেই অভিযোগ আমল দেওয়া হয়নি। সাক্ষাৎকারও অবশ্য নির্ধারিত দিনে নেওয়া হয়নি।
ইতিমধ্যে বার বার বদলে যান পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকরা। যাঁদের তত্ত্বাবধানে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়, সেই আধিকারিকদের সরিয়ে আনা হয় অন্য আধিকারিকদের। কিছু দিন পরে ফের রদবদল হয়— বিশেষ সচিব পদমর্যাদার এক ব্যক্তিকে সরিয়ে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার এক প্রবীণ আধিকারিককে আনা হয়। তাতে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে অন্ধকার ঘোচেনি। সব প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ হবে, না কি সাক্ষাৎকারের জন্য কয়েকটি নামের তালিকা ফের প্রকাশ হবে, এখনও স্পষ্ট নয়। ইতিমধ্যে কেটে গেল প্রায় এক বছর, জেলা কমিশনগুলিতে বহু পদ শূন্যই রয়ে গেল। উপভোক্তাদের অভিযোগ নিয়ে যাঁরা বিচার করবেন, তাঁদের নিয়োগই যদি সন্দেহের ঊর্ধ্বে না থাকে, তা হলে বিচারের মান নিয়ে নানা সংশয় দেখা দিতে বাধ্য। ক্রেতা সুরক্ষা ব্যবস্থার উপর থেকেই নাগরিকের আস্থা কমে যাবে। আমরা সবাই বিচার চাই। কিন্তু কোন বিচারের দিকে এগোচ্ছি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy