Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Prashant Kishore

নামভূমিকায় এপ্রিল ২০২১

বিজেপির আসন একশো পেরোলে পরামর্শদাতার পেশায় দাঁড়ি। পণ করেছেন ‘খেলা হবে’ স্লোগান নিয়ে ভোটযুদ্ধে নামা তৃণমূলের প্রধান কোচ প্রশান্ত কিশোর 

রবিশঙ্কর দত্ত
শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২১ ০৫:০৬
Share: Save:

কালো টি শার্ট আর ডেনিম। কালো লেদার শু। মিনিট ২০ দেরি করে এলেন। তবে এমন গতিতে এলেন, বসলেন এবং কথা শুরু করলেন যেন কথামতো একেবারে সেকেন্ড মেনে চলছেন। বাড়তি বিনয় নেই, সামনে বসে উল্টো মত শুনে রাগও নেই।

নিজে যা বলছেন তাতে ১০০ শতাংশ বিশ্বাস রেখে আধঘণ্টা-চল্লিশ মিনিটে সামনের লম্বা টেবিলে গড়িয়ে দিয়েছিলেন তৃণমূলের শক্তি, দুর্বলতা। জড়তাহীন গলায় বলেছিলেন, চুরি-দুর্নীতি, দলতন্ত্র, গা-জোয়ারি আর তার উল্টো দিকে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তি, বিশ্বাসযোগ্যতার কথা। যা মাপজোখ করে তিনি এ রাজ্যে তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। প্রশান্ত কিশোর বা পিকে-কে সেই প্রথম দর্শনেই ঝাঁপি-খোলা মনে হয়েছিল।

আপনার কথা দিদি শুনবেন সব? তৃণমূলের পরামর্শদাতা হিসেবে এই প্রশ্নটি যে খুব গুরুত্বপূর্ণ, ভঙ্গিতে অন্তত সেই স্বীকৃতি না দিয়ে ক’সেকেন্ড পরে সামান্য হেসে প্রশান্ত বলেছিলেন, দিদিকে দেখে কিছু মনে হচ্ছে না?

লোকসভা ভোটে বড় রকম ধাক্কা খাওয়ার পরে তাঁকে ভোটকুশলী হিসেবে নিয়োগের বেশ কিছু দিন পর থেকেই গোটা তৃণমূলেই একটা বদলের রং ধরা পড়ছিল। সেই বদল যে তৃণমূলের অন্দরে আরও কিছু দিন আগে থেকে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছিল, তা-ও স্পষ্ট হয়েছিল। লোকসভা ভোটের ধাক্কা সামলাতে প্রশান্তের সংস্থা আইপ্যাক-এর পরামর্শ মতো তৃণমূল তখন ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচিতে নেমে পড়েছে অনেকটাই।

পাশাপাশি তৃণমূলের মতো দলের সঙ্গে প্রশান্ত বা তাঁর সংস্থা আইপ্যাকের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে দলের অন্দরেও। কে প্রশান্ত? সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই করে ক্ষমতায় আসা তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের কী শেখাবেন পিকে? প্রশ্ন উঠছিল তাঁকে দলের পরামর্শদাতা নিয়োগের পিছনে থাকা নেতৃত্বের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েও।

চাপানউতোরের মধ্যে এক দিন প্রশান্তের ভূমিকা নিয়ে দলের মূল্যায়ন স্পষ্ট করে দিলেন তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী। দক্ষিণ কলকাতায় কর্মিসভায় দাঁড়িয়ে অল্প কথার মানুষ বক্সী মেনে নিলেন— লোকসভা ভোটের পরে দলের কর্মীদের মনোবল এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে নতুন করে মানুষের কাছে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারছিলেন না অনেকে। ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি সেই জড়তা কাটিয়ে ফের কর্মীদের মাঠে নামাতে সাহায্য করেছে।

কিন্তু, শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আবেগের সম্পর্কের উপরে যে দল দাঁড়িয়ে, সেখানে প্রশান্ত বা তাঁর সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক তাতেও সহজ হয়নি। জেলায় জেলায় তাঁর প্রতিনিধিদের ‘পরামর্শ’ যে নেতা, জনপ্রতিনিধিদের কাছে ‘মাতব্বরি’— তাও সামনে আসছিল। তিন-চার দশক রাজনীতিতে থাকা নেতারা ‘শুধু মমতাকেই মানব’ অস্ত্রে কোথাও কোথাও প্রশান্তকে আমল না দিয়েই চলছিলেন।

কারও কারও অভিযোগ ছিল, দলের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে সাহায্য করতেই প্রশান্তের যাবতীয় পরিকল্পনা। এই ধারণায় বিশ্বাসী একটু ভারী নেতাদের দু’-এক জন তো সেই কর্মসূচিতে অংশ না নিয়ে কার্যত চ্যালেঞ্জ করে বসলেন প্রশান্তকে। তাঁদের অনেকে এখন তৃণমূলের সঙ্গে নেই। এ বার নির্বাচনে কেউ কেউ তৃণমূলের জোরদার প্রতিপক্ষও।

আর প্রশান্ত? তৃণমূলের কেউ কেউ এক সময় যাঁকে ‘বহিরাগত’ বা কর্পোরেট সংস্থার মালিক বলে চিহ্নিত করেছিলেন, সেই প্রশান্তই এ বার নির্বাচনে ‘খেলা হবে’ স্লোগান মুখে মাঠে নামা তৃণমূলের প্রধান কোচ।

দু’বছরে তৃণমূলকে কী দিয়েছেন তিনি? প্রশান্তের কথায়, “যা দিয়েছি তা তৃণমূলের প্রয়োজন ছিল।” তৃণমূলের রক্তক্ষরণ বন্ধে তাঁর সেরা দাওয়াই কী? প্রশান্ত মনে করছেন— ‘দুয়ারে সরকার’।

তা ঠিক কতটা ফলদায়ক হবে যে নিজেদের পেশাকে বাজি রাখলেন তিনি? এ বারের ভোটযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, বিজেপির আসন তিন সংখ্যা পেরোলে এই কাজ ছেড়ে দেবেন। নরেন্দ্র মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনই তাঁর সঙ্গে প্রশান্তের সম্পর্ক। ২০১১-য় জনস্বাস্থ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে কাজের অভিজ্ঞতা থেকেই মোদীর রাজ্যে অপুষ্টি দূর করার প্রকল্পে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। তার পর ২০১৪’র লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত তিনি তাঁর রাজনৈতিক পরামর্শদাতা হয়ে ওঠেন। একই ভাবে পিকে পরামর্শ দিয়েছেন একাধিক মুখ্যমন্ত্রীকে— বিহারের নীতীশ কুমার, দিল্লির অরবিন্দ কেজরীবাল, পঞ্জাবের অমরেন্দ্র সিংহ, অন্ধ্রপ্রদেশের জগন্মোহন রেড্ডিকে। এর মধ্যে নীতীশের জেডিইউ-তে যোগ দিলেও মনোমালিন্যের জেরে বিচ্ছেদ হয়ে যায় প্রশান্তের। লোকে বলে এঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে সুসম্পর্কের সময় প্রশান্তই ছিলেন ক্ষমতার ‘আসল’ কেন্দ্র। তাঁদের নিয়ন্ত্রক।

মাত্র ১০ বছরে দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ক্ষমতার নেপথ্যে এমন বিচিত্র কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলার পরও, জন্মসূত্রে বিহারের মানুষ প্রশান্তের জীবনেও বাংলার এই নির্বাচন অগ্নিপরীক্ষা। তৃণমূল জিতলে নায়ক তিনিও। আর হারলে?

রাজনীতিতে আসার সম্ভাবনা কখনওই উড়িয়ে দেন না তিনি। গাঁধীজিকে উদ্ধৃত করে প্রশান্ত নিজের গন্তব্য ইঙ্গিত করেন— শ্রেষ্ঠ রাজনীতি হল ঠিক পদক্ষেপ।

কিন্তু হারলে কি সেই ‘ঠিক পদক্ষেপ’ হিসেবে ‘শ্রেষ্ঠ রাজনীতি’তেই ফিরবেন?

আইপ্যাক-এ প্রশান্তের এক সহকর্মী বলছেন, এখনই এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দরকার হবে না।

অন্য বিষয়গুলি:

TMC PK Prashant Kishore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy