Advertisement
৩১ জানুয়ারি ২০২৫
CPM

বিপ্লবের জমিতে ‘হরেকৃষ্ণ’! কলকাতার খাদ্য গলিতে ‘উধাও’ নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসের ইস্তাহার

ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে হুগলির ডানকুনিতে অনুষ্ঠিত হবে সিপিএমের রাজ্য সম্মেলন। তার প্রাক্কালে সিপিএমের তরফে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’র প্রচার শুরু হয়েছে।

Dacres Lane is associated with the history of communist movement, but not known to local people

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

শোভন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:২৬
Share: Save:

আলিমুদ্দিন স্ট্রিট চেনেন?

৮ই, ডেকার্স লেনের চারতলা বাড়ির নীচে বসে থাকা বৃদ্ধ নিরাপত্তাকর্মী মদন নাথ বললেন, ‘‘চিনি না। নাম শুনেছি।’’

কী আছে ওখানে?

হাওড়ার বাগনানের বাসিন্দা মদনের প্রশ্নসূচক জবাব, ‘‘সিপিএমের অফিস না?’’

আপনি যে বাড়ির নীচে বসে আছেন, সেই বাড়ি একটা সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সদর দফতর ছিল জানেন?

বিস্ময়দৃষ্টি-সহ জবাব এল, ‘‘এখানে? সিপিএমের অফিস?’’

মদন জানেন না। তাঁর মতোই জানেন না ওই ঠিকানার দোতলার অফিসঘরে কর্মরত ‘ট্যাক্স কনসালট্যান্ট’ সঞ্জীব নন্দীও। আশপাশের কোনও দোকানদার, কেউ জানেন না। পাশেই ৮/এ ডেকার্স লেনের তিনতলা প্রকাণ্ড বাড়ি। সেই বাড়ির সামনে ঝোলানো ইসকনের ফ্লেক্স— ‘আপনি সিসিটিভির নজরদারিতে আছেন।’ ফ্লেক্সের দশা দেখলেই মালুম হয়, অনেক দিন আগে ঝোলানো। কোথাও কোথাও ছিঁড়ে গিয়েছে। রোদ-জলে ছাপার রংও ফিকে। যে জমিতে এক সময়ে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের নীল নকশা আঁকা হত, সেখানে এখন কমিউনিস্ট পার্টির চিহ্নমাত্র নেই!

ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে হুগলির ডানকুনিতে অনুষ্ঠিত হবে সিপিএমের রাজ্য সম্মেলন। তার প্রাক্কালে সিপিএমের তরফে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’র প্রচার শুরু হয়েছে। স্বাধীনতার আগে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকাণ্ড। নিষিদ্ধ হওয়া। গোপনে রাজ্য সম্মেলন সংগঠিত করার ইতিহাস জানান দেওয়া হচ্ছে সমাজমাধ্যমে। তার মধ্যেই রয়েছে ১৯৪৮ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া চতুর্থ রাজ্য সম্মেলনের কথা। তখন কমিউনিস্ট পার্টিও যেমন অবিভক্ত, তেমনই অবিভক্ত বাংলাও। দু’পারের বাংলা মিলিয়েই ছিল তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির ‘বাংলা প্রভিন্স কমিটি’। সেই অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির অবিভক্ত বাংলার রাজ্য সম্মেলন হয়েছিল এই ৮ নম্বর ডেকার্স লেনে সদর দফতরের ছাদে। সেই সময়ে সিপিআই ছিল নিষিদ্ধ সংগঠন। সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন রণেন সেন।

৭৭ বছর আগে এখানেই ছিল অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদর দফতর। এখন যা ইসকনের সম্পত্তি।

৭৭ বছর আগে এখানেই ছিল অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদর দফতর। এখন যা ইসকনের সম্পত্তি। — নিজস্ব চিত্র

একদা যে ঠিকানা ছিল ৮ ডেকার্স লেন, তা সময়ের নিয়মে ভাগ হয়েছে। একাধিক টুকরো হয়ে তৈরি হয়েছে ৮ই, ৮/১ ডেকার্স লেন। ট্যাক্স কনসালটেন্ট সঞ্জীব বললেন, যিনি মালিক ছিলেন, তিনিই একটি অংশ ইসকনকে দান করে গিয়েছিলেন। সিপিআই এবং সিপিএম— দু’দলের বর্তমান নেতারা ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কিন্তু তাঁরা বর্তমান জানেন না। সিপিআইয়ের রাজ্য সম্পাদক স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বললেন, ‘‘সেই সময়ের পর ও পাড়ার সঙ্গে যোগ ছিল না। কারণ, তখন ঠিকানা বদলে বদলে যেত পার্টি দফতরের।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম অবশ্য এটা জানেন যে, ডেকার্স লেনে এখন অনেক অফিস। কিন্তু ইসকনের কথা তাঁর জানা ছিল না। তাঁর কথায়, ‘‘সে সময়ে তো বিভিন্ন বাড়ি ভাড়া করে করে পার্টি চলত!’’

কিন্তু ইসকন কি জানে, যে সম্পত্তি তারা দানে পেয়েছে, সেখানে একটা সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সদর দফতর ছিল? ইসকন কলকাতার ভাইস প্রেসিডেন্ট রাধারমণ দাসের তা জানা ছিল না। ওই সম্পত্তি যে ইসকনকে কেউ দান করেছেন, তা শুনেও বিস্মিত রাধারমণ। তাঁর কথায়, ‘‘এমন কোনও সম্পত্তি আমাদের অধীনে নেই। হতে পারে মায়াপুর বা অন্য কোনও কেন্দ্রকে দান করা হয়েছিল।’’ রাধারমণ এ-ও বলেন যে, ‘‘এই জানলাম। আমি খোঁজ নেব।’’ যে বাড়িটি ইসকনকে দান করা হয়েছে বলে দাবি নিরাপত্তারক্ষী থেকে ট্যাক্স কনসালট্যান্টের, সেটি যে দীর্ঘ দিন ব্যবহৃত হয় না, তা দৃশ্যত স্পষ্ট। বাড়ির নীচে রুটি-সব্জির দোকান চালানো মহিলা বললেন, ‘‘মাঝেমাঝে সাধুরা আসতেন। দেখে চলে যেতেন। তবে অনেক দিন হল কাউকে আসতে দেখি না।’’

ডেকার্স লেন কলকাতার ‘খাদ্য গলি’। কয়েকশো মিটার রাস্তায় শুধু খাবার আর খাবার। সেই রাস্তাতেই রয়েছে অবিভক্ত বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসের জমি। যদিও সে কথা স্থানীয়দের কেউ জানেন না। জানার কথাও নয় সম্ভবত।

এত দিন পরে সিপিএম যখন ২৭তম রাজ্য সম্মেলনের পথে, তখন ও পার বাংলা অশান্ত। ঘটনাচক্রে, এই ইসকনেরই সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার করেছে বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসন, যা থেকে গোলমাল বড় আকার নিয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের। সিপিএম তথা বামেরা ও পার বাংলায় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন নিয়ে সরব হয়েছে। পাশাপাশিই ভারত থেকে প্যালেস্টাইন— দেশে দেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন নিয়েও তারা সচকিত। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে ‘বার্তা’ দিতে জ্যোতি বসু গবেষণাকেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে সিপিএম হাজির করেছিল বাংলাদেশের গায়িকা তথা বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

৭৭ বছর আগে যখন ডেকার্স লেনে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির অবিভক্ত বাংলার রাজ্য সম্মেলন হয়েছিল, তখন ছিল আক্ষরিক অর্থেই ‘দুর্দিন’। যদিও তার এক দশক কাটার আগেই ভারতে ‘সুদিন’ শুরু হয়েছিল কমিউনিস্টদের। ১৯৫৭ সালে কেরলে ইএমএস নাম্বুদিরিপাদের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছিল প্রথম কমিউনিস্ট সরকার। তবে তা ভেঙে গিয়েছিল। এ সবের মধ্যেই ১৯৬৪ সালে ভাগ হয় দল। তৈরি হয় সিপিএম। তার পর বিভিন্ন পর্যায়ের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ষাট এবং সত্তরের দশকে সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রভাব বিস্তার শুরু হয়েছিল কমিউনিস্টদের। পশ্চিম বাংলায় দু’টি (১৯৬৭ এবং ১৯৬৯) যুক্তফ্রন্ট সরকারে ‘নিয়ন্ত্রক’ ছিল সিপিএম। পশ্চিমবাংলায় গত দেড় দশক ধরে আবার দুর্দিনের মুখোমুখি সিপিএম। যদিও ইতিহাস হাতড়ে কর্মীদের দল বার্তা দিতে চাইছে, এর চেয়েও দুর্দিন ছিল।

কিন্তু সেই ইতিহাস রয়েছে নথিতেই। ডেকার্স লেন তা জানে না।

অন্য বিষয়গুলি:

CPM Dacres Lane Communist party alimuddin street
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy