ভারতে এখন ৬৪ শতাংশেরও বেশি মানুষ কর্মক্ষম বয়সের মধ্যে (১৫-৫৯ বছর) রয়েছেন, ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৭%, অন্য দিকে ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা ৮%। কর্মক্ষম মানুষের এই বিপুল অনুপাতকে বলে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ বা ‘জনসমষ্টির লাভ’— যত বেশি মানুষ কাজ করবে, দেশের উৎপাদনও ততই বাড়বে। কিন্তু, তার জন্য গোড়ায় কাজের সংস্থান করতে হবে যে!
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় সরকার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পটি ঘোষণা করে। তার দশ মাস পর, ২০১৫ সালের জুলাইয়ে, চালু হয় ‘স্কিল ইন্ডিয়া’ প্রকল্প। আসলে প্রকল্পটি ইউপিএ-র আমলের, কিন্তু আরও বহু প্রকল্পের মতোই নতুন মোড়কে এই পুরনো প্রকল্পটি বাজারে ছেড়েছিলেন মোদী। প্রত্যাশা ছিল, মেক ইন ইন্ডিয়া-র দৌলতে তৈরি হবে বিভিন্ন স্তরের দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর চাহিদা, আর সেই প্রয়োজন মেটাবে স্কিল ইন্ডিয়া।
২০০৯ সালে তৈরি ‘ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট পলিসি’-তে লক্ষ্য স্থির হয়, ২০২২ সালের মধ্যে মোট ৫০ কোটি মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। নতুন সরকারের স্কিল ডেভেলপমেন্ট আর এন্ট্রপ্রেনরশিপ দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীও ২০১৫ সালে এই লক্ষ্যের কথাই উল্লেখ করেন। তার পর প্রকাশিত হয় ‘ন্যাশনাল পলিসি ফর স্কিল ডেভেলপমেন্ট’। সেখানে অবশ্য কোনও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের কথা ছিল না। বলা হয়েছিল, ২০২২ সালের মধ্যে ৪০ কোটি মানুষের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হবে।
কোন বছর কত মানুষের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, তারও লক্ষ্য ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় সরকার। স্কিল ইন্ডিয়া-র একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ‘প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ যোজনা’। গোড়ায় স্থির করা হল, ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে এই যোজনায় মোট ২৪ লক্ষ ভারতীয়কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। লক্ষ্য পূরণ হয়নি। কিন্তু, তাতে কিছু আটকায়নি। ২০২০ সাল অবধি নতুন অনুমোদন পেয়েছে এই যোজনা। লক্ষ্য? চার বছরে মোট এক কোটি প্রশিক্ষণ। অর্থাৎ, গড়ে বছরে ২৫ লক্ষ— প্রথম বছরে যে লক্ষ্য পূরণে প্রকল্পটি ব্যর্থ, ঠিক সেটাই। ব্যর্থতা কি শুধু এক বছরেরই? পরিসংখ্যান বলছে, না। শুধু ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষটিকে বাদ রাখলে ২০১১ থেকে ২০১৫ অবধি কোনও বছরই প্রশিক্ষণের ঘোষিত লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব হয়নি।
২০১৭ সালের মাঝামাঝি স্কিল ডেভেলপমেন্ট আর এন্ট্রপ্রেনরশিপ দফতরের মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান জানালেন, অতঃপর প্রশিক্ষণের কোনও লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হবে না। কর্মদক্ষতা প্রশিক্ষণের পুরো সরকারি প্রক্রিয়াই হবে চাহিদানির্ভর— অর্থাৎ, যখন ও যেখানে এই প্রশিক্ষণ দরকার হবে, সেখানে দেওয়া হবে, কোনও বিশেষ কাজের বা বিশেষ ক্ষেত্রের চাহিদা না থাকলে সরকারি প্রচেষ্টাও থাকবে না। স্কিল ইন্ডিয়া যে তার লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও পৌঁছয়নি, এটা তারই ইঙ্গিত।
সরকারি প্রশিক্ষণ প্রকল্পগুলি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপি মডেলে রূপায়ণের উদ্দেশ্যে ইউপিএ-র আমলে ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এনএসডিসি) তৈরি করা হয়। দক্ষতা-প্রশিক্ষণের মূল ধারাটা অ-লাভজনক জায়গা থেকে সরিয়ে এনে লাভজনক করে তোলাও আর একটা উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু বৃত্তি প্রশিক্ষণকে এই ভাবে বদলে দেওয়ার প্রচেষ্টায় অনেক গাফিলতি দেখা দিতে থাকে। সেই গাফিলতিগুলি ঠিক করে নেওয়ার জন্য ২০১৬ সালের মাঝামাঝি ডায়রেক্টরেট জেনারেল অব ট্রেনিং-এর ভূতপূর্ব ডিরেক্টর জেনারেল সারদা প্রসাদের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং এই কমিটি বছর শেষে একটি রিপোর্ট পেশ করে।
ইউপিএ-র আমলে যা ছিল ‘স্ট্যান্ডার্ড ট্রেনিং অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড রিওয়ার্ড স্কিম’ (সংক্ষেপে, স্টার), সেটাই এখন নাম বদলে হয়েছে ‘প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ যোজনা’। কিন্তু, আগের প্রকল্পে যে ফাঁকফোকরগুলো ছিল, সেগুলো বন্ধ করার বিশেষ কোনও চেষ্টা হয়নি। এনএসডিসি-এর হিসেব বলছে, স্টার-এর অধীনে যত যুবক-যুবতী প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র ৮.৫ শতাংশের শেষ অবধি কর্মসংস্থান হয়েছে। ‘কৌশল বিকাশ যোজনা’র সরকারি ওয়েবসাইটের ড্যাশবোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ সালে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৬.৬ শতাংশ প্রশিক্ষণপ্রাপ্তের, ২০১৭-১৮ সালে এখনও পর্যন্ত সেই অনুপাত মাত্র নয় শতাংশ। অর্থাৎ, প্রশিক্ষণের পর কর্মসংস্থান না হওয়ার প্রবণতা যথাপূর্বং আছে। এনএসডিসি-র তত্ত্বাবধানে ‘কৌশল বিকাশ যোজনা’র প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলিতে এবং সরকার প্রশিক্ষণ শেষে পারিতোষিক দিচ্ছে, তা ছাড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো গড়ে তোলার জন্যও আর্থিক সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে।
সরকারি ড্যাশবোর্ডের তথ্য এবং পরিসংখ্যানকেই যদি সত্য বলে মেনে নেওয়া হয়, তাতেও স্পষ্ট, ‘প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ যোজনা’ কর্মসংস্থানে গতি আনতে ব্যর্থ হয়েছে। ইউপিএ আমলের ‘স্টার’ প্রকল্পটিতে বেসরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলির জন্যে সফল ছাত্রছাত্রীদের কর্মসংস্থান আবশ্যিক করা ছিল না— সারদা প্রসাদ কমিটির মতে, অবশ্যই তা করা উচিত ছিল। আশ্চর্যের কথা, নতুন ‘কৌশল বিকাশ যোজনা’তেও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলির জন্য কর্মসংস্থান আবশ্যিক করা হয়নি।
২০১৬ সালে ১২,০০০ কোটি টাকা দিয়ে পরের চার বছরের জন্য ‘কৌশল বিকাশ যোজনা’ পুনর্নবীকরণ করা হল। তার আগের এক বছরে প্রকল্পটির সাফল্য-ব্যর্থতার কোনও বিশ্লেষণ হল না। সারদা প্রসাদ কমিটি এই নীরবতার সমালোচনা করেছে। রিপোর্ট তৈরি করার সময় কমিটি যে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই একমত— লক্ষ্যমাত্রা এতই বেশি ধার্য করা হয়েছে যে তা পূরণ করা প্রায় অসম্ভব।
পরিসংখ্যানে স্পষ্ট, যে ছাত্রছাত্রীরা প্রশিক্ষণে সফল হচ্ছেন, তাঁদের বেতনেও বিশেষ বৃদ্ধি ঘটছে না। ফলে, প্রশিক্ষণে ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা স্বভাবতই কমছে। দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে। কিছু দিন আগে শোনা গেল, কিছু বেসরকারি সংস্থা সরকারি পয়সায় এবং সহজলভ্য ঋণ নিয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে নিজদের কর্মচারীদের ফের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের নতুন কর্মপ্রার্থী চালাচ্ছে। কিছু সংস্থা সরকারি সাহায্য নেওয়ার পর ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে বলেও অভিযোগ। এনএসডিসি কর্তৃপক্ষ জানালেন, নতুন ভাবে প্রকল্প শুরু করার সময় নজরদারির পরিমাণ বাড়ানোর কাজ শুরু হয়েছে। তাতে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কোনও লাভ হয়েছে কি না, জানার উপায় নেই, কারণ এনএসডিসি-র কর্তারা সেই পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে নারাজ।
নরেন্দ্র মোদীর সরকারের মস্ত গুণ, এ জমানায় প্রচারে খামতি নেই। সরকার স্কিল ইন্ডিয়া-কে ‘ভারতের বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্রে এক বিপ্লব’ হিসাবে চিহ্নিত করেছে। মুশকিল হল, ফেসবুক আর টুইটারে লিখলেই বিপ্লব আসে না। মেক ইন ইন্ডিয়া-র মতোই স্কিল ইন্ডিয়া-ও মূলত ব্যর্থতারই আখ্যান। সরকার এখন বাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে। গোটা দেশ জুড়েই শুধু কর্মসংস্থান হ্রাসের খবর আসছে। এই বাজারে নতুন শ্রমের তেমন চাহিদা কোথায়? অর্থনীতির ছবিটা না বদলালে, শিল্প উৎপাদনে ফের জোয়ার না এলে কর্মসংস্থান হওয়ার উপায় কী?
নরেন্দ্র মোদীরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবেন বলে মনে হয় না। কত মানুষ প্রশিক্ষণ পেলেন, তাঁদের কত জন চাকরি পেলেন, নিজের ব্যবসা আরম্ভ করলেন, সেই পরিসংখ্যানও সহজে মিলবে না। অস্বচ্ছ নীরবতাই এই আমলের অভিজ্ঞান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy