উল্লাস: অযোধ্যা জমি-বিবাদ মামলার ফল প্রকাশের পর বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সমর্থকরা। ৯ নভেম্বর, আমদাবাদ। পিটিআই
অন্য বছর হলে বিরিয়ানি রান্না হত মহল্লার সকলের জন্য। শোভাযাত্রা বার হত। কাওয়ালির আসর বসত। হজরত মহম্মদের জন্মদিন বলে কথা। এ বছর মিলাদ-উন-নবি’তে অযোধ্যার মুসলিম মহল্লায় এ সব কিছুই হয়নি। কোনও গন্ডগোলও হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরের দিনটা শান্তিতেই কেটেছে।
কাশ্মীরে ৫ অগস্ট ৩৭০ রদের ঠিক এক সপ্তাহ পরেই ছিল ইদ। কার্ফু শিথিল হয়। ইদগা খুলে দেওয়া হয়। নমাজের পর মিষ্টি বিলি করে পুলিশ। ইতস্তত বিক্ষোভ হলেও একটি বুলেটও খরচ করতে হয়নি। শান্তিতেই কেটেছিল কাশ্মীরের ইদ।
অশান্তি নয়। আনন্দও নয়। দেশের নানা প্রান্তেই গল্পটা বিষাদের।
রামমন্দির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। আদালতের রায় অবশ্যই শিরোধার্য। কিন্তু ভারতের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি এবং সামাজিক পরিবেশ দেখে মনে প্রশ্ন ওঠে, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতে একটা ‘পলিটিকাল ডিসএমপাওয়ারমেন্ট’ কি দেশের সংখ্যালঘু মানুষকে ক্রমশ কোণঠাসা করে ফেলছে? কাশ্মীর থেকে অযোধ্যা, তিন তালাক বিল থেকে এনআরসি ও নাগরিকত্ব বিলের চাপে তাঁরা ক্রমশই নিজেদের খোলসের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলছেন? যাতে অশান্তি তৈরির অভিযোগের আঙুল তাঁদের দিকে না ওঠে। বিষণ্ণতার লক্ষণ যেন বড় স্পষ্ট। অনেকেই বলেছেন, কাশ্মীর-অযোধ্যার মানুষ এক সময় সবই মেনে নেবেন। পেটের তাগিদ, সময়ের প্রলেপ, সব ভুলিয়ে দেবে। সে কেমন মেনে নেওয়া? কেমন ভুলে যাওয়া? সংবিধান কি এই ভারতের কথা বলেছিল?
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় আসে। লোকসভায় আসেন মাত্র ২৩ জন মুসলিম সাংসদ— এক জনও বিজেপির নন। ১৯৫২’র পর মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব কখনও এত কম হয়নি। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে সংখ্যাটা হয়েছে ২৭। বিজেপি থেকে এ বারও মুসলিম সাংসদ নেই। জম্মু-কাশ্মীর, উত্তরপ্রদেশ, বাংলা, বিহার, অসম, কেরল, তেলঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, পঞ্জাব, লাক্ষাদ্বীপের মতো ১০টি রাজ্য-কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বাদ দিলে বাকি দেশের লোকসভায় কোনও মুসলিম জনপ্রতিনিধি নেই।
সাংসদ সংখ্যা একটা দিক মাত্র। সংখ্যালঘুর রাজনৈতিক ক্ষমতা কমে যাওয়ার আর একটি নমুনা হল, এই লোকসভাতেই তিন তালাক নিষিদ্ধকরণ বিল পাশ হয়েছে। ঠিক হয়েছে, স্ত্রীকে ত্যাগ করার অপরাধে মুসলিম পুরুষকে জেলে পাঠানো যাবে।
কাশ্মীরের উদাহরণে ফিরে যাওয়া যাক। ২০১৪-র শীতে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা নির্বাচন হল। কাশ্মীর উপত্যকার ৪৬টি বিধানসভা আসনের একটিও বিজেপি জেতেনি। পিডিপি-বিজেপি জোট গড়ে সরকার হল। টিকল না। রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হল। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে কাশ্মীর উপত্যকায় বিজেপি ৪৬টির মধ্যে মাত্র একটি বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল। রায় দ্ব্যর্থহীন। কাশ্মীর উপত্যকার মানুষ বিজেপিকে খারিজ করেছে। এখন কাশ্মীরের মানুষের মনে প্রশ্ন উঠছে, সেই বিজেপি কাশ্মীর উপত্যকা থেকে ৩৭০ রদের নৈতিক অধিকার কোথায় পেল? কাশ্মীরের মানুষের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই রাজ্য ভেঙে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরির ছাড়পত্র কি কাশ্মীরের ভোটাররা বিজেপিকে দিয়েছিল? তা হলে ভোট, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের কী অর্থ? এটা কি রাজনৈতিক ক্ষমতার বিলোপ নয়?
এখনও অবধি যা হয়েছে, তা হয়তো ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন করে তুলছে অনেককেই। অযোধ্যায় রামমন্দিরের পথ পরিষ্কার হওয়ার পরে অনেকের মনেই আশঙ্কা, এ বার কি কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরের গায়ে জ্ঞানবাপী মসজিদ ও মথুরার শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমিতে শাহি ইদগা গেরুয়া বাহিনীর নিশানায় চলে আসবে? আরএসএস-বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা জানিয়েছেন, এমন কোনও পরিকল্পনা তাঁদের নেই। রামমন্দির তৈরিই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য। বাস্তবেও দেশ জুড়ে হিন্দুত্ব এমনিতেই যে ভাবে ডানা মেলেছে, তাতে গেরুয়া বাহিনীর এই মুহূর্তে কাশী-মথুরার মসজিদ নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর গদি দখলের জন্য হিন্দুত্বের প্রয়োজন পড়েনি নরেন্দ্র মোদীর। পাঁচ বছর পরে ফের ক্ষমতায় ফিরতেও তাঁর তূণে রামমন্দির নামক তির ছিল না। কিন্তু তাঁর রাজত্বেই গোরক্ষা বাহিনীর দাপট বেড়েছে। নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনের পরিকল্পনার কথা বলে অমিত শাহ জানিয়েছেন, অন্য দেশ থেকে আসা মুসলিমদের এ দেশে জায়গা মিলবে না।
অযোধ্যা রায় ঘিরে আরএসএস নেতারা সহিষ্ণুতার বার্তা দিচ্ছেন। বার বার মুসলিম সমাজের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন। মোহন ভাগবতের মতে, অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরি হলে হিন্দু-মুসলমান সমাজের মধ্যে বৈর কাটবে। তবে, আরএসএস আসলে মনে করে, এ দেশের সকলেই হিন্দু। গত সেপ্টেম্বরেই সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত আরএসএস-এর সম্মেলনে বলেছিলেন, ভারতে বসবাসকারী সকলেরই জাতিগত পরিচয় হল সে হিন্দু। ভাগবতের যুক্তি ছিল, মুসলিমরা আরএসএস-এর শাখার পাশে থাকলেই সবচেয়ে নিরাপদে থাকেন। অপপ্রচারে কান না দিয়ে মুসলিমদের আরএসএস-এর শাখায় গিয়ে সব কিছু জেনে-বুঝে নিতেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি। এ যেন দেশের মুসলিম সমাজকে তাঁদের ডানার নীচেই আশ্রয় নিতে আহ্বান— বশ্যতা স্বীকার করে নিলেই নিরাপদে থাকা যায়। এই সহিষ্ণুতার বার্তা, শান্তির আবহ, অযোধ্যার রায়ের পরে মারদাঙ্গা না হওয়ায় অনেকেরই মনে হচ্ছে, বেশ, এই তো নাগরিক সমাজ কেমন পরিণতমনস্ক, পরধর্মসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। সংখ্যালঘুদের আর চিন্তা নেই।
সত্যিই কি তাই? ধরুন, অযোধ্যায় যদি উল্টো রায় হত? আদালত রামমন্দিরে সবুজ সঙ্কেত দেওয়ায় আরএসএস অযোধ্যার রায়ে শুধু ‘উদ্দীপ্ত’ হয়েছে বলে জানিয়েছে। ‘বিজয়ী ভাব’ দেখায়নি। ‘সংযম’-এর নীতি নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সুপ্রিম কোর্টের রায়কে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নতুন মাইল ফলক হিসেবে তুলে ধরেছেন। নরেন্দ্র মোদী-মোহন ভাগবত বোঝানোর চেষ্টা করছেন, এই রায় কারও হারজিত নয়। রায় উল্টো দিকে গেলেও তাঁরা একই কথা বলতেন কি?
নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ এক বছর আগেই ২০১৮-র অক্টোবরে মোহন ভাগবত নিজে দাবি করেছিলেন, রামমন্দির তৈরিতে আইন আনুক মোদী সরকার। আদালতের শুনানিতে দেরি হলে তাকে ‘ধৈর্যের পরীক্ষা’ বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন তিনি। পরিষদও ফের আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। মোদী বুঝিয়েছিলেন, আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষা করা উচিত। লোকসভা ভোটের বৈতরনি পার হতেও মোদী দেশপ্রেম-জাতীয়তাবাদের আবেগে সওয়ার হয়েছিলেন। রামমন্দির তৈরির স্বপ্ন দেখিয়ে হিন্দুত্বের রাজনীতি করেননি। মোদীর অবস্থান ছিল, আইনি ঘেরাটোপের মধ্যে থেকেই রামমন্দির তৈরি হবে।
১৯৯২-এ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার আগে লালকৃষ্ণ আডবাণী রথযাত্রায় বেরিয়েছিলেন। সেই রথযাত্রা শুরু হয়েছিল গুজরাত থেকে। এবং তার একটি অংশের সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy