প্রতি বৎসর বারো লক্ষেরও অধিক মানুষ প্রাণ হারান পথ দুর্ঘটনায়। তাঁহাদের একজন ইলেন হার্জবার্গ। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় ১৮ মার্চ নিহত এই মহিলার নাম উঠিয়াছে ইতিহাসের পাতায়। ইলেন হার্জবার্গ প্রথম মানুষ, যিনি চালকহীন, স্বয়ংক্রিয় গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ দিয়াছেন। তাঁহার মৃত্যু অনেকগুলি প্রশ্ন তুলিয়া দিয়াছে। কোনও মানবচালক পথচারীকে ধাক্কা দিলে তাহার বিচার হইত, দোষী সাব্যস্ত হইলে শাস্তিও হইত। গাড়িটি স্বয়ংক্রিয় বলিয়া কি মৃত ব্যক্তি বিচার পাইবে না? যদি বিচার হয়, শাস্তি মিলিবে কাহার? গাড়িটি বাতিল হইবে? গাড়ির মালিকের জেল-জরিমানা হইবে? না কি যে প্রযুক্তিতে চালিত হইতেছে ওই স্বয়ংচালিত গাড়ি, তাহার নির্মাতারা দণ্ড পাইবেন? স্বয়ংক্রিয় গাড়ি নির্মিত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই দর্শনবিদ ও নীতিশাস্ত্রের পণ্ডিতরা এমন নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজিতেছেন। যন্ত্র দুর্ঘটনা ঘটাইবে কম, ইহাই প্রত্যাশিত। যন্ত্রচালক ক্লান্ত, উত্তেজিত বা বিভ্রান্ত হইয়া ভুল করিবে না। অপরকে টেক্কা দিবার অভিপ্রায়ে ট্রাফিক আইন ভাঙিবে না। নির্মাতারা যে সকল নির্দেশ আগাম দিয়া রাখিয়াছে, সেগুলি স্বয়ংক্রিয় গাড়িকে নির্ভুল ভাবে চালনা করিবে। অতএব সুরক্ষার দৃষ্টিতে স্বয়ংক্রিয় যানই উত্তম। তাই অনেকের বক্তব্য, অকারণ নৈতিক আলোচনা না করিয়া গাড়ির প্রতি নির্দেশে আরও সতর্ক হইলেই হয়। স্বয়ংক্রিয় গাড়ির গতিসীমা বাঁধিয়া দেওয়া হউক। মানবচালিত গাড়ি ও যন্ত্রচালিত গাড়ির কে আগে যাইবে, তাহার বিধি স্থির করা হউক। অপর চালকের গতি-প্রবৃত্তি বুঝিবার ক্ষমতা আরও প্রখর করিতে উন্নততর ‘অ্যালগরিদ্ম’ লেখা হউক যন্ত্রচালকের জন্য।
এই সকল ব্যবস্থায় স্বয়ংক্রিয় গাড়ি আরও সুরক্ষিত হইতে পারে। কিন্তু নৈতিক সঙ্কট দূর হইবে না। নীতির মূল প্রশ্নটি দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর বিচার বা শাস্তির প্রশ্ন নহে। তাহা সিদ্ধান্তের দায় স্বীকার করিবার প্রশ্ন। দর্শনে একটি পরিচিত নৈতিক প্রশ্ন এইরূপ— কল্পনা করিতে হইবে একটি চালকহীন ট্রলি যে লাইন দিয়া যাইতেছে, তাহাতে চলিলে সম্মুখে পাঁচজন মানুষ পড়িবে, প্রত্যেকেই নিহত হইবে। যদি ট্রলি অন্য লাইনে চালিত করা হয়, প্রাণ যাইবে একজনের। এখন কর্তব্য কী? মনে হইতে পারে, পাঁচটি প্রাণের চাইতে একটি প্রাণ যাওয়া ভাল। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ওই একক মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী হইবেন, যিনি ট্রলিকে অন্য পথে চালাইয়াছেন। ট্রলিকে পূর্বনির্দিষ্ট পথে চলিতে দিলে পাঁচটি মৃত্যুর দায় তাঁহার নহে। যন্ত্রচালিত গাড়ির ক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠিবে, আপৎকালে কাহার প্রাণকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হইবে? যাত্রীর অথবা পথচারীর? এত দিন সঙ্কটের মুহূর্তে মানবচালক সেই সিদ্ধান্ত লইয়াছে। তাহার দায়ও সে-ই বহন করিয়াছে। এখন সম্ভাব্য সঙ্কটের কল্পনা করিয়া আগাম সিদ্ধান্ত লইতে হইবে প্রযুক্তিবিদ ও গাড়ির নির্মাতাদের। নৈতিক বিচারের ক্ষেত্রে
এ এক নূতন পরিস্থিতি। যাত্রী ওই গাড়িটি ক্রয় বা ভাড়া করিতে ব্যয় করিয়াছে বলিয়া কি অধিক গুরুত্ব দাবি করিতে পারে? না কি বাঁচিবার অধিকার সকলের এক, তাই পথচারীও সমান গুরুত্ব পাইবে? এমন জটিল প্রশ্নের সম্মুখে দাবি উঠিয়াছে, দর্শনবিদ, নীতিবিদকেও রাখিতে হইবে গাড়ির পরিকল্পনায়। কাহারও দাবি, স্বয়ংক্রিয় গাড়িকে কী নির্দেশ দিয়াছে নির্মাতা, জনস্বার্থে তাহা প্রকাশ করিতে হইবে।
তথ্য পাইলে স্বস্তি মিলিবে কি? স্বয়ংক্রিয় গাড়ি লইয়া যে মানসিক অস্বস্তি, তাহার সবটাই মৃত্যু এড়াইবার অক্ষমতা লইয়া নহে। সমস্যা যন্ত্রের ‘যান্ত্রিকতা’ লইয়া। সম্মুখে পথচারী আসিয়া পড়িলে মানবচালক ব্রেক কষিয়া, গাড়ি ঘুরাইয়া এড়াইতে চাহে। আহত ব্যক্তির সহায়তায় ছুটিয়া আসে। পথচারীর ন্যায় চালকও দুর্ঘটনার আকস্মিকতায় উদ্ভ্রান্ত, বিপর্যস্ত হইয়া পড়ে। আহত ও আঘাতকারীর এই অংশীদারি একপ্রকার মানবিক বন্ধন তৈরি করে, তাহাই নৈতিকতার মানবজমিন। স্বয়ংক্রিয় গাড়ির সহিত তেমন ‘সম্পর্ক’ সম্ভব নহে। এমনকী তাহাকে দোষ দিয়া, গালাগালি দিয়াও সান্ত্বনা মিলিবে না। যাহার অপরাধবোধ নাই, আত্মগ্লানি নাই, তাহাকে দোষারোপ করিয়া কী লাভ? সে যে মানুষ নহে! দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সম্ভাবনা কমাইবে স্বয়ংক্রিয় গাড়ি, কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটিলে তাহার ক্ষত হইবে আরও গভীর। ঊনবিংশ শতকে শিল্পবিপ্লবের পর প্রশ্ন উঠিয়াছিল, মানুষ কি যন্ত্র হইয়া গেল? একবিংশে ‘কৃত্রিম বুদ্ধি’ ফের মোড় ঘুরাইল শিল্পের। এখন প্রশ্ন, যন্ত্র কি মানুষ হইবে না?
যৎকিঞ্চিৎ
যে বাঘ এক কালে গপাগপ মানুষ খেয়েছে, আজ মানুষ তাকে রক্ষা করার জন্য হেদিয়ে মরছে। বাঘ গুনে ফেলব, বাঘের ছবি তুলব, কোথায় বাঘ দেখা গিয়েছে তাকে সযত্নে তুলে এনে নিরাপদে রাখব, বাঘ বাঁচানোর জন্য সেমিনার করব— এ ভাবে কেউ ফার্স্ট সিনের পরম শত্রুকে লাস্ট সিনে ভালবেসে ফেলছে, উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা ছাড়া কোত্থাও ঘটেনি। এই ‘দিয়েছ দংশনদাগ, তবু কেন পুষব না বাঘ’ ধুয়ো শুনলে বাঘ কী বলবে? হয় বলবে, ‘ভাগ!’ কিংবা খুব সম্ভব, ‘হামবাগ!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy