গণতান্ত্রিক দেশে বিচারবিভাগের দায়িত্ব যদি ঠিক ভাবে পালন করিতে হয়, তাহা হইলে সাক্ষী সুরক্ষার ব্যবস্থা যে অতীব জরুরি, ইহা কোনও নূতন কথা নহে। সুপ্রিম কোর্ট গত কয়েক বৎসরে বহু বার এই কথা মনে করাইয়া দিয়াছে। ২০০৬ সালে ল কমিশন অব ইন্ডিয়া নির্দেশ করিয়াছিল যে, দেশে এই ব্যবস্থা অনুপস্থিত। মানবাধিকার কমিশন এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে। যে হেতু বিষয়টির সহিত নারী অধিকার ও শিশু অধিকার ভঙ্গের বিবিধ উদাহরণ অঙ্গাঙ্গি, তাই নানা ধরনের অসরকারি সংস্থা কথাটি বারংবার উত্থাপন করিয়াছে। কিন্তু এত সব সত্ত্বেও কাজের কাজটি হয় নাই। গত বুধবার সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আনা সাক্ষী সুরক্ষা প্রকল্পটিতে সিলমোহর বসাইয়া ২০১৯ সালের শেষের মধ্যে তাহা কার্যকর করিতে নির্দেশ দিল। বলা যাইতে পারে, ভারতীয় নাগরিকের হাতে সাক্ষী সুরক্ষার অস্ত্রটি এত দিনে আসিয়া পৌঁছাইল। এই প্রকল্পটি আপাতত কার্যত দেশের আইন হিসাবে গণ্য হইতে পারে, যত দিন না পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ও রাজ্য আইনসভাগুলি ইহাকে আইন হিসাবে পাশ করিতেছে। বিষয়টির গুরুত্ব অপরিসীম, কেননা ভারতের মতো দেশে যে সব কারণে অপরাধের তুলনায় শাস্তিপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা এত কম— তাহার মধ্যে প্রধান হইল সাক্ষী সুরক্ষা বন্দোবস্তের অভাব। বিচারপ্রক্রিয়াই সাক্ষী সুরক্ষার অভাবে অসম্ভব হইয়া পড়িতে পারে, বারংবার তাহা দেখা গিয়াছে।
দুই-একটি উদাহরণই যথেষ্ট। ২০১৬ সালের গোড়ায় উত্তরপ্রদেশের ললিতপুরে যে দলিত মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হইয়াছিলেন, তাঁহার বিচার কোনও দিন সম্ভব হয় নাই। অভিযুক্ত ব্যক্তি কেবল রাজ্যের প্রধান রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন না, জাতের হিসাবেও তিনি ছিলেন পরাক্রমশালী। শেষ পর্যন্ত যখন মামলাটি আদালতে উঠিল, দেখা গেল সপরিবার দলিত মেয়েটিকে ভয় দেখাইয়া গ্রামছাড়া করা হইয়াছে, মামলা চালাইবার লোক নাই। যে মামলার সূত্রে কথাটি নূতন করিয়া উঠিল, তাহাও উল্লেখের দাবি রাখে। আসারাম বাপু নামক স্বঘোষিত ও প্রবল প্রতাপশালী ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে ষোলো বৎসরের মেয়েটিকে ধর্ষণের অভিযোগের সঙ্গে সঙ্গে আরও বহু ধর্ষণের সংবাদ উঠিয়া আসা সত্ত্বেও মামলা চালানো কঠিন হইয়া পড়িতেছিল, স্পষ্টতই, সাক্ষী সুরক্ষার অভাবে। বাঘের মুখ হইতে অভিযোগকারিণীকে বাঁচাইবার প্রয়োজনটি সুপ্রিম কোর্টই মনে করাইয়া দিয়াছে। ভারতের মতো দেশে সামাজিক প্রভাবশালী অপরাধীর সংখ্যা এত বেশি যে, অভিযোগকারীর পাশাপাশি সাক্ষীর জীবনের ঝুঁকিও মারাত্মক হইয়া দাঁড়ায়। মার্কিন দেশের ফেডারাল উইটনেস স্কিম-কে যে গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং যত অর্থ ইহার পিছনে নির্দিষ্ট করা হয়, ভারতকে তাহা স্মরণ করাইয়া দেওয়া কর্তব্য। যথাযথ সাক্ষী সুরক্ষা কেবল সাধারণ প্রহরার বিষয় নয়, জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ পদ্ধতিতে প্রহরার দাবি রাখে।
সংশয়ীরা বলিবেন, যে দেশে তদন্তকারী পুলিশ অফিসার, এমনকী বিচারপতি স্বয়ং মামলা চলাকালীন খুন হইয়া যান, নিছক সাক্ষী সুরক্ষা সেখানে বিচারের পথ কত দূরই বা প্রশস্ত করিতে পারে? বাস্তবিক, বিচারপতি লোয়া কিংবা উত্তরপ্রদেশে সম্প্রতি-নিহত পুলিশ অফিসার সুবোধকুমার সিংহের কথা ভাবিলে গভীর সংশয় গভীরতর হয় যে, রাজনৈতিক মহলের সহিত অপরাধজগৎ কতটা ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত। তবু, কানা-আইন অন্তত নাই-আইনের তুলনায় শ্রেয়। শাসনবিভাগের সৎ ও স্বচ্ছ অংশগ্রহণের দিন কবে আসিবে, সেই অজানা ভবিষ্যতের দিকে তাকাইয়া না বসিয়া থাকিয়া বরং কানা-আইন দিয়া যতটুকু সাধন করা যায়, বিচারবিভাগ ও আইনবিভাগ সমাজকে ততটুকুই স্বস্তি দিতে পারুক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy