Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Parliament

প্রণামই সার

অতিমারি পরিস্থিতিতে লোকসভার ‘কোয়েশ্চন আওয়ার’ রদ করা হইয়াছে।

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

ছয় বছর আগে সংসদ ভবনে প্রথম প্রবেশের মুহূর্তে নরেন্দ্র মোদী যখন গণতন্ত্রের মহিমময় মন্দিরের সোপানতলে প্রায় সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করেন, তাহা দেখিয়া হুতোম বোধ করি অলক্ষ্যে দাঁড়াইয়া স্বগতোক্তি করিয়াছিলেন: এও অ্যাক নূতন! বাস্তবিকই, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সেই লগ্নে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের জন্ম হয়। আক্ষরিক অর্থেই অভূতপূর্ব— জওহরলাল নেহরু হইতে মনমোহন সিংহ অবধি নরেন্দ্র মোদীর পূর্বসূরিরা, অটলবিহারী বাজপেয়ী সমেত, কেহ কখনও সংসদ ভবনের সিঁড়িতে শুইয়া পড়েন নাই, সম্ভবত পড়িবার কথা ভাবেনও নাই। ভাবিবার কারণও ছিল না। সংসদের মহিমা তাহার অট্টালিকার ইট-কাঠ-পাথরে থাকে না, সংসদীয় গণতন্ত্রের তন্নিষ্ঠ অনুশীলনের মধ্য দিয়াই সেই মহিমাকে সার্থক করিয়া তুলিতে হয়। তাহার প্রথম ও প্রধান শর্ত: অবাধ এবং স্বচ্ছ আলোচনা। গণতন্ত্রকে ‘আলোচনার মাধ্যমে চালিত শাসন’ (গভর্নমেন্ট বা ডিসকাশন) বলিয়া অভিহিত করিবার ঐতিহ্যে এই শর্তেরই প্রবল স্বীকৃতি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁহার সহ/অনুগামীরা এই মৌলিক গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধা পোষণ করেন, এমন কোনও লক্ষণ তাঁহাদের আচরণে দেখা যায় নাই। সংসদের ভিতরে এবং বাহিরে কোথায়ও তাঁহারা আলোচনার তোয়াক্কা করেন না, আলোচনার নামে মাঝে মধ্যে যাহার ব্যবস্থা করেন তাহার নাম একতরফা বাণীবিতরণ। এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এক অবিশ্বাস্য নজির স্থাপন করিয়াছেন। দীর্ঘ ছয় বছরে তিনি স্বদেশের মাটিতে কার্যত একটিও সাংবাদিক সম্মেলন করেন নাই, গত বছর লোকসভা নির্বাচনের শেষ পর্বে সাংবাদিকদের একটি সভা ডাকিয়াছিলেন বটে, কিন্তু নিজে কোনও প্রশ্নের উত্তর দেন নাই! এই মানসিকতার প্রতিফলন ঘটিয়াছে সংসদের অভ্যন্তরেও। শাসকরা সেখানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সচরাচর একতরফা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেই ব্যগ্র থাকেন, বিতর্ক যদি-বা হয়, তাহাতেও আন্তরিক ভাবে যোগদানের মানসিকতা তাঁহাদের আচরণে প্রায়শই দেখা যায় না।

সংসদের বর্তমান অধিবেশনে এই প্রবণতারই এক বিশেষ রূপ প্রকট হইয়া উঠিয়াছে। অতিমারি পরিস্থিতিতে লোকসভার ‘কোয়েশ্চন আওয়ার’ রদ করা হইয়াছে। পরিস্থিতি সত্যই অস্বাভাবিক, সংসদের অভ্যন্তরে দূরত্ব বজায় রাখিবার সমস্ত আয়োজন নিশ্চয়ই অত্যাবশ্যক, কিন্তু তাহার জন্য সুচিন্তিত প্রশ্ন তুলিবার আয়োজনটি একেবারে বন্ধ করিবার যুক্তি ছিল কি? ‘জ়িরো আওয়ার’ বহাল আছে বটে, কিন্তু তাহা নিশ্চয়ই যথার্থ বিকল্প হইতে পারে না। এহ বাহ্য। সংসদের শুরু হইতেই দেখা গিয়াছে, বিরোধী দলের প্রশ্ন বা অভিযোগ শুনিতে এবং তাহার সদুত্তর দিতে শাসকদের পরিচিত অনীহা এ বারেও, এই কঠিন পরিস্থিতিতেও, প্রবল। আর্থিক সঙ্কট, বিশেষত কর্মসংস্থানের ভয়াবহ অবস্থা লইয়া যথাযথ বিতর্ক নাই, পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা লইয়া বিশদ আলোচনার সুযোগ নাই, এমনকি কত জন শ্রমিক এই পরিস্থিতিতে মারা গিয়াছেন তাহার পরিসংখ্যানও সরকার ‘জানে না’। লাদাখের সীমান্ত বিষয়ে প্রথমে কিছুই না বলিয়া পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুখ খুলিয়াছেন বটে, কিন্তু তাহাতে প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কিত বিভ্রান্তি কমিয়াছে না বাড়িয়াছে, তাহাই বড় প্রশ্ন। বস্তুত, কোন বিষয়ে সরকার কত শব্দ বা কয়টি বাক্য খরচ করিতেছে, তাহা গৌণ ব্যাপার। প্রধান সমস্যা মানসিকতার। গণতন্ত্রের ধর্মে সুস্থিত হইলে শাসকের প্রথম দায়িত্ব বিরোধী মত শুনিতে চাহিবার এবং উত্তর দিবার আন্তরিক চেষ্টা করা। সংসদ সেই আদানপ্রদানের শ্রেষ্ঠ পরিসর। এই ধর্ম হইতে ক্রমাগত বিচ্যুতিই যদি শাসকের ধর্ম হয়, তবে সংসদ খুলিয়া রাখিবার প্রয়োজন কী? প্রধানমন্ত্রী প্রত্যহ সকালে অট্টালিকার সিঁড়িতে প্রণিপাত করিয়া আসিলেই গণতন্ত্রের দেবী প্রসন্ন হইবেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Parliament Narendra Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy