পশ্চিমবঙ্গ এক ভয়ঙ্কর সঙ্কটে। অত্যুক্তি হইবে না যদি বলা হয় জন্মাবধি, অর্থাৎ গত সাত দশকে এত বড় সঙ্কট তাহাকে দেখিতে হয় নাই। অতিমারির পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য প্রাণপণ তাহার লড়াই লড়িতেছে, সেই সময়ই এক অ-ভূতপূর্ব ঘূর্ণিঝড় তাহাকে যেন মূল হইতে ছিটকাইয়া ফেলিয়া দিল নির্মমতর রণাঙ্গণে। আড়াই শতাব্দীর অন্যতম তীব্র ঝড় বুধবার দক্ষিণবঙ্গের উপর দিয়া যাইবার সময় যেন প্রবল রোষে উপড়াইয়া লইয়া গেল কলিকাতা, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বিদ্যুৎসংযোগ, ফোনসংযোগ, রাস্তাঘাট, সেতু, বাঁধ, দোকানপাট, সর্বোপরি বাড়িঘর। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সুবিপুল। এলাকার পর এলাকা বিধ্বস্ত। যে সময়ে উপর্যুপরি চার দফা লকডাউনে কোভিড-১৯ হইতে বাঁচিবার জন্য মানুষকে ঘরে আটকাইয়া রাখিবার দেশব্যাপী প্রচেষ্টা চলিতেছে, তেমন সময়ে কলিকাতা ও দক্ষিণবঙ্গে লক্ষ লক্ষ পরিবার পথে নিক্ষিপ্ত, অসহায়, খাদ্যহীন, আচ্ছাদনহীন। ইতিমধ্যেই করোনাযুদ্ধে রাজ্যের ভান্ডার বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তাহার উপরে এই ঐতিহাসিক প্রাকৃতিক দুর্বিপাকের পর পশ্চিমবঙ্গ কী ভাবে যুঝিবে, তাহা এক সুগভীর উদ্বেগের বিষয়।
বিপন্ন বিপর্যস্ত পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত মানুষের সামনে এখন একটিই কর্তব্য, একটিই দায়িত্ব: রাজ্য ও রাজ্যবাসীকে রক্ষা করা। আর সমস্ত ধরনের চিন্তাভাবনা, হিসাব, অজুহাত— এবং দলতান্ত্রিক রাজনীতি— সরাইয়া রাখিয়া এখন সর্বশক্তিতে পুনর্নির্মাণের কাজ করিতে হইবে, জীবনের স্বাভাবিকতাকে পুনর্নির্মাণের কাজ। আর সেই কাজে স্বাভাবিক ভাবেই নেতৃত্ব দিতে হইবে রাজ্যের প্রশাসনকে। সেই নেতৃত্বের ভূমিকায় মুখ্যমন্ত্রী তাঁহার স্বাভাবিক আন্তরিকতার প্রত্যক্ষ পরিচয় দিয়াছেন। নিজের প্রশাসনিক কেন্দ্রে টানা থাকিয়া, প্রায় নিদ্রাহার ত্যাগ করিয়া তিনি নিজের প্রশাসনকে কাজে উদ্বুদ্ধ ও চালিত করিয়াছেন। তাঁহার মর্মস্পর্শী আহ্বান ধ্বনিত হইয়াছে, তাঁহার উদ্বিগ্ন সক্রিয়তা সহমর্মিতার পরিচয় দিয়াছে। অতি গুরুতর একটি প্রার্থনা জানাইয়াছেন সকলের কাছে, পাশের মানুষ হইতে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সকলের কাছে— সব রকমের পার্থক্য, বিভেদ, বিদ্বেষ ভুলিয়া এখন প্রত্যেকের পাশে প্রত্যেকের দাঁড়াইবার সময়।
মুখ্যমন্ত্রীর প্রার্থনাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, কেন্দ্রীয় সরকার কতখানি পাশে দাঁড়াইবে তাহা লইয়া বিলক্ষণ সংশয় আছে। আমপান পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে আছড়াইয়া পড়িবার প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা পরে প্রধানমন্ত্রী টুইটযোগে রাজ্যবাসীর মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করিয়াছেন। উত্তম। অপি চ, সেই সমবেদনা জ্ঞাপনে সন্তুষ্ট না হইয়া তিনি পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা সফরের পরিকল্পনাও করিয়াছেন। অতি উত্তম। কিন্তু সংশয় দুর্মর— শুভেচ্ছা এবং সফরেই ‘পাশে থাকিবার’ কার্যক্রম সমাপ্ত হইবে না তো? দেশের অন্যতম প্রধান মহানগর কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের এমন সঙ্কটমুহূর্তেও রাজ্য সরকারের ‘অক্ষমতা’ প্রমাণ করাই প্রধান ‘কাজ’ হিসাবে বিবেচিত হইবে না তো? এবং পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতারা? তাঁহারা কি এখনও যথাপূর্বম্ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি নিরলস আক্রমণ ও বিদ্রুপ শানাইতেই ব্যস্ত থাকিবেন? পশ্চিমবঙ্গের প্রতি কেন্দ্রের নির্দয়তার ধারাটি ঐতিহাসিক। কিন্তু বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার এবং তাহার শাসক দল সেই ধারাটিকে যে চরমে পৌঁছাইয়া দিয়াছেন, তাহা বাস্তবিকই অ-পূর্ব। এই পরিপ্রেক্ষিতে একটিই শেষ কথা বলিবার থাকে, এবং রাজ্যবাসীকেই তাহা বলিতে হইবে। ঘরে হউক, বাহিরে হউক, পশ্চিমবঙ্গের জন্য কে বা কাহারা সত্যই ভাবিতেছে, তাহা প্রমাণের মোক্ষম সময় ইহাই। যাঁহারা রাজ্যকে বাঁচাইতে আগাইয়া আসিবেন, তুচ্ছতা ক্ষুদ্রতা ভুলিয়া পাশে দাঁড়াইবেন, সহায়তা দিবেন, তাঁহারাই এই রাজ্যের শুভার্থী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy