রামকুমার মুখোপাধ্যায় ‘লোকবৃত্তের দরদি স্বজন’ (১৪-১২) প্রবন্ধে বাংলা সাহিত্যের ‘ব্যতিক্রমী’ লেখক সমরেশ বসু সম্পর্কে লিখেছেন, “জীবনের মতো তাঁর সৃজনেরও বৈশিষ্ট্য খড়ির গণ্ডি অতিক্রম করা।” প্রসঙ্গত, সমরেশ বসু নেহাত গল্প উপন্যাস পাঠের আনন্দ দিতে, কলম হাতে তুলে নেননি। তিনি সারা জীবন ঝুঁকি নিয়েছেন, বিতর্কিত হয়েছেন, সমালোচনার মুখে পড়েছেন কিন্তু থেমে যাননি। উত্তর ২৪ পরগনার শ্যামনগর এবং জগদ্দলের মধ্যবর্তী এলাকা আতপুর। এখানে একটি আধা বস্তির দেড় কামরা ঘরে টালির নীচে, স্ত্রী পুত্র কন্যা-সহ ছয় জনের পরিবার নিয়ে এক সময় দিন কাটিয়েছেন। টালির ঘরের ফাটা মেঝের উপর জলচৌকি রেখে দোয়াতে ডোবানো কলম দিয়ে তিনি লিখতেন। সুখী গৃহকোণে বসে সাহিত্য রচনা করার মতো সৌভাগ্য প্রথম জীবনে তাঁর হয়নি। তাঁর লেখায় কিছু লেখকের মতো একঘেয়েমির সুর ধ্বনিত হয়নি বলেই তিনি ব্যতিক্রমী। আসলে তাঁর সমস্ত রচনা, সব সাহিত্যকর্ম তাঁর জীবনযাপনের অঙ্গ। তাঁকে উৎকণ্ঠিত করে তুলত মানুষের বিপন্নতা। নিজের জীবনের সঙ্কটের মধ্য দিয়েই উপলব্ধি করতেন সেই বিপন্নতা, আর পর্বে পর্বে তাই প্রতিফলিত হয়েছিল তাঁর রচনায়।
শিকড়ের প্রতি টান লেখক এবং মানুষ সমরেশ বসুর বড় বৈশিষ্ট্য ছিল। দীর্ঘদিন নৈহাটিতে থাকার সুবাদে জগদ্দল-ভাটপাড়া-হালিশহরের মানুষের কাছে সমরেশবাবু নয়, সমরেশদা হয়ে উঠেছিলেন। ‘এলিট’ শ্রেণির মানুষের থেকেও তিনি সমাজের ভাগ্যহীন মানুষের সঙ্গে বেশি সহজে মিশে যেতে পারতেন। তাই হয়তো তাঁর জীবনের বেশ কিছু রচনাতে গঙ্গার উভয় পাড়ের সাধারণ ও শ্রমজীবী মানুষের সুখ, দুঃখের কথা উঠে এসেছে। তিনি নিজস্ব সৃষ্টির স্রোতধারার মধ্যেই অন্য আবর্ত সৃষ্টি করেছেন। তা সত্ত্বেও একই জায়গায় থেমে থাকেননি। বিবর, প্রজাপতির মতো বিতর্কিত উপন্যাস যেমন লিখেছেন, সেই রকম কালকূট ছদ্মনামে অমৃতকুম্ভের সন্ধানের মতো কালজয়ী উপন্যাসও রচনা করেছেন। তবে আমার কাছে অন্তত তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস দেখি নাই ফিরে। যেটি তিনি দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে লিখেছেন কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি। রামকিঙ্কর বেজের জীবন নিয়ে লেখা এই অসাধারণ উপন্যাসটি পড়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, যার রেশ বোধ হয় আজও রয়ে গিয়েছে।
রবীন রায়, শ্যামনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
পাহাড়পথ
সান্দাকফুতে পর পর পর্যটকের মৃত্যু সম্পর্কিত প্রতিবেদনগুলির কারণে প্রকাশ্যে উঠে এসেছে পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে পর্যটক ও অনভিজ্ঞ ট্রেকারদের বেপরোয়া মনোভাব। এখন পাহাড়ে পর্যটন ও ট্রেকিং প্রায় সমার্থক হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে পাহাড়ের নিয়মনীতি ও নজরদারি যথেষ্ট শক্ত হলেও ফস্কা গেরো থাকছেই। লক্ষ করা যাচ্ছে, তথ্য গোপন বা ভুল তথ্য দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেওয়ার প্রবণতা। পাহাড়ে গাড়ির চালকরা ও বিভিন্ন এজেন্সি অনেক আগেই পর্যটকদের যাওয়ার অনুমতি করিয়ে রাখেন। মরসুমি ভিড়ের জন্য প্রত্যেকের তথ্য দেখা সম্ভব হয় না। এর সঙ্গে ‘ভিতর থেকে করিয়ে নেওয়া’র চল আছে। তারই পরিণামে ফি বছর সিল্করুটে পর্যটকরা নানা রকম বিপদের সম্মুখীন হচ্ছেন।
শারীরিক সমস্যার বিষয়টির উল্লেখ বাধ্যতামূলক হলেও অনেকেই তা জানান না। প্রয়োজনে এখানকার পরিচিত ডাক্তারদের দিয়ে শংসাপত্র অবধি লিখিয়ে নিয়ে যান। এর পর স্রেফ ছবি তোলার স্বার্থে অপ্রচলিত রাস্তায় চালকদের বেশি পয়সা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠেছে। মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু গাড়িতেই যাওয়া যায়। কম সময়ে অতিরিক্ত উচ্চতায় পৌঁছে গিয়ে দেদার ফুর্তি করে অসুস্থ হয়ে পড়ার সুযোগ বাড়ছে।
কিন্তু এ বিষয়ে এখনও পর্যটকরা চূড়ান্ত অসচেতন। অভিজ্ঞ পর্বতারোহীদের সাক্ষাৎকার শুনে ও বিভিন্ন পডকাস্ট দেখে নিজেদের মতো করে বেরিয়ে পড়াই কাল হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞদের সাবধানবাণী উপেক্ষা করা বা নিজেদের মতো করে যাত্রাপথ সাজিয়ে নেওয়াটাই অনেকের প্রবণতা হয়ে উঠছে।
এ বার আসি ট্রেকের কথায়। বহু ট্রেকারদের কোনও প্রচলিত শিক্ষা বা ট্রেনিং নেই। কিন্তু তাঁরা ইউটিউবের ভরসায় যে কোনও ট্রেক রুটে চলে যাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানগত প্রশিক্ষণ না থাকলেও ট্রেকের একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি ও অভিজ্ঞদের পরামর্শগত প্রশিক্ষণ ও পড়াশোনা লাগে। তা আজ ক’জন ট্রেকারের মধ্যে আছে? শারীরিক সক্ষমতা ও আত্মসমীক্ষায় সামান্য ভুলচুক মারাত্মক বিপদ ডেকে আনে। বহু ক্ষেত্রেই দেখেছি সন্ধের পর জোর করে গাড়িতে বা হেঁটে পৌঁছনোর চেষ্টা করে পাহাড়ি পথে বিপদে পড়েছেন অনেকে।
এর সঙ্গে আছে সমাজমাধ্যম ও ইন্টারনেটে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ট্রেকিং ক্লাব। যাদের চমকদার বিজ্ঞাপন আর রিলসে মজে গিয়ে তাদের ভরসা করে অনেকে যাত্রা শুরু করছেন। বহু ইউটিউবার অনেক সময় ভুল ম্যাপ ও তথ্য আপলোড করে দেন, যা মারাত্মক। বহু পর্যটক দু’-চারটি ট্রেক করেই কয়েক জনকে নিয়ে নিজেরাই ট্রেকিং ক্লাব গঠন করে ফেলছেন। এঁদের কাছে কোনও জিজ্ঞাস্য রাখলে দায়সারা উত্তর আসে, চ্যানেল বা পেজে দেখে নেবেন!
পাহাড়ি রাস্তায় স্থানীয় গাইড না নেওয়া বা নিলেও তাঁদের কথা না শোনা, পছন্দমতো ছবি তোলার জন্য পাহাড়ের প্রাথমিক নিয়ম বা থাম্ব রুল লঙ্ঘন করা ইত্যাদি প্রায়শই পর্যটকদের ভীষণ বিপদের মধ্যে ফেলে দেয়। মনে রাখা উচিত প্রচণ্ড শারীরিক সক্ষমতা, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার পরেও সাফল্যের তাড়না আর আত্মসমীক্ষার একটু ভুলেই ছন্দা গায়েনের মতো পাকা পর্বতারোহীর চরম পরিণতি হয়েছিল। সেই সঙ্গে হারিয়েছিলাম এক অভিজ্ঞ শেরপাকেও।
বেড়ানোর মজা উপভোগের পাশাপাশি পাহাড়ের নিয়মকানুন কঠোর ভাবে মেনে চলা উচিত। সমস্ত এজেন্সির নথিভুক্তি বাধ্যতামূলক হোক। বেসক্যাম্পের নজরদারিও বাড়ানো প্রয়োজন। পর্যটকরা যদি নিজেরা সচেতন না হয়ে কেবল প্রচার, রিলস আর সমাজমাধ্যমের জনপ্রিয়তার লোভে বা চটক দেখে পাহাড়কে বেছে নেন তবে বারংবার দুর্ঘটনা ঘটবে।
অরিত্র মুখোপাধ্যায়, শ্রীরামপুর, হুগলি
প্রগতি মেলা
সুকুমার রায়ের অবিস্মরণীয় সৃষ্টি আবোল তাবোল-এর শতবর্ষ পূর্তিতে অষ্টাদশ ‘প্রগতি মেলা’-র মূল আকর্ষণ আবোল তাবোলের দেশ। সেই ভাবনায় মেলাপ্রাঙ্গণে দেখা গেল হাঁসজারু, কুমড়োপটাশ, বকচ্ছপ, কাতুকুতু বুড়ো, খুড়োর কল, হুঁকোমুখো হ্যাংলা, হুলোর গান, ট্যাঁশগরু-সহ বিচিত্র সুকুমার-সৃষ্টির জমকালো প্রর্দশনী। শিল্পী রাজেশ রীত ও তাঁর দলের অপূর্ব শিল্পকর্মে তারা প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছে। প্রর্দশনীর পাশাপাশি ‘কিশলয়’-এর শিল্পীবৃন্দের আবোল তাবোল-এর নাট্যরূপও আকর্ষক ছিল। দর্শকদের মন জয় করেছে শ্রুতিনাটক ভাগ্য। পূর্ণিমা কাঁড়ারের পরিচালনায় উপভোগ্য হয়ে ওঠে কালিকাপাতাড়ি লোকনৃত্য। এ ছাড়াও উপভোগ্য নাটক হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী, দলবদ্ধ নৃত্য, বেবি শো, সেরা দিদি, ম্যাজিক, বাউল ও লোকসঙ্গীত।
মেলার আর এক কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু ছিল ‘চিত্রশিল্পে হাওড়া: অতীত থেকে বর্তমান’। অনুসন্ধিৎসু চোখে ধরা পড়েছে হাওড়ার গ্ৰাম থেকে শহরের নানা দৃষ্টিনন্দন চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের নিদর্শন, প্রাচীন ও বর্তমান মন্দির, রাজবাড়ি, জাদুঘর, রেল স্টেশনে ও বাস স্টপে দেখা অপূর্ব রঙিন তুলির টান। কোনও শিল্পী একটা আস্ত গ্ৰামকেই রূপ দিয়েছেন শিল্পগ্ৰামে। আবার কেউ নিজের গোটা বাড়িটা ভরিয়ে তুলেছেন তুলির টান আর কাটুম কুটুমে।
হাওড়ার শিল্প মানচিত্রের গৌরব অতীতের শিল্পী বামাপদ চট্টোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ সরকার, কালীপদ ঘোষাল, শৈল চক্রবর্তী, রবীন মণ্ডল, ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত, পূর্ণেন্দু পত্রী, নিখিলেশ দাস প্রমুখ। চিরকালীন সম্পদ কার্টুনিস্ট রেবতীভূষণ ঘোষ, সুফি ওরফে নরেন রায় চণ্ডী লাহিড়ী ও নারায়ণ দেবনাথ প্রমুখ। তাঁদের চিত্রকলা ও শিল্পকর্ম বাড়িয়েছে মেলার মান ও সৌন্দর্য।
নাগরদোলা, জিলিপি, বাদাম ভাজা, চটপটি তো ছিলই। ছিল রক্তদান শিবির, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পরিবেশ সম্মেলন। ১৫-১৯ ডিসেম্বরের মেলার আয়োজক ছিল হাওড়া মঙ্গলদীপ শিশুকল্যাণ সমিতি। আরও নতুন নতুন ভাবনা নিয়ে এগিয়ে চলুক প্রগতি মেলা।
দীপংকর মান্না, আমতা, হাওড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy