সম্প্রতি সরকার একটি নির্দেশিকা জারি করে বেসরকারি হাসপাতালের খরচ বেঁধে দিতে তৎপর হয়েছে। এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েই বলছি, এই সিদ্ধান্ত ঘিরে বেশ কিছু প্রশ্ন রয়ে গেল। বেসরকারি হাসপাতালের খরচ বেঁধে দেওয়ার সঙ্গে চিকিৎসকদের পারিশ্রমিকও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনও বেসরকারি হাসপাতালের বিলের দশ শতাংশেরও কম চিকিৎসকদের পারিশ্রমিক হিসেবে ধার্য করা হয়।
ঠিকই, অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালই সীমাহীন মুনাফা লোটে এবং স্বাস্থ্যকে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু এই বেসরকারি কর্পোরেট হাসপাতালগুলির বাড়বাড়ন্তের কারণ সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার অপ্রতুলতা আর তার প্রতি এক শ্রেণির মানুষের অনাস্থা। স্বাভাবিক। জিডিপি-র দেড় শতাংশেরও কম যদি স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হয়, তবে তা দিয়ে সরকারি পরিকাঠামোকে আর কতই বা উন্নত করা যায়! আমাদের দেশে চিকিৎসাব্যবস্থা ইংল্যান্ডের মতো এনএইচএস-নির্ভর নয়, যেখানে নাগরিকের চিকিৎসার যাবতীয় দায়ভার রাষ্ট্র বহন করে। যদিও সেই ব্যবস্থাও এখন ভেঙে পড়ার মুখে। চিকিৎসার খরচ এত বেড়েছে যে, রাষ্ট্রের পক্ষে নাগরিকের চিকিৎসার সম্পূর্ণ খরচ মেটানো অসম্ভব।
আমাদের হাতের সামনে আরও একটি মডেল: আমেরিকা। সেখানে চিকিৎসা পুরোটা বিমা-নির্ভর। ইনশিয়োর্যান্স থাকলে মানুষ চিকিৎসা পাবেন, না হলে নয়। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে দু’ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থাই প্রচলিত— সরকারি এবং বেসরকারি, যেখানে অনেক মধ্যবিত্তও বিমার মাধ্যমে চিকিৎসার সুবিধে পেয়ে থাকেন। একটি মধ্যবর্তী স্বাস্থ্য পরিষেবা রয়েছে— বেসরকারি ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত অ-লাভজনক কিছু হাসপাতাল। যেমন, কলকাতায় রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠান, ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ, বালানন্দ ব্রহ্মচারী হাসপাতাল, মাতৃসদন প্রভৃতি। এরা মুনাফার লক্ষ্য নিয়ে পরিষেবা দেয় না। যেটুকু আয়, তা কাজে লাগানো হয় চিকিৎসা পরিষেবাকেই উন্নত করতে। মূল লক্ষ্য, অল্প খরচে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং কিছু গরিব মানুষকে উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া, যেখানে হাসপাতালের পরিবেশ তুলনায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, এক বেডে দু’জন রোগী থাকেন না। কিছু ক্ষেত্রে আমরা ঘর থেকে টাকা দিয়ে দামি পরীক্ষা করাই, উন্নত পরিষেবা দিই। অন্যের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে বাচ্চাদের চিকিৎসা করি। ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ একটি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট টিচিং কলেজ, বহু চিকিৎসক পড়াতে আসেন। তাঁদের আমরা বেতনও বেশি দিতে পারি না। এই ইনস্টিটিউট উৎকর্ষের নিরিখে দেশে-বিদেশে সম্মান লাভ করেছে।
কিন্তু এই কোভিড-কালে ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলির তীব্র আর্থিক সঙ্কট আরও বেড়েছে। বেশ কিছু বছর ধরে সরকারি সাহায্য ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছিল। কোভিড পরিস্থিতিতে অন্য জায়গার সাহায্যও ক্ষীণ হতে শুরু করেছে। বেডের সংখ্যা কমাতে হয়েছে, বেড অকুপ্যান্সি কমে পঞ্চাশ শতাংশের নীচে নেমেছে। অথচ, কর্মীর সংখ্যা একই আছে। তাঁদের বেতনও দিতে হচ্ছে। ফলে যেটুকু ফান্ড ছিল, তা দ্রুত নিঃশেষ হওয়ার পথে। ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট একটি নতুন হাসপাতাল গড়ার স্বপ্নও আপাতত বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছি। এই পরিস্থিতিতে সরকারি পরামর্শ, অগ্রিম না দিতে পারলেও রোগীকে ফেরানো যাবে না— আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলির পক্ষে ভাল খবর নয়। কারণ, এমন অনেক উদাহরণই আছে, যেখানে চিকিৎসা করানোর পর রোগীর পরিবার বিল মেটাতে চায়নি। কর্পোরেট হাসপাতালের মতো যে ভাবেই হোক টাকা আদায়ের পন্থা অবলম্বন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও পাকাপোক্ত নয়।
এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। এমন তীব্র সঙ্কটের মুখে পড়ে রোগীর কাছ থেকে অল্প একটু বেশি আর্থিক সাহায্য চাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। যদিও এটি এই অ-লাভজনক প্রতিষ্ঠানের ঘোষিত নীতির বিরুদ্ধ। কিন্তু হাসপাতালের টিকে থাকার জন্য আর কোনও উপায়ও নেই! চিকিৎসার খরচ অনেক বেড়েছে। শুধু স্যালাইন, অক্সিজেন আর অ্যান্টিবায়োটিকে বাচ্চাদের চিকিৎসা সম্ভব হয় না। উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে অতিমারির সময় বহু রোগীর প্রাণ বাঁচানো হচ্ছে। অথচ, সরকারি পরামর্শ অনুযায়ী চার্জ বাড়াতে পারব না, সরকারি সাহায্যও সে ভাবে পাব না। তা হলে আমরা চালাব কী করে? আমরা তো সুলভে চিকিৎসা দিয়ে সরকারকেই সাহায্য করার চেষ্টা করছি। এখনও অনেক মানুষ এই আধা সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর নির্ভরশীল।
সরকারের কাছে আবেদন, বেসরকারি কর্পোরেট হাসপাতালগুলির গোত্রে না ফেলে আমাদের মতো বিরল প্রজাতির প্রতিষ্ঠানের জন্য পৃথক নীতি হোক।
শিশু চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এর অধিকর্তা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy